বিশ্বব্যাংকের ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স-২০২২’ ও বাংলাদেশ
জিয়াউর রহমান, পিএমপি
প্রকাশিত: ১০:৩৬ পিএম, ১৮ নভেম্বর ২০২২ শুক্রবার
বর্তমান বিশ্বের সকল সরকার কয়ক দশক ধরে পাবলিক সেক্টরের আধুনিকীকরণের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপ (WBG) পাবলিক সেক্টরে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার একটি বড় অংশীদার কেননা ১৯৮০ সাল থেকে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সদস্য দেশগুলির ডিজিটাল রূপান্তর যাত্রাকে সহজতর করার জন্য বিশ্বব্যাংক প্রযুক্তি সহয়তাসহ সংস্কারের জন্য অর্থায়ন করে যাচ্ছে। পাবলিক সেক্টরের সংস্কারগুলির সর্বশেষ অবস্থানকে সকলের মাঝে উপস্থাপন করার জন্য বিশ্বব্যাংক গ্রুপ- ২০১৯ সালে ‘গভটেক’ উদ্যোগ চালু করেছে। ‘গভটেক’ এর মূল লক্ষ্য হল নতুন ডিজিটাল ট্রান্সমিশন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধি , নাগরিক পরিষেবা প্রদানের সুযোগ বৃদ্ধি ও সেবার গুণগত মান উন্নত করা, সরকারের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতি হ্রাস এবং সরকারের আধুনিকায়ন করতে সহায়তা করা।
GovTech Maturity Index (GTMI) বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রণিত ও পরিচালিত একটি বৈশ্বিক ইনডেক্স যা পাবলিক সেক্টরের আধুনিকরণ, সরকারের ডিজিটাল উদ্যোগ এবং নাগরিক বান্ধব বিভিন্ন ডিজিটাল সেবা সম্পর্কিত বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স’ (জিটিএমআই) এর ক্ষেত্রে ৪টি বিষয়কে প্রধান্য দেওয়া হয় যথা টেকনোলজি, কৌশল, ইন্টারঅপারোবিলিটি এবং উদ্ভাবন। ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স’ ( জিটিএমআই) এ মূলত সরকারি বিভিন্ন ডিজিটাল সেবা ও কৌশল, সহজে প্রদানকৃত নাগরিক সেবা, নাগরিকদের মতামত প্রদান, সেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রযুক্তিগত কৌশল ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স’ ( জিটিএমআই) এ ৪৮টি সূচকের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং এর মাধ্যমে একটি দেশের অবস্থান নির্ণয় করা হয়। বর্তমানে বিশ্বঅর্থনীতির ১৯৮টি দেশ এই ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স’ (জিটিএমআই) এর আওতাধীন রয়েছে।
‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স’ (জিটিএমআই) ১৯৮টি দেশের ৪৮টি ইনডিকেটর এর মাধ্যমে চারটি বিষয়ের ভিত্তিতে ডাটা সংগ্রহ করা হয়। এগুলো হচ্ছেঃ ১। কোর গভর্নমেন্ট সিস্টেমস ইনডেক্সের (সিজিএসআই) যেখানে ইনডিকেটর ১৫টি , ২। পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারি ইনডেক্সের (পিএসডিআই) যেখানে ইনডিকেটর ৬টি , ৩। ডিজিটাল সিটিজেন এনগেজমেন্ট ইনডেক্সের (ডিসিইআই) যেখানে ইনডিকেটর ১২টি এবং ৪। গভটেক এনাবলার্স ইনডেক্সের (জিটিইআই) যেখানে ইনডিকেটর ১৫টি ।
অনলাইনে বিশ্বব্যাংক ২০২২ সালের ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স’ ( জিটিএমআই) -২০২২ এর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স’ ( জিটিএমআই) -২০২২ এর প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সরকারি খাতের বিভিন্ন সেবা প্রদানের ডিজিটাল রূপান্তরের চারটি প্রধান দিককে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এগুলো হলো- কোর গভর্নমেন্ট সিস্টেমস, পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারি, সিটিজেন এনগেজমেন্ট এবং গভটেক এনাবলার্স। বিশ্বব্যাংকের জিটিএমআই-২০২২ এ গভটেকের নতুন নতুন প্রবণতা, অনুশীলন ও সেগুলো বাস্তবায়নের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স’ ( জিটিএমআই) -২০২২ এর প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় যে, বিশ্বঅর্থনীতির ১৯৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ মোট ০.৮৪ স্কোর ( ১.০০ এর মধ্যে) নিয়ে জিটিএমআইর ‘ক্যাটাগরি এঃ ভেরি হাই গভর্নমেন্ট ম্যাচুরিটি’তে অবস্থান করেছে এবং ২৯তম স্থান অর্জন করেছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স’ (জিটিএমআই) এ ২য় অবস্থান করেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে আরো দেখা যায় যে, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স’ -২০২২ ( জিটিএমআই) এর ‘ক্যাটাগরি এঃ অর্থ্যাৎ ‘গভটেক লিডারস’ তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারের বিভিন্ন সেবা প্রদান এবং এসব সেবা গ্রহণে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করার ইকোসিস্টেম তৈরিতে নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে ‘ ভেরি হাই গভর্নমেন্ট ম্যাচুরিটিতে’ স্থান হয়েছে বাংলাদেশের। জিটিএমআই তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স এর ৪টি বিষয়ের ১। কোর গভর্নমেন্ট সিস্টেমস ইনডেক্সের (সিজিএসআই) এর স্কোর করেছে ০.৯১৫, ২। পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারি ইনডেক্সের (পিএসডিআই) স্কোর করেছে ০.৭০৭, ৩। ডিজিটাল সিটিজেন এনগেজমেন্ট ইনডেক্সের (ডিসিইআই) স্কোর করেছে ০.৮৩৭, এবং ৪। গভটেক এনাবলার্স ইনডেক্সের (জিটিইআই) স্কোর করেছে ০.৯২০। উল্লেখ্য যে, ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স- ২০২০’ এ বাংলাদেশের স্কোর ছিল ০.৭২ ( ১.০০ এর মধ্যে) এবং জিটিএমআইর ক্যাটাগরি বিঃ হাই গভটেক ম্যাচুরিটি গ্রুপে ছিল এবং বাংলাদেশ ৫৪তম অবস্থানে ছিল।
বিশ্বব্যাংকের জিটিএমআই-২০২২ রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নয়নের পিছনে কাজ করেছে মুলতঃ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং এটুআই। জিটিএমআই -২০২২ রিপোর্টিংয়ের অংশ হিসেবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর ও সংস্থার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও সার্বিক সমন্বয়ের জন্য একাধিক পরামর্শমূলক কর্মশালার আয়োজন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং এটুআই। পরবর্তীতে এটুআই সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য সমন্বিত করে বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠায় যার ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক জিটিএমআই-২০২২ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মতই বাংলাদেশের জন্যও বৈশ্বিক সূচকগুলোতে নিজের অবস্থার উন্নয়ন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি দেশের জন্য তাদের উন্নয়নের অগ্রগতি প্রদর্শন, নেটওয়ার্ক তৈরি, জাতীয় অগ্রাধিকার এবং SDG মূল্যায়ন করে তাদের নিজেদের অবস্থানকে এগিয়ে নিয়ে বৈশ্বিক সূচকে ভালো অবস্থান নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী। কেননা এই প্রয়োজনীয়তাই দেশের সার্বিক উন্নয়ন, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সাথে অগ্রগতি ও উন্নয়নের তুলনামূলক অবস্থানের পর্যালোচনা, ডেভেলপমেন্ট মডেলিঙয়ের জন্য দুর্বল এড়িয়াগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি সম্ভবপর করে তুলবে যা বিশ্ব র্যাংকিং এ দেশকে অনেক উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে এবং একই সাথে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে সহায়ক হবে। আশাকরি বর্তমান সরকারের নানাবিদ পদক্ষেপের কারণে আগামীতে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ‘গভটেক ম্যাচুরিটি ইনডেক্স’ এ বাংলাদেশ আরো ভাল করবে।
জিয়াউর রহমান, পিএমপি: উপসচিব ও কনসালটেন্ট, এটুআই প্রোগ্রাম।