মঙ্গলে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়
শেখ আনোয়ার
প্রকাশিত: ১১:২৪ এএম, ৪ নভেম্বর ২০২২ শুক্রবার আপডেট: ১১:২৭ এএম, ৪ নভেম্বর ২০২২ শুক্রবার
মঙ্গল একটি ছোটগ্রহ। কিন্তু সেখানে অনেক বড় ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। ‘লাল গ্রহ’ বলে পরিচিত মঙ্গলগ্রহ সম্পর্কে পৃথিবীতে আমরা যতটুকু জানি, বাস্তব অবস্থা তার চেয়ে ভিন্নতর। বিজ্ঞানীরা জানান, মঙ্গলগ্রহের বুকে প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ার গতি ঘন্টায় সাড়ে তিন’শ থেকে পাঁচ’শ ষাট কিলোমিটার বেগে চলে। সেখানে ভয়াবহ বন্যা হয়। বন্যায় সমতল ভ‚মি তলিয়ে বিশাল জলাবদ্ধতা এবং গভীর হ্রদের সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় মনোরম জলপ্রপাত। এক সময় জলীয় বাস্প হয়ে সেই পানি বায়ুমন্ডলে মিশে যায়। কিংবা মঙ্গলপৃষ্ঠ তা শুষে নেয়।
গবেষকরা জানান, পৃথিবীর তুলনায় মঙ্গল অনেকটা বেশিই ঠান্ডা। তাপমাত্রা মাইনাস ১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। তবে এই মারাত্মক ঠান্ডায় বরফ গলে পানি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। গবেষকরা আরও বলেন, মঙ্গলের অভিকর্ষ বল অনেক কম বলে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের যেহেতু বেশির ভাগটাই উড়ে গেছে। তাই তার বায়ুমন্ডল খুব পাতলা। ফলে, সূর্যের তাপে পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি তেতে ওঠে মঙ্গলের পিঠ। তাই মঙ্গলের পিঠে যদি সামান্যতম পানি থাকে, তা হলেও খুব তাড়াতাড়ি তা ওড়ে যাবে। সেই ওড়ে যাওয়া পানি উপরে উঠে জমে গিয়ে বরফ হয়। সেই বরফের টুকরোগুলো মঙ্গলের মেঘে ভেসে বেড়ায়। মেঘ ভারী হয়ে গেলে বরফের টুকরোগুলো ভোর রাতে নেমে আসতে শুরু করে মঙ্গলের বুকে।
আমেরিকান অ্যাষ্ট্রোনোমিক্যাল সোসাইটির প্লানেটরি ডিভিশনের এক বৈঠকে গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের প্রধান বিজ্ঞানী জনপার্ল বলেন, গবেষকরা মার্স অবজার্ভারের পাঠানো আলোকচিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। তারা বলছেন, লাল রঙের পাথর এবং মাটির ছবি সেখানে প্রচন্ড গতির ঝড়ো হাওয়া নির্দেশ করছে। যা গোটা গ্রহকে ঘিরে রয়েছে। এবং আগ্নেয়গিরির জ¦ালামুখে সৃষ্ট জালাভ‚মিতে গতিবেগ ঘন্টায় এক’শ মাইলেরও বেশি। যা কি না এক’শ ষাট কিলোমিটারেও বেশি। টিমের গবেষক ও বিজ্ঞানী মাইকেল সিমলিন বলেন, তবে মঙ্গলপৃষ্ঠে বন্যা কয়েক মাস স্থায়ী হয়। তিনি এ ধরনের একটি বন্যা বিশ্লেষণ করেছেন। মাইকেল সিমলিন বলেন, ওই বন্যায় জল¯্রােতের গতিবেগ ছিলো সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে টর্নেডো আইডার কারণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যার চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি। মঙ্গলের আগ্নেয় গিরির উঁচু জ¦ালামুখ থেকে পানির প্রবাহ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সমতল ভ‚মিকে জলাধারে পরিণত করে। পরে ক্রমান্বয়ে এই পানি বাষ্পীভ‚ত হয়ে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে মিশে যায়। অথবা মঙ্গলপৃষ্ট তা শুষে নেয়। মঙ্গলে এভাবে পানি জমে যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের সমান আয়তনের হ্রদ তৈরি হয়েছে। যার গভীরতা এক হাজার ছয়’শ ফুট। আবার হ্রদের পাড় ভেঙ্গে তিন’শ ফুট নিচু ভ‚মিতে পানি গড়িয়ে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে বলে গবেষকরা জানান। এই জলপ্রপাতের পানির প্রবাহের গতি ঘন্টায় এক’শ ত্রিশ মাইল।
কৃত্রিম উপগ্রহের যন্ত্রপাতির মাধ্যমে মঙ্গলের একটি ঝড় পর্যবেক্ষণ করে সম্প্রতি দেখা যায়, ঝড়ের গতিবেগ ছিলো ঘন্টায় তিন’শ ষাট মাইল অর্থাৎ পাঁচ’শ ষাট কিলোমিটার। যা ন্যূনতম শক্তির হারিকেনের চেয়ে পাঁচগুণ শক্তিশালী বলে গবেষকরা জানান। গবেষকরা এখনও মঙ্গলগ্রহের আবহাওয়া বোঝার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে এর ধুলোঝড়ের বিষয়ে তারা কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন অ্যাইলিস রিসার্সের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারী বিজ্ঞানী ক্লেয়ার নিউম্যান।
গবেষকরা জানান, কম বেশি সব গ্রহেই ঝড় হয়। মঙ্গল গ্রহে প্রায়ই ছোট ছোট ধুলোঝড় হয়। তবে এ ধুলোঝড় ছাড়াও সম্পূর্ণ মঙ্গল গ্রহে ঝড় হয়ে থাকে। এ ধরনের ভয়ানক ঝড় পৃথিবীতে সচরাচর দেখা যায় না। মঙ্গল গ্রহে বড় আকারের এ ঝড় হয়ে থাকে যখন গ্রহটি সূর্যের কাছাকাছি অবস্থানে থাকে। মঙ্গল গ্রহের ধুলোঝড় গ্রহটিকে প্রায় ঢেকে ফেলে। নিউম্যানের মতে, পৃথিবীর মতোই মঙ্গলগ্রহে ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে। তাই সেখানে ঝড় হয়। সাম্প্রতিক এক ঝড়ের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার একটি ল্যান্ডার চূড়ান্ত দফায় অবতরণ করতে পারেনি। মহাকাশ যান মার্স রিকনেসাস অরবিটার লাল গ্রহের বিষয়ে একটি এলার্ম পাঠায়। তাতে বলা হয় বড় রকমের একটি ধূলিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে মঙ্গল গ্রহে। পরে সত্যি সত্যি, এই ঝড় বয়ে যায় গ্রহটির পুরো অংশে। এরপর নাসা নতুন আরেকটি সৌরশক্তি চালিত অপর্চুনিটি মিশন পাঠায়। নাম ইনসাইট ল্যান্ডার। দেখা যায় তার উপর সাম্প্রতিক সময়ের ধুলোবালির গাঢ় আবরণ সৃষ্টি করেছে। এমনকি সৌর প্যানেলগুলোও প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এই মিশনও বুঝি বিফলে যায়! গবেষণার সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা তাদের মিশন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। যদিও ইনসাইট মিশনের ইতি ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ওই ল্যান্ডার এই ঝড়ের ভয়াবহতারই শিকার হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত বিশ্বাস করেন।
গবেষকদের মতে, মঙ্গলগ্রহে ছোটখাটো একটি স্থানীয় পর্যায়ের ধূলিঝড় এক বছর ধরে চলতে পারে। মঙ্গলের দক্ষিণ গোলার্ধে যখন গ্রীষ্মের শেষ হয়ে আসে তখন বড় মাপের ধূলিঝড় দেখা যায় সেখানে। মঙ্গলে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঝড়েরও গতি প্রকৃতি পরিবর্তন হয়। মঙ্গলের তাপমাত্রার তারতম্যের কারণেই এমন ঝড় হয়। এতে উত্তপ্ত পৃষ্ঠের ধূলো বালিকে বাতাস উড়িয়ে নিয়ে মঙ্গলের আবহাওয়া মন্ডলে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে করে আরও ঘন এবং আরও কালো। এমন ঝড় একটানা একমাস, একবছর পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে। স্পেস থেকে এই ঝড় স্পষ্ট বোঝা যায়। পৃথিবীর কোন ঝড়ই এতদিন স্থায়ী হয় না। বড় কথা হলো, পুরো পৃথিবী জুড়েও এমন কোন ভয়াবহ ঝড় হয়না। তাই পৃথিবীতে যেমন চাইলেই ঝড় হলে নিরাপদ স্থানে সড়ে যাওয়ার সময় ও সুযোগ থাকে। কিন্তু মঙ্গলে সেটা সম্ভব নয়।
বিজ্ঞানীরা জানান, মঙ্গলের পৃষ্ঠ মূলত ব্যসল্ট দ্বারা গঠিত। গবেষকরা নিশ্চিত প্রমাণ করেছেন- মঙ্গলের কিছু কিছু অংশে ব্যাসল্টের চেয়ে সিলিকা জাতীয় পদার্থ বেশি রয়েছে। অঞ্চলটি অনেকটা পৃথিবীর এন্ডোসাইট (এক ধরনের আগ্নেয় শীলা) জাতীয় পাথরের মত। এই পর্যবেক্ষণগুলোকে সিলিকা কাঁচের মাধ্যমেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। মঙ্গল পৃষ্ঠের অনেকটা অংশ সূক্ষè আয়রন অক্সাইড যৌগ দ্বারা আবৃত। ধূলিকণা নামে পরিচিত এই যৌগটি অনেকটা ট্যালকম পাউডারের মত। ধুলোর কারণে মঙ্গল গ্রহে ডাস্ট স্ট্রম বা ধূলি ঝড় হতে দেখা যায়। আর এই ঝড় একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং পুরো গ্রহ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই ধূলার ঝড় মঙ্গলের ভ‚পৃষ্ঠ থেকে বিশ থেকে ত্রিশ কিলোমিটার উচ্চতার হয়ে থাকে।
গবেষকরা সম্প্রতি কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে একটি ঝড়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেন। তাতে দেখা যায়, ছত্রিশ ঘন্টার ব্যবধানে ওই ঝড়টি ষাট বর্গমাইল বা দেড়’শ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। হাজার বর্গমাইল বা আড়াই হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে তার তান্ডব লীলা চালিয়েছে। গবেষকরা বলেন, সেটি ছিলো একটি ছোট ঝড়ের নমুনা। মঙ্গলের বায়ু মন্ডলে ধুলিকণার জন্যই সেখানে ঝড়গুলো এত তীব্র আকার ধারণ করে। সাসপেন্ডেট পার্টিকেলগুলো মঙ্গলপৃষ্ঠে সূর্যকিরণ প্রবেশে বাঁধার সৃষ্টি করে এবং এগুলো খুব দ্রুত উত্তপ্ত হয়। ফলে সুর্যোদয়ের ঠিক পরেই তাপমাত্রা বিশ ডিগ্র্রি সেলসিয়াস উপড়ে উঠে যায়। এই গুমোট পরিবেশ বা বদ্ধ তাপ ধীরে ধীরে আরও শক্তিশালী হয়ে হারিকেনে রূপান্তর ঘটে।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।