তানজীমউদ্দিনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাইলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশিত: ০৬:৩০ পিএম, ৬ মার্চ ২০২৩ সোমবার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তার বিরুদ্ধে অপমানের অভিযোগ এনে বিভাগের এহসান ধ্রুব নামে এক ছাত্রলীগ নেতার আত্মহত্যার চেষ্টাকে ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিবৃতি দিয়ে এ নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
সোমবার (৬ মার্চ) গণমাধ্যমে পাঠানো ওই বিবৃতিতে নেটওয়ার্কের ৫৩ সদস্য অনলাইন স্বাক্ষর করেছেন।
এতে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী এহসান ধ্রুবর আত্মহত্যাপ্রচেষ্টা ও শিক্ষক তানজীমউদ্দিন খানকে এজন্য সম্ভাব্য দায়ী করে আবর্তিত ঘটনাক্রম আমরা গত কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা অধ্যাপক তানজীমের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বোধ করছি। পুরো বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নীরবতাও পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে।’
‘সম্প্রতি শিক্ষার্থী ধ্রুব স্বপ্রণোদিতভাবে অধ্যাপক তানজীমের কাছে গিয়ে এক ছাত্রীর বিরুদ্ধে চারিত্রিক কলঙ্কারোপণের চেষ্টা করে। জনাব তানজীম তার কাছে সে সংক্রান্ত প্রমাণ চান। ধ্রুব যথাযথ প্রমাণ হাজির না করে অন্যান্য সহপাঠীদের সাক্ষী মানেন। পরে ২ মার্চ ক্লাসে তানজীম ক্লাসে ধ্রুবকে দাঁড় করিয়ে সহপাঠীদের নাম জানাতে বলেন। ধ্রুব নাম জানাতে রাজি না হলে তানজীম তাকে এ ধরনের গুজব ছড়ানো বন্ধ করতে ও সহপাঠীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে বারণ করেন।’
‘ক্লাস থেকে বের হয়ে অধ্যাপক তানজীমের কাছে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করলেও ক্লাসের সামনে তাকে অপমান করার জন্য তানজীমকে অভিযুক্ত করেন। তিনি হুমকি দেন যে, যদি তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন, তার জন্য অধ্যাপক তানজীমই দায়ী থাকবেন। এরপর তানজীমউদ্দিন তাকে নানাভাবে বোঝান যেন তিনি ওরকম কিছু না করেন। এরপরও ধ্রুব ফেসবুক স্ট্যাটাসে সুসইসাইড নোট লেখেন এবং আত্মহননের সিদ্ধান্তের পেছনে অধ্যাপক তানজীমকেই দায়ী করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্য হওয়ার কারণেই নাকি অধ্যাপক তানজীম তার বিরুদ্ধে বিরূপ হয়েছেন। কয়েক ঘণ্টা পরে, অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাকে উদ্ধার করা হয় এবং হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। স্বস্তির বিষয়, তিনি এখন শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন এবং চূড়ান্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শেষ অব্দি ঘটেনি।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘তবে ইতোমধ্যে ধ্রুবর ফেসবুকের বক্তব্যের কারণে ক্যাম্পাসে বিভ্রান্তি ছড়ায়, ছাত্রলীগের কিছু সদস্য মধ্যরাতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে ধ্রুবর পরিস্থিতির জন্য শিক্ষক তানজীমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করে। গণমাধ্যমে দেয়া কোনো কোনো ছাত্রলীগ নেতার বক্তব্য ও সামাজিক মাধ্যমে কারো কারো পোস্টের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক তানজীমের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও হুমকি ছড়িয়ে পড়ে।’
‘আমরা মনে করি, পুরো ঘটনায় অধ্যাপক তানজীমের যে ভূমিকা, তা যথাযথ ছিল এবং একজন সচেতন শিক্ষকের দায়িত্বই তিনি পালন করেছেন। একজন নারী শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে হয়রানি বন্ধ করতে একজন সচেতন শিক্ষকের যা করা প্রয়োজন তিনি ঠিক সে কাজটিই করেছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বিবৃতিতে ও বর্ণনায়ও অধ্যাপক তানজীমের ভূমিকাটি সঠিক ছিল বলেই প্রতিভাত হয়েছে। অধ্যাপক তানজীমের বক্তব্যে আমরা জেনেছি ধ্রুবর ছাত্রলীগসংশ্লিষ্টতা বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। বরং ধ্রুবই এই পরিচয়কে তার ইমেইলে সামনে আনেন এবং ঘটনাটিতে তার রাঙানো রাজনৈতিক পরিচয়ের জের ধরেই ছাত্রলীগের সদস্যরা অধ্যাপক তানজীমের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বিবৃতিতে উল্লেখ করে, ‘এখন প্রশ্ন হলো একজন শিক্ষার্থী কেন তার শিক্ষককে জড়িয়ে এমন একটি ভয়ংকর ঘটনা ঘটালেন? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের একটু আগের ঘটনা টেনে আনতে হবে। নানান সূত্রে জানা গেছে, ধ্রুব যার বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়াচ্ছিলেন, সেই মেয়েটির কাছে অতীতে প্রেমপ্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন এবং তিনি এই ঘটনার পূর্বে মেয়েটির বিরুদ্ধে আন্তঃব্যক্তিক পর্যায়ে ও সামাজিক মাধ্যমে কুৎসা ছড়িয়েছেন, যাকে পরিকল্পিত বাচিক নিপীড়ন হিসেবে দেখতে হবে। শিক্ষার্থীদের এ ধরনের সমস্যা নিরসনে শিক্ষকদের ন্যায়ের পক্ষেই অবস্থান নিতে হয়। অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান সবার সামনে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে উদ্যোগ নিয়ে ঠিক কাজটিই করেছেন। এই চেষ্টাকে কোনোভাবেই ‘র্যাগিং’ বলা চলে না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ মেনে শিক্ষকের এটাই যথোপযুক্ত আচরণ!’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্যরা প্রথমত, নারী শিক্ষার্থীর ওপর ধ্রুবর বাচিক ও মানসিক নিপীড়নের শাস্তি দাবি করছি। দ্বিতীয়ত এই ঘটনায় অধ্যাপক তানজীমের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি। তৃতীয়ত, আত্মহত্যার চেষ্টা করা শিক্ষার্থীর মানসিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তার মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উদ্যোগ নেয়ার জন্যও বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
‘পরিশেষে, আমরা আশা করছি যে প্রশাসন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে ঘটে যাওয়া এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সংবেদনশীলতার সঙ্গে পর্যালোচনা করবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবি, তারা যথাশিগগির অধ্যাপক তানজীমের নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন এবং নারী শিক্ষার্থীর আনা অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করবেন।’
বিবৃতিতে অনলাইন স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক গৌতম রায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খোরশেদ আলম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল ফজল, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা আক্তার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী ফরিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অর্পিতা শামস মিজান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক তাসমিয়াহ তাবাসসুম সাদিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের বার্ড কলেজের এক্সপেরিমেন্টাল হিউম্যানিটিজ বিভাগের ভিজিটিং অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক নাসির আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মার্জিয়া রহমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আর রাজী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, অধ্যাপক আইনুন নাহার, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, গীতি আরা নাসরীন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, সহকারী অধ্যাপক আলী সিদ্দিকী, সহকারী অধ্যাপক সায়মা আহমেদ, সহকারী অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম ও প্রভাষক সামিয়া জামান।