অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

জীবন্ত সাবমেরিন

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ০১:৫৭ পিএম, ১৪ অক্টোবর ২০২২ শুক্রবার   আপডেট: ০২:০১ পিএম, ১৪ অক্টোবর ২০২২ শুক্রবার

ঝিনুক, শামুক সম্প্রদায়ভুক্ত প্রাগৈতিহাসিক এই প্রাণীর নাম নটিলাস। চার’শ পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর আগে আপার ক্যামব্রিয়ান যুগে এই শ্রেণীর প্রাণীর প্রথম আবির্ভাব ঘটে পৃথিবীতে। তারপর থেকে সে সময়কার অগভীর সমুদ্রে এদের প্রাচুর্য লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়ে যায়। গবেষকরা বলেন, সাড়ে তিন হাজার রকমের নটিলাসে প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর প্রায় সম্পূর্ণ ঢাকা অগভীর সমুদ্রে পরিপূর্ণ ছিল। শুধু সংখ্যাই নয়, কিছু প্রজাতি ছিল আকারে বড়-অতিকায়। আরাকানসাস নদীর তলদেশে অধুনা লুপ্ত নটিলাসের ন’ফুট ব্যাসের অতিকায় খোলসের জীবাশ্ম তখনকার দিনের নটিলাসের আকৃতি ও বৃদ্ধির সাক্ষ্য দেয়। দেড়শ থেকে একশ’ আশি মিলিয়ন বছর আগে, জুরাসিক যুগের অবসানে ডাইনোসর, ব্রন্টোসারের মত অতিকায় সরীসৃপের অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নটিলাস সম্প্রদায়ের অধিকাংশ প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে। মাত্র আধা ডজনের কিছু কম প্রজাতির নটিলাস এখনও বেঁচে বর্তে রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের ফিলিপিন্স থেকে ফিজি অবধি। 

সমুদ্রের অনেক নীচে দু’হাজার ফিটেরও বেশি গভীরে থাকে এরা। যুগ যুগ ধরে এই অত্যাশ্চর্য প্রাণীর গঠনশৈলী ও বাহারী রঙ মানুষকে মুগ্ধ করেছে। কাব্যে, সাহিত্যে ও চিত্রায়নে আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করেছে। ছবি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন দেশের বিনোদন পত্রিকায়। নটিলাস শুধুমাত্র সুন্দর দর্শনীয় প্রাণীই নয় বৈজ্ঞানিক দিক থেকে যথেষ্ট মূল্যবান। এরা একশ’ আশি মিলিয়ন বছর আগেকার প্রাচীন পূর্বপুরুষদের মতোই একই রকম রয়ে গেছে। কোন পরিবর্তন হয়নি। অতীতের সঙ্গে জীবন্ত যোগসূত্র বজায় রেখেছে। কালের প্রভাবে অতীতের অতিকায় পূর্বপুরুষদের তুলনায় তাদের আকার কেবলমাত্র একটু ছোট হয়ে গেছে মাত্র। আট ইঞ্চির অতিকায় পূর্বপুরুষের এক সামান্য ভগ্নাংশ। কিন্তু তাদের আকৃতি ও প্রকৃতি একই রয়েছে। ডিজিটাল যুগে এসেও প্রাগৈতিহাসিক আমলের অনেক বিস্ময়কর তথ্যের সন্ধান দিচ্ছে জীবন্ত সাবমেরিন নটিলাস। 

সমুদ্রের গভীরে মোলাস্কা সম্প্রদায়ের প্রাণীদের বিশদ বিষয় অনুসন্ধান না করা পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এদের জীবন ও জীবনধারার বিষয়গুলো সম্পূর্ণভাবে জানতে পারবেন না। তবুও গবেষকদের মনে প্রশ্ন- এদের বংশবৃদ্ধি কোথায় ও কেমন করে হয়? জন্মের পর কি ঘটে? কতদিন বেঁচে থাকে? কেনই বা এদের সামান্য সংখ্যক প্রজাতি অসামান্য কাল অতিক্রম করে আজও বেঁচে রয়েছে? এরা কি শিকারী অথবা বর্জ্য পদার্থ শোধনকারী পরিবেশ সহায়ক প্রাণী? 

জুরাসিক যুগ থেকে নটিলাস এখনও তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে আসছে। সম্ভবত: ছদ্মবেশধারী চাপ নিরোধক খোলসের জন্য। যার মধ্যে প্রাণীটি নিজেকে গুটিয়ে রাখে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুভব করার জন্য শুধু  শুঁড়গুলো মাঝে মাঝে বের করে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের এই স¤প্রদায়ভুক্ত অন্য অনেক প্রজাতির প্রাণী নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারেনি। অবলুপ্তি ঘটেছে। আর তাদের শূন্যস্থান পূরণ করেছে সা¤প্রতিক কালের শ্রেণীভুক্ত কাট্ল ফিস্, স্কুইড, অক্টোপাস ও ভ্যামপায়ার স্কুইড শ্রেণীভুক্ত প্রাণীকুল। 

মাদার অফ পার্ল-এর প্রলেপে আচ্ছাদিত নটিলাসের খোলস প্রকৃতির এক অপূর্ব অবদান। এদের কমনীয় আকৃতি সৌন্দর্যের ছ’টায় উদ্ভাসিত। যখনই নটিলাসের বৃদ্ধি হয়, তখনই সামনের দিকে খোলস বড় হতে থাকে ও অভ্যন্তরীন প্রাকৃতিক রস-ক্ষরণে তাদের মাংসল শরীরের পিছনের দিকে পৃথক খোলসের প্রাচীর তৈরি হয়। এভাবে নটিলাস কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি করে আরও বড় প্রকোষ্ঠ তৈরি করে খোলসের মধ্যে। এভাবে সু² কারিগরির সাহায্যে ক্রমাগত বড় প্রকোষ্ট তৈরি করতে থাকে গাণিতিক সামঞ্জস্য রক্ষা করে। সর্বাধিক আটত্রিশটি প্রকোষ্ট তৈরি করে নটিলাস। সাধারণত: সর্বশেষ প্রকোষ্ঠটি আকারে ছোট হয়। জীবনদায়ী লাইনের মত পাতলা টিউব সব প্রকোষ্টগুলোকে শরীরের সাথে যুক্ত রাখে। মনে করা হয় যে এই টিউবই প্রাণীকে ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করে। প্রকোষ্ঠগুলোতে গ্যাস ও তরল পদার্থের অনুপাত নিয়ন্ত্রণ করে। নটিলাসের খোলস প্রাকৃতিক শঙ্খিল সামঞ্জস্যের এক নিখুঁত নিদর্শন। এমনকি সব থেকে সুন্দর মাকড়সার জালেও এরকম নিখুঁত সামঞ্জস্য দেখতে পাওয়া যায় না। তবুও নটিলাসের খোলস, যাকে মুক্তোর জাহাজ বলে বিখ্যাত কবি ওলিভার ওয়েন্ডেল হোমস বর্ণনা করেছেন। তা সেফালোপড স¤প্রদায়ভুক্ত প্রাণীদের যেমন-স্কুইড, কাটলফিস ও অক্টোপাসের তুলনায় অত্যন্ত প্রাচীন। আধুনিক প্রাণীরা খোলস বা তার অবশিষ্টাংশ নিজেদের শরীরের ভিতর বহন করে। আদিম প্রাণী হলেও পিনহোল ক্যামেরার মত খাপের মধ্যে সুস্পষ্ট চোখ নটিলাসের স্বল্প বিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে। 

গবেষকরা জানান, শুঁড়ের ব্যাপারে নটিলাস সেফালোপড স¤প্রদায়ভুক্ত অন্যান্য প্রজাতির প্রাণীদের পিছনে ফেলে দেয়। ষাট থেকে নব্বইটি শুঁড় ও প্রত্যেকটির সামনে সাইরাস নামক সম্প্রসারনশীল ও গুটিয়ে নেওয়া যায় এমন প্রত্যঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। এই শোষকযন্ত্রবিহীন শুঁড়গুলোর মধ্যে কিছু ঘ্রাণ নিতে, কিছু মাছ, লবস্টার বা কাঁকড়ার মত খাদ্যকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। অতি সা¤প্রতিককালে জানা গেছে যে এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রাণীর চলাফেরায় সাহায্য করে না। দু’টো ঘস্টে যাওয়া শুঁড় নটিলাস সমুদ্রের তলদেশে ধীরে ধীরে চলার সময় সীমারেখা অনুভব করতে সাহায্য করে। টিউবের মত ফানেলের মধ্য দিয়ে জেটের গতিতে পানি বের করে দিয়ে প্রাণী চলাফেরা ও শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে। ফানেলের ছন্দিত স¤প্রসারণ ও সঙ্কোচনের ফলে চোখের পিছনের দিকে অবস্থিত পথে টেনে নেওয়া পানি সজোরে নটিলাসের শরীরের ভিতর নিক্ষিপ্ত হয় ও পানির দ্রবণীয় অ¤ø¬জান কানকোর সংস্পর্শে আসে ও সামনের দিকে চামড়ার আচ্ছাদন টেনে দেয়। অনেকটা টানা দরজার মতো। 

নিজেদের দেহসৌষ্ঠব ও সৌন্দর্যের জন্যই নটিলাস বিপন্ন প্রাণী। সমুদ্রে নটিলাসের কোন শত্রæ নেই বটে। মানুষের মত নটিলাসও একে অপরকে আক্রমণ করে। খোলসের গায়ে অন্য নটিলাস চঞ্চুর ঠোকরের দাগ প্রায়ই চোখে পড়ে। তবে সব থেকে বিপদের কারণ হলো মানুষ। যদিও আপাত সংকটের কোন সম্ভাবনা নেই তবুও নটিলাস বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যে হারে নটিলাসের খোলস সংগ্রহ করা হয় মাদার অফ পার্ল -এর গহনা তৈরি করার কাজে, তাতে অবশিষ্ট নটিলাসের প্রজাতিক‚ল বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। 

নটিলাসের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উপর বিজ্ঞানীরা নিয়ত কাজ করে চলেছেন। যখনই কোনও তথ্য পাওয়া যায়, তখন ‘চ্যাম্বারড্ নটিলাস নিউজ লেটার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গ্রীণভিলে দিলাওয়ার মিউজিয়াম ও ন্যাচারাল হিষ্ট্রি থেকে প্রকাশিত নটিলাসের তথ্য সম্বলিত বিষয়গুলো পৃথিবীর একশ’ পয়ত্রিশটি মিউজিয়াম, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষকদের কাছে পাঠানো হয় সমুদ্রের এই তারকার বিষয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধানের জন্যে। 

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।