অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ওয়েব সিরিজ পর্যালোচনা

ইন্দুবালা ভাতের হোটেল: অস্তিত্বের শেকড় অনুসন্ধানী আখ্যানচিত্র

ড. ইসলাম শফিক

প্রকাশিত: ১২:২৯ এএম, ২৮ মার্চ ২০২৩ মঙ্গলবার   আপডেট: ০১:৪৯ পিএম, ২৮ মার্চ ২০২৩ মঙ্গলবার

তথ্য-প্রযুক্তির মহাউৎকর্ষের সুবর্ণসময়ে ওটিটি প্লাটফর্ম বিনোদন দুনিয়ার কাঁটাতারে সুরক্ষিত বিভেদের সীমানা প্রাচীর উঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। নিউ-মিডিয়া বিনোদন জগতের আপন চাহিদার সুযোগ প্রতিটি দর্শকের হাতের মুঠোয় এনে হাজির করছে। যেমনী ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব, ব্লগ; তেমনি Over the Top অর্থাৎ ওটিটি প্লাটফর্ম-নেটফ্লিক্স, ডিজনি, হটস্টার, হইচই, বায়োস্কোপ, বঙ্গ, বিঞ্জ, টফি, চরকি’র মতো প্ল্যাটফর্মের বদৌলতে ওয়েব ফিল্ম, ডাবিং ফিল্ম, টেলিফিল্ম, ওয়েব সিরিজ, ট্রেডিশনাল চলচ্চিত্র, খণ্ডনাটক, অনুনাটক প্রভৃতি নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক একটা পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে বিনোদন শিল্পে। দুই বাংলাসহ সারাবিশ্বের  বাংলা ভাষাভাষী দর্শকবৃন্দের জন্য ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু ওয়েব সিরিজ। তন্মধ্যে বেশ কয়েকটি সিরিজ ইতোমধ্যে দর্শক নন্দিত হয়েছে। 

দর্শকনন্দিত উল্লেখযোগ্য সিরিজগুলো হলো- ব্যোমকেশ, আগস্ট ১৪, রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি, একেন বাবু, গোরা, মহানগর, রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ, মন্টু পাইলট, মহাভারত মার্ডারস,  সুন্দরবনের বিদ্যাসাগর, মানভঞ্জন, কারাগার সিজন এক এবং দুই, ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি, নেটওয়ার্কের বাইরে, ঊনলৌকিক, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, মরীচিকা, তিথির অসুখ, জাগো বাহে, টান, রেডরাম, গুণিন, পেটকাটা ষ, শাটিকাপ, নিখোঁজ, জাহান, সিন্ডিকেট, কনট্রাক্ট, সুড়ঙ্গ, দুই দিনের দুনিয়া, শিকল, দ্য সাইলেন্স, সাবরিনা, এই মুহূর্তে, বলি, ব্ল্যাকমেইল, ইনফিনিটি, ঊনিশ বিশ, ওভার ট্রাম, তীরন্দাজ, ইন্টার্ণশিপ প্রভৃতি। উল্লিখিত সিরিজের অধিকাংশ সিরিজ- সিরিয়াল কিলিং, নেশা ও মাদকপাচার, মানবপাচার, উগ্র সন্ত্রাসবাদ, যৌনতা, পরকীয়া প্রেম প্রভৃতির সত্যমূলক ঘটনা অবলম্বনে থ্রিলারধর্মী নির্মাণ প্রচেষ্টা। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে চলমান প্রায় একইধর্মী ওয়েব সিরিজ দেখতে দেখতে দর্শক অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পরেছে! ওয়েব সিরিজের এই অস্থির বাস্তবতায় হইচই এর ওয়েব প্ল্যাটফর্মে ০৮ মার্চ ২০২৩ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ সিরিজটি রিলিজ দেয়া হয়েছে এবং ২৪ মার্চ ২০২৩-এ পরবর্তী চার পর্ব রিলিজ দেয়া হয়েছে। সিরিজটি ইন্টারনেট ভিত্তিক নিউ-মিডিয়া দর্শকদের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছে। হালআমলের নেট দুনিয়ার বহুল আলোচিত ওটিটি সিরিজি নিয়ে ডিসকোর্স- ওয়েব সিরিজ পর্যালোচনা ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল: অস্তিত্বের শেকড় অনুসন্ধানী আখ্যানচিত্র’।
 
‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ কলকাতার চিত্রনাট্যকার, অধ্যাপক ও লেখক কল্লোল লাহিড়ীর দ্বিতীয় উপন্যাস। দুই বাংলার তরুণ পাঠকের কাছে কল্লোল লাহিড়ীর এই উপন্যাস বেশ সমাদৃত হয়েছে। লেখক অনলাইনে নিজের ব্লগে পর্যায়ক্রমে এই উপন্যাসটি লেখেন এবং পাঠকমহল থেকে তুমুল সাড়া লাভ করেন। পরবর্তীতে ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ গ্রন্থাকারে ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়। কল্লোল লাহিড়ী’র এই জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ উপন্যাস অবলম্বনে ওয়েব সিরিজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য। একশ সত্তর পৃষ্ঠার উপন্যাসের গল্প ও চরিত্রকে সম্পাদনা করে ওয়েব সিরিজ উপযোগী করে সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচনা করেন তৃষা নন্দী ও পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য দু’জন মিলে। ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ ওয়েব সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইন্দুবালা মল্লিক। বাঙলা ও বাঙালি, শৈশব স্মৃতিকথা, কৈশোরপ্রেম, পূর্ব বাংলার গ্রামের পরিবার-প্রতিবেশ, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, সত্তরের নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ যুদ্ধসময়, মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন এসবের নন-লিনিয়ার গল্পকথনে অতীত-বর্তমান মিলেমিশে ইন্দুবালার জীবনসংগ্রাম শক্তিশালী চলচ্চিত্রিক ভাষায় চিত্রিত হয়েছে তাঁর ভাতের হোটেলকে কেন্দ্র করে! খাবারে হোটেলের মজাদার সব খাবার তৈরির নেপথ্যের গল্পের ছলে ইন্দুবালার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘাত-প্রতিঘাত নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রায় দু’শ মিনিট ব্যাপ্তিরসময়ে বেঁধে পুরো প্রযোজনাকে আটপর্বে বিভাজিত করে ক্যামেরার লেন্সে অনুবাদ করেছেন পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য।

পূর্ববাংলার খুলনার কলাপোতা গ্রামের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের এক উচ্ছল-চঞ্চল মেয়ে ইন্দুবালা। হঠাৎ করেই কলকাতা শহরের মাস্টার রতনলাল মল্লিকের সাথে ইন্দুবালার বিয়ে ঠিক করে ফেলেন বাবা ব্রজমোহন। পরিবার ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, কপোতাক্ষের তীর ছেড়ে, জীবনের প্রথম প্রেম মনিরুলকে ছেড়ে তার ঠাঁই হয় কলকাতা শহরের ১৪/২, ছেনু মিত্র লেন এর দোতলা বাড়ীতে। বিত্তবানের খোলসে অভাব-অনটনের সংসার, মাতাল-কামুক-নেশাতুর-জুয়ামত্ত স্বামী রতনলাল মল্লিকের দাম্পত্য নিগৃহীত আচরণে ক্রমশ ক্ষয় হতে থাকে কলাপোতার  ইন্দুবালা। জলের মাছকে ডাঙ্গায় তুললে যেমনটি ঘটে; ইন্দুবালার ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেছে। কলকাতার ইট-পাথরের নগরজীবনের নিষ্পেষণ, সংসারজীবনের ব্যক্তিগত বেদনা, ফেলে আসা সোনালী অতীত, সন্তানের ভবিষ্যত, সত্তরের নকশাল বিপ্লব, পরিবার হারানোর গল্প, সন্তানদের সাথে দূরত্ব, নিজের শেকড় আঁকড়ে রাখার চেষ্টা,  মুক্তিযুদ্ধে মা-ভাই, মনিরুলকে হারানোর বেদনার ভীড়ে ইন্দুবালা নিজে হারিয়ে যান বারংবার। ক্ষয়িষ্ণু ইন্দুবালাকে টিকিয়ে রেখেছে তাঁর ভাতের হোটেল। ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ শুধুমাত্র একটি খাবারের দোকানে সীমাবদ্ধ থাকেনি; পুরো আখ্যানচিত্রে এটি একটি শক্তিশালী চরিত্র হয়ে ওঠেছে! ইন্দুবালা চরিত্রটি পাকা রাঁধুনী বা হোটেলের নারী খাবার ব্যবসায়ীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; তিনি হয়ে ওঠেছেন কমরেড ইন্দুবালা, তিনি হয়ে ওঠেছেন মুক্তিযোদ্ধা ইন্দুবালা, তিনি হয়ে ওঠেছেন একজন অকুতোভয় সাহসী জীবনযোদ্ধা। সিঙ্গেল মাদার হিসেবে প্রতিনিয়ত লড়াই সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে সকল অসুন্দরের বিপরীতে! ‘বাঙাল’ বলে যাকে কটাক্ষ করতেন তার শ্বাশুড়ি, তিনিই মেরুদণ্ড সোজা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন কলকাতা শহরে। মুক্তিসংগ্রামে সম্মুখ যুদ্ধই শুধু যুদ্ধ নয়, জনযুদ্ধে যাঁরা সম্মুখ যোদ্ধাদের সাহস দিয়ে, অন্ন দিয়ে, বাসস্থান দিয়ে, তথ্য দিয়ে, আশ্রয়-সহায়তা দিয়ে ও গোপনীয়তা রক্ষা করেন, তারাও খাঁটি দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। পাকহানাদার বাহিনী ইন্দুবালার পরিবারের মা-ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। যুদ্ধে স্বজন হারানোর বেদনায় বুকে পাথরচাপা দিয়ে আপদমস্তক তিনি হয়ে ওঠেন একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। স্বামী রতনলাল মল্লিকের অকাল প্রয়াণের পর সাদা থানশাড়িতে নতুন জীবন শুরু হয় ইন্দুবালার। সব হারানো ইন্দুবালাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল বিহারী নারী মাছবিক্রেতা লছমী। সেই থেকেই শুরু হয় ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। একদিনের জন্যও এই হোটেল ছেড়ে কোথাও যান নি ইন্দুবালা। এই হোটেল যে তাঁর প্রাণ! মানুষকে আহার করানোই যেন ইন্দুবালার একমাত্র ধর্ম। অতিথি সেবাই তিনি পরম ধর্ম জ্ঞান করেন। জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।  

গল্পটা ভাতের হোটেলের নয়! গল্পটা একজন শেকড়ছিন্ন মানুষের কষ্ট-বেদনার নীল ছোবলে দংশিত অভিজ্ঞ নারী পরিব্রাজক। ইন্দুবালা চরিত্রের মাধ্যমে তাঁর বেদনার না-বলা গোপন কথাগুলো আচারের বোয়াম থেকে ফ্ল্যাসব্যাকে বের করে আনেন নির্মাতা। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সেই অভিজ্ঞতার স্মৃতিকথায় ভ্রমণ করেন। দর্শক ইন্দুবালার ছায়াসঙ্গী হয়ে গোপনে পা টিপে টিপে সেই অভিজ্ঞতার ভ্রমণসঙ্গী হয়- ফিরে যায় শৈশব কৈশোরের কলাপোতা গ্রামে, আসন্ন পূজায় মা দুর্গা প্রতীমার চোখ আঁকা দেখতে, ঝড়ের দিনে আম কুড়াতে বা মনিরুলকে চন্দ্রপুলি পিঠা খাওয়াতে। ইন্দুবালার দুঃখে দর্শক কাঁদে, ইন্দুবালার যুদ্ধের সময় দর্শক ইন্দুবালার পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়, নিঃসঙ্গতায় একাকীত্ব বরণ করে। হোটেলের যেসব রেসিপি প্রায় সবগুলোই ইন্দুবালার কলাপোতা গ্র্রামের শৈশব-কিশোর বয়সের অভিজ্ঞতালব্ধ ঠাম্মি আর মার কাছ থেকে শেখা। খাবারের নামগুলো অতিশয় লোভনীয়-বিউলির ডাল, কুমড়োর ছক্কা, চিংড়ির হলুদগালা ঝোল, কচুবাটা, আলুপোস্ত, আমড়ার চাটনি, আম তেলের রান্না, মালপোয়া, কচুবাটা। রান্না একটা শিল্প, সেই শিল্পকে যিনি সুনিপুণভাবে ধারণ করেন তিনিই তো প্রকৃত রন্ধনশিল্পী। ইন্দুবালার রন্ধনপ্রণালী শুধুমাত্র মসল্লা বা অন্যান্য উপাদান সর্বস্ব নয়; তাঁর রন্ধনকৌশলের স্বাদ নির্ভর করে স্মৃতিময় গল্পের ভালোবাসা থেকে; প্রতিটি রান্নার রেসিপি মূলত ইন্দুবালার জীবন মহাকাব্যের একেকটি অনুগল্প! ইন্দুবালা চরিত্রের মাধ্যমে নির্মাতা দেবালয় ভট্টাচার্য দর্শকদের বারংবার ভ্রমণ করিয়ে আনেন বর্তমান আর অতীতে। এই কলকাতার গল্প, এই ক্ষাণিক পরে মজাদার একটি খাবারের নেপথ্য গল্প শোনাবার ছলে নিয়ে নির্মাতা যাচ্ছেন স্বর্ণ স্মৃতিমাখা খুলনার কলাপোতা গ্রামে-যেখানে ইন্দুর সবাই ছিল, মা, বাবা, ভাই, ঠাম্মি, মনিরুল, স্বর্ণলতা, রিয়াজ সব প্রিয়মুখগুলো। চমৎকার করে নির্মাতা দেবালয় ভট্টাচার্য পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থের রূপাই-সাজু চরিত্রের সঙ্গে ইন্দু-মনিরুলের প্রেমময় চলচ্চিত্রিক মিথস্ক্রিয়া নির্মাণ করে পর্দায় হাজির করেছেন। আবার এসব ছেড়ে মুহুর্তেই স্ক্রিণে ভেসে আসছে ইন্দুবালার কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনের বৈবাহিক জীবনের মহাকষ্টের মহাখ্যান অথবা লছমি, ধনা, প্রদীপ, সুদীপ, কমরেড অলক আর ভাতের হোটেলঘেরা ব্যস্ততার বর্তমান জীবনচিত্র। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা; এপার বাংলা-ওপার বাংলা যেনো মিলে মিশে একাকার। তুমুল বৃষ্টিতে ছেলেবেলার আম কুড়ানোর, একাদশীর চন্দ্রপুলি বানানো আর স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে মনিরুলের বাঁশি শোনার প্রতীক্ষা যুগপৎ দৃশ্যায়ন সম্ভব হয়েছে চিত্রনাট্যের গল্পগাঁথুনীর শক্ত ভীতের কারণে। সত্তর বছরের বৃদ্ধ ইন্দুবালা রোজ তিনশ থেকে চারশ জনের রান্না নিজ হাতে করেন। এই রান্নাগুলোই বারবার তাকে নিয়ে যায় অতীতের নানা স্মৃতিতে। তিনি বেঁচে থাকেন রান্নার মধ্যদিয়ে তাঁর শৈশব-কৈশোরের আপন স্মৃতিমাখা নিজস্ব ভূবনে। ইন্দুবালা যখনই কিছু রাঁধতে বসেন, তখনি সেই রান্নাটা তিনি কীভাবে, কার কাছ থেকে শিখেছেন, ফ্ল্যাসব্যাকে সেই স্মৃতিগল্পে ভাসতে থাকেন। আর তাতেই তৈরি হয় অমৃত সব রান্নার রেসিপি। সময় আর বছর গড়াতে গড়াতে ১৪/২ ছেনু মিত্র লেন, কলকাতা-৭০০৯, কালেক্টর অফিসের গলি থেকে হালের ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম তাবৎ নিউমিডিয়ার মাধ্যমে জগতজুড়ে ছড়িয়েছে ইন্দুবালার রান্নার হাতযশ।

ওয়েব সিরিজের অষ্টম পর্বের শেষান্তে জেষ্ঠ্যপুত্র প্রদীপ মল্লিক মা ইন্দুবালাসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশে খুলনা জেলার মায়ের শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত গ্রাম কলাপোতায় পূজোর ছুটিতে ট্রেনে করো বেড়াতে যাবার সব আয়োজন সম্পন্ন করে। ইন্দুবালা সবার সাথে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ট্রেনে না চড়ে আকস্মিক কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন! তাঁর বুকের ভেতর হঠাৎ মোচড় দিয়ে জানান দেয়- তিনি নিজভূমে ফিরছেন পাসপোর্ট নিয়ে, ভিসা নিয়ে ট্যুরিস্ট হয়ে। তিনি ট্যুরিস্ট হয়ে নিজ গ্রাম কলাপোতায় না যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ফিরে আসেন ছেনু মিত্র লেনের বাড়িতে। রাতে লছমি-ইন্দুবালা কথপোকথনের মধ্যদিয়ে নির্মাতা অসাধারণ এক নাট্যিকমুহূর্ত সৃজন করেছেন। ইন্দুবালার কষ্টকথন দেশ-বিভাগের পর অথবা পরবর্তীতে যাঁরা নানাবিধ কারণে দেশান্তরিত হয়েছেন তাঁদের সকলের গল্প। প্রস্থান যেখানে চিরন্তন সত্য সেখানে একা থাকাই শ্রেয়তর। আমাদের সমাজে ইন্দুবালারা লড়াই করে; তাদের কাউকে প্রয়োজন হয়না। এখানে ইন্দুবালারা একাই বাঁচে; ইন্দুবালা দেশান্তরিত প্রতিটি মানুষের স্মৃতিমাখা প্রতীকী জাদুঘর! 

ইন্দুবালা চরিত্রে অভিনয় করেছেন কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেত্রী শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, লছমি চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্নেহা চট্টোপাধ্যায়, তরুণ প্রজন্মে প্রতিনিধিত্বকারী সঞ্চারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন অঙ্গনা রায়, মনিরুল চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেব দত্ত রাহা, ইন্দুবালার স্বামী রতনলাল মল্লিকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রতীক দত্ত,  ইন্দুবালার শাশুড়ী চরিত্রে অভিনয় করেছেন মিঠু চক্রবর্তী, ইন্দুবালার কনিষ্ঠ পুত্র প্রদীপ মল্লিকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, হোটেলের সার্বক্ষণিক সহায়তাকারী ধনঞ্জন চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেবপ্রতীম দাশগুপ্ত। শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের অসাধারণ অভিনয় ইন্দুবালা চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলেছেন। মধ্যবয়সী ও সত্তর বছরের প্রৌঢ় বয়সের ইন্দুবালার চরিত্রের চলন, অঙ্গভঙ্গি, হাবভাব, স্বর-প্রক্ষেপণে অনবদ্য দক্ষতার ছাপ রেখেছেন শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়। অভিনয় ক্ষমতাকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় শুভশ্রী এই ওয়েব সিরিজের প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইন্দুবালা চরিত্রের সাথে মিশে গিয়েছিলেন শুভশ্রী; আর তাতে করেই মধ্যবয়সী ও সত্তর বছরের প্রৌঢ় ইন্দুবালাকে অভিন্ন সত্ত্বায় দর্শক আপন করে নিয়েছে। লছমি চরিত্রে স্নেহা চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় ও মেকআপ অসাধারণ। লছমি চরিত্রকে পরিচালক অসাধারণ দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন। লছমির চরিত্রে স্নেহা চ্যাটার্জীর অভিনয় ম্যানারিজম, ভাষা, সারল্য সবকিছুর সম্মিলনে বিশ্বাসযোগ্যতার অনন্য সাধন করেছেন। মনিরুল, লছমি, ধনা ও অলক চরিত্রে অভিনয় ওয়েব সিরিজের অন্যতম প্রাণশক্তি।

থ্রিলার, সাব-থ্রিলার, সেমি-থ্রিলার, সাইকো-থ্রিলার, যৌন সুরসুরি প্রভৃতির কপি-পেস্ট সিরিজের বাইরে এসে এটি একটি বিশেষ প্রচেষ্টা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ এর শক্তি হলো ক্যামেরা লেন্সের সামনে ড্রামাটিক অভিনয় দক্ষতা। অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি, সাবলীল অভিনয়, চরিত্রানুগ মেকআপ ও ব্যতিক্রমী আবহসংগীতের সেরা সংমিশ্রণে নির্মিত হয়েছে এই সিরিজ। গান ও আবহসংগীত এই সিরিজের অনন্য এক সম্পদ। সম্পাদনা করেছেন সংলাপ ভৌমিক, সিনেমাটোগ্রাফার রম্যদ্বীপ সাহা, শিল্পনির্দেশনা তপন কুমার শেঠ, মেকআপ শিল্পী সোমনাথ কুণ্ডু, পোশাক পরিকল্পনা করেছেন সবনী দাস, মিউজিক ও আবহসংগীত করেছেন অমিত চ্যাটার্জি । সংগীত এই সিরিজে অন্যতম একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। প্রতিটা দৃশ্যকে একে-অপরের সাথে বেঁধে রাখে এই সিরিজের গানের কথা, সুর ও গায়কী। কাহিনী ও সঙ্গীতের অভূতপূর্ব মেলবন্ধনে গ্রন্থিত এই সিরিজ। নির্মাণ দক্ষতা, পরিমিতিবোধ, সংলাপ ও নন-লিনিয়ার গল্প কথনকৌশলে দর্শক মুগ্ধ। তরুণ দর্শক প্রজন্ম মনে করে- ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ ওটিটি প্ল্যাটফর্মের বাংলা কন্টেন্টের পুরো চেহারাই বদলে দিবে!

ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক, গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]