ফুটবল-ঈশ্বর সর্বপত্রিকায় বিরাজমান
রাজীব নন্দী, শিক্ষক ও গবেষক
প্রকাশিত: ০৬:০০ পিএম, ২৬ নভেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার আপডেট: ০১:৪১ পিএম, ৩০ নভেম্বর ২০২০ সোমবার
রাজীব নন্দী
ঈশ্বরে বিশ্বাসীরা বলেন, ‘ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজমান’। আজ বাক্যটিকে যদি একটু ঘুরিয়ে বলি- ‘ঈশ্বর সর্বপত্রিকায় বিরাজমান’। শুধু কি বিরাজমান? পুরো দেদীপ্যমান। আজ ২৬শে নভেম্বর। গত ২৫ নভেম্বর পুরো বিশ্বকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন মহাকালের ফুটবল কিংবদন্তী দিয়াগো ম্যারাডোনা। ফুটবলের ইশ্বর' যার খেতাব। আর্জেন্টাইন এই ফুটবলার দেশ-কাল-সীমানার গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছেন বৈশ্বিক। পুরো ফুটবল বিশ্ব তাকে ভালোবেসে ‘ঈশ্বর’ বলে ডেকেছ। তার হাত দুটোকে বলেছে, হ্যান্ডস অব গড। তাই তার বিদায়ে সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতা হয়ে উঠেছে ম্যারাডোনাময়। কিন্তু তারকা বলে কথা, নায়ক বলে কথা, তাঁর মৃত্যু তাই যতটা শোকের তার চেয়েও বেশি গৌরবকে স্মরণ করার। তাই কোথাও আজ ম্যারাডোনার শবদেহ বা শোকচ্ছবি নেই। আছে হাত উঁচিয়ে বিশ্বকাপ জয়ী ম্যারাডোনা বা ময়দানে লড়াকু ম্যারাডোনা। মনে মনে ভাবি, এটাই তো ঈশ্বরের প্রতিরূপ। এভাবেই কি থেকে যান ঈশ্বর তার আপন ভক্তদের মনে? আসুন দেখে নিই বাংলাদেশ, ভারত ও বৈশ্বিক সংবাদপত্রগুলোতে আজকের ম্যারাডোনা বন্দনা!
‘আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী’- এই কথাটি শতভাগ খাটে সংবাদপত্রের প্রথম পাতার জন্য। সংবাদপত্রের প্রথম পাতা যেন দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরটি মুখ্যভাবে তুলে ধরে। কিন্তু খবরের দুনিয়ায় মাঝে মাঝে দুনিয়াজোড়া কিছু খবর আসে, তখন সংবাদপত্রকে সাজতে হয় বিশেষভাবে। সেলিব্রেটির মৃত্যু, যুদ্ধ, অপ্রত্যাশিত বড় খবর কিংবা বৈশ্বিক কোন উৎসবে সংবাদপত্র সাজে সৃজনশীল রূপে। আজ বিশ্ব সাংবাদিকতার ইতিহাসে ম্যারাডোনা যুক্ত করলো নতুন একটি পাতা।
বাংলাদেশের জাতীয় দুটো ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার ও নিউ এইজ তাদের প্রথম পাতায় ম্যারাডোনার সংবাদ প্রকাশ করেছে। ডেইলি স্টার তাদের উপরের অংশে আট কলাম জুড়ে ছবিসহ Farewell, magiacl তার নিচে MARADONA লিখে শিরোনাম করেছে। নিউ এইজ এক কলামের সংবাদ প্রকাশ করেছে। সমকাল প্রথম পাতায় উপরের অংশে তিন কলাম জুড়ে “বিদায় ম্যারাডোনা” শিরোনামে হাত উঁচিয়ে রাখা একটি ছবির সাথে বক্স স্টোরি করেছে। ছবিটিতে উঁচিয়ে রাখা হাত বক্স পেরিয়ে পত্রিকার নেমপ্লেট ছুঁয়েছে। যেন মনে হয়, মহাতারকার উচিয়ে রাখা হাতকে কি আর বেঁধে রাখা যায়? বক্সের ভেতরে আর্জেন্টাইন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে যুবক বয়সী ছবিও ছাপানো হয়।
কালের কন্ঠের শিরোনাম “ফুটবল ইশ্বরের বিদায়”। তিন কলাম সমান ছবির সাথে আন্ডারলাইন শিরোনামসহ দুই কলামের নিউজ প্রথম পাতার একদম ভাঁজের উপরে। চার কলামের “মহাপ্রয়াণে মহানায়ক ম্যারাডোনা” লিখে স্প্রেডহেড শিরোনাম করেছে দেশের জাতীয় পত্রিকা যুগান্তর। তার উপরে ছোট অক্ষরে আইব্রো শিরোনাম। থাম্বস আপ দেখানো বড় রকমের একটি ছবিও পাতার মাঝামাঝিতে ছাপিয়েছে তারা। দৈনিক ইত্তেফাক প্রথম পাতার উপরের অংশের ডান পাশেই ছিয়াশির বিশ্বকাপ উচিয়ে ধরার ছবি সহকারে প্রায় দুই কলামের চেয়ে বড় অংশজুড়ে 'ফুটবল বরপুত্রের বিদায়' শিরোনামে উপস্থাপন করেছে। শিরোনামের নিচে কালো বাক্সের ভেতর সাব হেড শিরোনামও দেয়া হয়েছে। এদিকে লাল অক্ষরে স্প্রেডহেড শিরোনাম “বিদায় কিংবদন্তি ম্যারাডোনার” নিচে সাবহেড শিরোনামে চার কলামের সংবাদ প্রকাশ করে বাংলাদেশ প্রতিদিন। প্রথম আলো দেশের সর্বোচ্চ প্রকাশিত ও পাঠক সংখ্যার দৈনিক পত্রিকা। পত্রিকাটি তাদের প্রথম পাতার বা দিকের তিন কলাম জুড়েই ম্যারাডোনার সংবাদ ছাপায়। ‘বিদায় ফুটবল জাদুকর” লিখে স্প্রেডহেড শিরোনামের সাথে ছবি প্রকাশ করে প্রথম আলো। পেলে ও কাজী সালাউদ্দীনের দুটি বক্তব্যকে উদ্ধৃতি করে আলাদা দুটো এক কলামের সংবাদও ছাপিয়েছে পত্রিকাটি।
এদিকে “ঈশ্বর, ফুটবল, ভালবাসা” ছয় কলামের বড় শিরোনাম করেছে ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা। ভাঁজের নিচের অংশসহ প্রথম পাতার বিশাল অংশজুড়েই তারা দিয়াগোর ছবি ও সংবাদ প্রকাশ করেছে। ‘আচমকা হৃদরোগে বিদায় মারাদোনার’ এবং ‘বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন’ এমন দুটো আলাদা শিরোনামসহ খবর আছে এতে। পশ্চিমবঙ্গের আরেকটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ‘সংবাদ প্রতিদিন’ অনেকটা ভিন্ন ও চমৎকারভাবে সাজিয়েছে প্রথম পাতা। সর্বপ্রথম পত্রিকার নামের বাম পাশের ইয়ারে তার ছবিসহ আজ শহরে মারাদোনা লিখেন আর ডানের ইয়ারে তার ছবি দেয়া হয়। ঈশ্বর সমীপে ‘ঈশ্বর’ এই শিরোনামে ব্যানার হেডলাইন করেছেন তারা। সাথে নিচে পুরো আট কলাম জুড়ে সাবহেড। এর বাইরে পুরো পাতায় অসংখ্য শিরোনামের সাথে তার জীবনের ভিন্ন সব অধ্যায়ের ছবিসহ বক্স স্টোরিসহ সংবাদ প্রকাশিত হয়।
‘এই সময়’ পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক আকারে প্রকাশিত সংবাদপত্র। ১০ নম্বর জার্সি গায়ে ইশ্বর পানে চেয়ে আছেন এমন সাদা কালো একটি আট কলাম সমান ছবির সাথে “রইল ফুটবল,সাঙ্গ রূপকথা” শিরোনাম করে তারা। পত্রিকার প্রথম পাতার ফোল্ডের উপরের পুরোটা জায়গা নিয়েই ম্যারাডোনার সংবাদ ও ৮৬’র বিশ্বকাপে চুমু খাওয়ার ছবি আছে এতে। ‘দ্যা নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ নামের ভারতীয় ইংরেজি পত্রিকা তাদের নামের ডান পাশের ইয়ারেই ম্যারাডোনার ছবি প্রকাশ করে। ফ্লাশ লেফট শিরোনামের সাথে সংবাদ ছাপায় তারা। দৈনিক জাগরণ তাদের প্রথম পাতার ফোল্ডের একদম নিচের অংশে দুই কলামের সংবাদ প্রকাশ করে শিরোনাম করেছে- ঈশ্বরের কাছে 'হ্যান্ড অব গড'। রাজস্থান পত্রিকা এক কলামের বক্স স্টোরি করে আর সেখানে ম্যারাডোনার ছবি সহকারে শিরোনাম করেন 'হ্যান্ড অব গড' এখন ঈশ্বরের কাছে।
‘লা ইকুইপে’ (L’Équipe) হেডলাইন করেছে “God is dead”, যেন কোনও মহানায়কের বিদায়ের সমতুল্য। ‘ডেইলি স্টার’ ম্যারাডোনার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের বিশেষ মুহুর্তের ছবি ছাপিয়েছে। সেই ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিল্টনের উপরে উঠে যাওয়ার একটি ছবি, যেই ছবিতে ভাগ্যের চক্করে "খলনায়ক" আজকের এই নায়ক। মারাদোনার মুষ্টিবদ্ধ হাত ব্যবহার করে শিরোনামের পাশাপাশি ফাঁকা জালে বলের ছবিও ব্যবহার করা হয়েছে। স্টারের উপ-শিরোনাম " Maradona in the hands of God”- বৈশ্বিক এই ফ্রন্টপেইজগুলোতে মারাদোনাকে "বীর, খলনায়ক, একটি প্রতারণা এবং একটি প্রতিভা" এরকম মিশ্র পরিচয় দেয়া হয়েছে।
দি সান করেছে “England’s World Cup nemesis and one of the all-time greats”! এটি ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপের নেমেসিস! রিপোর্টে বলা হয়েছে, ম্যারাডোনাকে তার প্রাইমে সাক্ষী করার জন্য যথেষ্ট ভাগ্যবান আমরা, তার কোনও ত্রুটি তার প্রতিভা থেকে বিরত করতে পারে নি। মেট্রোও একই পথ ধরেছে। ডেইলি টেলিগ্রাফ এবং টাইমস উভয়ই ম্যারাডোনাকে তার সবচেয়ে গৌরবময় সময়কে চিত্রিত করেছে।
কোভিডের কারণে ভারী অর্থনৈতিক ধাক্কার খবরের পাশে প্রথম পৃষ্ঠার রিপোর্টে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের ট্রফি উর্ধে তুলে ধরা আর্জেন্টিনার সতীর্থদের কাঁধে মারাদোনাকে দেখা যাচ্ছে। ইনডিপেনডেন্ট লিখেছে “Maradona, football’s flawed genius” (ম্যারাডোনা, ফুটবলের ত্রুটিযুক্ত প্রতিভা)।
আসলেই তো, সোনায় কি খাঁদ থাকে না? গার্ডিয়ানে ম্যারাডোনার মুখ, আকাশের দিকে চোখ বন্ধ ভঙ্গিমায়। পেলের বেদনার্থ শোকবার্তা আছে এখানে "আমি একটি দুর্দান্ত বন্ধুকে হারিয়েছি এবং বিশ্ব একটি কিংবদন্তি হারিয়েছে (I lost a great friend and the world has lost a legend.)"।
এদিকে স্পেনের মাটিতে ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার জার্সিতে ম্যারাডোনার ছবির পাশের "God is dead" শিরোনামের প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম করেছে ফরাসি সংবাদপত্র L’Équipe! এদিকে Libération পত্রিকা একটি সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছে। ছোট্ট এক-শিরোনামে- “Heavenly”। কালো চুলের সেই মারাদোনা বুয়েনস আইরেসের ১০ নম্বরের জার্সি পরে এগিয়ে যাচ্ছেন বীরের মতো।
ইতালির জনপ্রিয় স্পোর্টস নিউজ পেপার Gazzetta ব্যানার শিরোনামটি চমৎকার। “For Number 10 Maradona, football cries more than everyone” (দশ নম্বর ম্যারাডোনার জন্য, ফুটবল সবার চেয়ে বেশি কাঁদে)। পত্রিকাটিও যথারীতি পেলেকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘আমি ম্যারাডোনার সাথে স্বর্গে ফুটবল খেলব (will play football with Maradona in heaven)’।
আর্জেন্টিনার আরেকজন বিশ্বসেরা ফুটবলার হিসাবে বিবেচিত লিওনেল মেসিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, “ম্যারাডোনার বিদায় হয়নি, তিনি চিরন্তন (Maradona isn’t gone. He is eternal)। ইতালির অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা Corriere Della লিখেছে- "বিদায় ডিয়েগো: আপনি ফুটবল (Goodbye Diego: you ARE football.)।" রোমান দৈনিক Il Messaggero ম্যারাডোনাকে যা লিখেছেন, এরপর আর এই লেখাকে টেনে রাবারের মত বড় করার দরকার নেই- A king of football with a Neapolitan heart!
পৃথিবীর বুকে দুটো বিশ্বযুদ্ধ সাংবাদিকতার জগতে গভীর প্রভাব ফেলেছিলো। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংবাদ পরিবেশন পদ্ধতিতে এসেছিলো দ্রুত পরিবর্তন। মানুষের কাছে দ্রুত যুদ্ধের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ খবরটি পৌঁছে দেবার প্রয়োজন থেকে ইউরোপ আমেরিকার কাগজে দেখা দিয়েছিল পৃষ্ঠসজ্জার নানান বৈচিত্র্য। সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠার একটিই নিয়ম, সে কোন নিয়ম মানবে না। প্রতিদিন নিত্য নতুন রূপে, প্রথাভাঙ্গা স্টাইলে সে হাজির হবে পাঠকের দরবারে। নয়তো প্রতিদিনের পত্রিকা দেখতে একঘেঁয়ে ক্লান্তিকর হবে পাঠকের চোখে। আর যদি ঘটে বিশেষ কিছু তাহলে কে কিভাবে সেই ইস্যু তুলে ধরবে, সেটি হয়ে উঠে পত্রিকা থেকে পত্রিকার সৃজনশীলতার লড়াই। আজ সেই লড়াইয়ের উপলক্ষ- দিয়াগো ম্যারাডোনা! বিশ্বজুড়ে পত্রিকায় আজ ফুটবল ঈশ্বর বিরাজমান। শুধু কি বিরাজমান? না। কোথাও তিনি দণ্ডায়মান, কোথায় দেদীপ্যমান। কোথাও তার বজ্রমুষ্টিবদ্ধ হাত। যে হাত, ঈশ্বরের, যে হাত চিরভাস্বর। কোন অজুহাতেই যে হাতকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
লেখক: রাজীব নন্দী
সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ ভারতের গণমাধ্যম গবেষকদের প্ল্যাটফর্ম ‘ইন্দো-বাংলা মিডিয়া এডুকেটর্স নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক’ এবং সংবাদপত্রের প্রথম পাতার দৃশ্যগত উপস্থাপনার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন। ইমেইল: [email protected]
কৃতজ্ঞতা: এই নিবন্ধের তথ্য বিশ্লেষণ ও সংবাদপত্রের প্রথম পাতা গ্রাফিক্স ডিজাইনে সহযোগিতা করেছেন লেখকের গবেষণা সহকারী, চবি যোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সম্মান চূড়ান্ত পর্বের শিক্ষার্থী জাওয়াদ হোসাইন। এছাড়াও ভারতীয় পত্রিকাগুলো সংগ্রহের সুযোগ দেয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়া স্কলার প্রফেসর ড. উমা শঙ্কর পাণ্ডে, সাদ্দাম হোসেন এবং কলকাতার সাংবাদিক প্রীতিকা দত্তের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। স্প্যানিস ও বৈশ্বিক কিছু সংবাদপত্রের ফ্রন্ট পেইজ শেয়ার করার জন্য লেখক সুইডেনের ইয়ংশেপিং ইউনিভার্সিটির এলামনাই, লেখকের স্পেনিশ সহপাঠী মার পাকপ’র প্রতি উষ্ণ আন্তরিতা জানাচ্ছেন।