বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ
উইলিয়াম পেসেক, ব্লুমবার্গ কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৪:৩২ পিএম, ২৬ নভেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার আপডেট: ০১:৪৩ পিএম, ৩০ নভেম্বর ২০২০ সোমবার
অন্য সব উন্নয়নশীল দেশ যখন কোভিড-১৯ এ ধুঁকছে, বাংলাদেশ সেখানে বেশ ব্যতিক্রম। এই যেমন, গত মে মাসে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি অচল হয়ে যাবে বলে ভাবা হচ্ছিল খুব সঙ্গত কারণেই। এ অঞ্চলের ঘনবসতিপূর্ণ শহর, সেকেলে স্বাস্থ্যসুরক্ষা পদ্ধতি আর মহামারীর জন্য অপ্রস্তুত সরকারব্যবস্থা – সব মিলিয়ে মহাবিপর্যয় যে হবে তা সবাই ধরেই নিচ্ছিলো।
কিন্তু অবাক করে দিলো বাংলাদেশ। সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে এখনো পর্যন্ত ৬৫২৪ জন মারা গেছেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। তবুও সেটা কিন্তু আমার শহর নিউ ইয়র্কের কুইন্সের চেয়ে প্রায় ১০০০ কম। শুধু তাই না, এ বছর আশা করা হচ্ছে যে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে ৪ শতাংশের বেশি যা পার্শ্ববর্তী বৃহৎ বাণিজ্য শক্তি ভারতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গেও তুলনায় আসছে।
গত মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এর পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিলো ভারতের চেয়ে বেশি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যেখানে ব্যর্থ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে ততটাই সফল। বিগত ১১ বছরে এতোটা উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দেশকে নিয়ে এগিয়েছেন যে এখন আর হেনরি কিসিঞ্জারের মতো বাংলাদেশকে কেউ তলাবিহীন ঝুড়ি বলার সাহস করে না।
২০১৭ সাল থেকে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাপিয়ে দেয়া বিভিন্ন শুল্কের কারণে আসলে ভিয়েতনাম বা এরকম কিছু দেশ বাদে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এ দেশের তৈরি পোশাক খাতকে সমুন্নত রেখেছে। ফলে, এখানকার স্বল্প মজুরীর অর্থনীতি হয়ে উঠেছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আকর্ষণের জায়গা। যেমন, আমরা খেয়াল করলাম জাপানী জায়ান্ট ‘ফাস্ট রিটেইলিং’ এর এগিয়ে আসা। তাদের ব্র্যান্ড ‘ইউনিকলো’ হয়ে উঠলো বাংলাদেশে এক বড় বিনিয়োগকারী।
তবে এটি কেবল শুরু মাত্র। ভবিষ্যতে আরও সাবধানে এগোতে হবে সফলতা ধরে রাখার জন্য। কারন, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি অনেক অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি এই অগ্রগতি ধরে রাখতে পারেন, দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন করেন, তাহলে আজকের মাত্র ১৯০০ ডলার থেকে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে অনেকগুণ।
বলা মুশকিল, কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ধাপে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইন্ডিয়ার মতো দেশগুলোর অর্থনীতি আরো কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও চীন ২ শতাংশের মতো বৃদ্ধি নিয়ে কিছুটা এগিয়ে যাচ্ছে, তাও আশানুরূপ নয়।
আমার দৃষ্টিতে ৪টি উপায় তুলে ধরছি যেগুলো অনুসরণ করলে বাংলাদেশ দ্রুত মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে এবং ইউনিকলো’র মত আরো বড় বড় প্রতিষ্ঠান এখানে ব্যবসা করতে আসবে।
এক. প্রথমে যেটি করতে হবে তা হলো “ইজ অব ডুইং বিজনেস” এর স্কোর উন্নত করা অর্থাৎ সহজে ব্যবসা করতে পারার সূচকে দেশের অবস্থানকে উপরে তুলতে হবে। কারণটা বোঝা কঠিন নয়। বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সিইও’রা পর্যন্ত বলেছেন তাদের পছন্দের জায়গা ভিয়েতনাম। কারণ, সেখানে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য নেই, এমনকি রেগুলেটররাও জটিল নীতিমালা এড়িয়ে সহজভাবে কাজ সম্পন্ন করতে সহায়তা করেন। এজন্যেই ভিয়েতনাম এখন বিশ্বব্যাংকের বিজনেস এনভায়রনমেন্ট টেবিল-এ ৭০ তম স্থানে রয়েছে যেখানে বাংলাদেশ ১৬৮ তম। ক্যামেরুন কিংবা মায়ানমারের মতো দেশের অবস্থানে থেকে লাভ নেই, কারণ এভাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের সর্বত্র বিস্তৃত ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেছেন, ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নও করতে হবে। এটি চ্যালেঞ্জিং কিন্তু স্বচ্ছতা, সততা আর দক্ষতার সাথে কাজ করলে সফলতা অবশ্যই আসবে।
দুই. আর্থিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদিও ভালো উদ্দেশে এ বছরের শুরুর দিকে নিম্নমুখী ব্যাংক সেক্টরকে চাঙ্গা করতে ৯% সুদে লোন চালু করেছিলেন কেনিয়ার উদাহরণ অনুসরণ করে, তা আদতে কোনো কাজে আসেনি। কারণ, আগে থেকেই ঋণখেলাপী সমস্যায় জর্জরিত ছিলো পুরো ব্যাংকিং সেক্টর।
জুন পর্যন্ত নন-পারফর্মিং লোন বা খেলাপী ঋণের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে যা ছিলো সমগ্র ঋণের ৯.২ শতাংশ। তবে সুখবর হ'ল- শেখ হাসিনার সরকার কর্পোরেট বন্ড মার্কেট তৈরিতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। এটি হয়ে গেলে ব্যাংক অর্থায়নের উপর কোম্পানিগুলোর নির্ভরতা কমবে। তবে বাংলাদেশ যদি ভিয়েতনামের মতো অবস্থানে আসতে চায়, আরও দ্রুত এবং জরুরী ভিত্তিতে কাজটিকে এগিয়ে নিতে হবে।
তিন. মানবসম্পদ উন্নয়নে বড় বিনিয়োগ করতে হবে। উপজাতি ও গোত্র সংঘাত যেখানে পাকিস্তান ও ভারতে উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হয়েও তা থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছে। এমনকি বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর লৈঙ্গিক সমতার সূচকে জাপানের চেয়ে ৭১ ধাপ এগিয়ে, ভিয়েতনাম এর চেয়ে ৩৭ ধাপ এবং ভারতের চেয়ে ৬২ ধাপ এগিয়ে।
যে কার্যাদেশগুলো চীন বা ভারতের হাতছাড়া হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের সুযোগ রয়েছে। এর জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট পরিমাণ ব্যয় করতে হবে। করোনাকালে ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘বিগ উইনার’ হয়ে ওঠার মূল কারণ হ'ল এটি অন্যান্য সফল এশীয় দেশগুলোর পথ অনুসরণ করেছে এবং শ্রমশক্তিকে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ যদিও আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে চলেছে, মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বাড়ালে উন্নয়নের গতি আরো বাড়বে।
চার. অর্থনীতিকে ডিজিটালাইজ করতে হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে, করোনাভাইরাস সবকিছু বদলে দেয়ার আগে, আমি প্রায় পাঁচ কোটি গ্রাহকের বিশ্বস্ত মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বিকাশ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও কামাল কাদীরের সাথে একদিন সময় কাটিয়েছিলাম। এতোবড় প্রতিষ্ঠানের অংশীদাররাও অনেক বড়, যেমন- বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন এবং জ্যাক মা'র অ্যান্ট গ্রুপ।
কামাল কাদীর এবং তার প্রতিষ্ঠান বিকাশকে যেমনটা অনুপ্রেরণাদায়ক জায়গায় দেখলাম তা যেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটা অগ্রসরমান জাতির ডিজিটালাইজেশন উদ্যোগের ফসল। এই বিকাশ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাইরে থাকা দেশের ৫০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যাকে দ্রুতই আর্থিক নেটওয়ার্কের ভেতরে নিয়ে আসছে। এ অগ্রযাত্রা যেন আভাস দিচ্ছে ভারতই শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র পরাশক্তি নয়, সম্ভাবনা আছে অন্যদেরও।
(লেখক উইলিয়াম পেসেক প্রখ্যাত এবং একাধিক পুরষ্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক। তিনি ব্যারন ও ব্লুমবার্গের কলামিস্ট ছিলেন এবং "জাপানাইজেশন: হোয়াট দ্য ওয়ার্ল্ড ক্যান লার্ন ফ্রম জাপান’স লস্ট ডেকেডস" বই এর লেখক। নিক্কি এশিয়া-তে রিভিউ আর্টিকেল এবং অন্যান্য অনেক কাজের জন্য ‘সোসাইটি অব পাবলিশার্স ইন এশিয়া’ তাকে ২০১৮ সালে পুরষ্কৃত করে।)