ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বারো ভূঁইয়াদের স্মৃতিচিহ্ন
কাইসার রহমানী
প্রকাশিত: ০৫:৫৫ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০২০ সোমবার আপডেট: ০৬:২২ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০২০ সোমবার
শুনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসা খানের কবর আর তার প্রতিষ্ঠিত মসজিদ রয়েছে। অনেকের মতো আমারও ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ আছে। তাই ছুটির একদিনে ছুটলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাসে করে শাহবাগ। তারপর শাহবাগে রিকশা করে স্বল্প দূরত্বের টিএসসি। বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু ছুটি, ক্যাম্পাসে তেমন ছাত্র-ছাত্রী নেই। টিএসসিটাকে খুব মলিন দেখাচ্ছিল। একেবারেই যে ছাত্র-ছাত্রী নেই তা না, যা আছে তা সংখ্যায় অনেক কম। যাদের কাছে পেলাম, জিজ্ঞেস করলাম, মুসা খানের কবরটা কোথায়? অনেকেই সঠিক ঠিকানা দিতে পারলেননা, কেউ কেউ এই প্রথম মুসা খানের নাম শুনলেন!
ও হ্যাঁ, মুসা খান নিয়ে আমার কেন আগ্রহ তা আগে বলে নিই। মুসা খান ছিলেন, ভাটি অঞ্চলের অধিপতি মসনদ-ই-আলা ঈসা খানের পুত্র। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে ঈসা খানের মৃত্যুর পরে, মুসা খান পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। হয়ে যান বিশাল রাজ্যের অধিপতি। তার রাজ্য বৃহত্তর ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার অর্ধেক, প্রায় সমগ্র ময়মনসিংহ জেলা, বৃহত্তম রংপুর, বগুড়া এবং পাবনা জেলার কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুসা খানের রাজধানী ছিল সোনারগাঁয়। তিনি তার বাবা ঈসা খানের মতো মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্তু মোগল সেনাপতি ইসলাম খাঁর কাছে পরাজিত হন তিনি এবং মোগলদের আনুগত্য মেনে নিতে বাধ্য হন।
১৬২৩ সালে মুসা খান মারা যান। তাকে ঢাকায় কবর দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে। তার কবরের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছিল, তার নামে মসজিদ। বারো ভূঁইয়া বংশধর, অধিপতির অধিপতি ঈসা খাঁ পুত্র মুসা খানের স্মৃতিবিজড়িত মসজিদ আর তার কবর খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখার আগ্রহ তাই ধরে রাখতে পারিনি। ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ছুটে চলা মুসার কবর আর মসজিদ সন্ধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
অনেকেই সঠিক ঠিকানা দিতে পারলেননা। সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারী তিনি দিলেন ঠিক ঠিকানা। বললেন, টিএসসি থেকে চলে যান কার্জন হলে। কার্জন হলের পেছনে আর শহীদুল্লাহ হলের কাছে পেয়ে যাবেন মুসা খানের মসজিদ ও কবর। আমি আবার রিকশা নিলাম।
বিশ্বিদ্যালয়ে মধ্য দিয়ে মেট্ররেলের কাজ হচ্ছে। কি ভারী ভারী যন্ত্র উপরে ঝুলছে, দেখলে অবাক লাগে। আসালে ছুটে চললে, কত কিছুই না দেখার বাকি, তা বোঝা যায়। কার্জন হল যেতে যেতে চোখে পড়লো, বিখ্যাত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, এখানেই একদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। চোখে পড়লো তিন নেতার মাজার। জাতির এই তিন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বিখ্যাত ঢাকা গেট যখন পার হলাম, মনে হলো আমি যেন ঈসা খানের সুখ্যাত সেই বাগ-ঈ-মুসাতে চলে যাচ্ছি।
কার্জন হলে নামিয়ে দিলো রিকশাওয়ালা। খুঁজতে লাগলাম মুসা খানের কবর আর মসজিদ। সেখানে একজন ছাত্র দেখিয়ে দিলেন কবর আর মসজিদ। অবাক হলাম, যা ভেবেছিলাম তা না। কার্জন হলের মতো জৌলুশ ছড়ানো স্থাপনার ঠিক পেছন দিকেই ক্ষয়ে যাওয়া কবর, আর মন খারাপ করে অযত্ন অবহেলা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদ যেন ঠিক যুতসই লাগছেনা। কবরটি পড়ে আছে আগাছার মধ্যে। পলেস্তরা কোথাও কোথাও খুলে পড়েছে। কোন নাম ফলকও নেই। কেউ যদি বলে না দেয় এটা মুসা খানের কবর, কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না বাংলার বীর বারোভূইয়া অধিপতিদের একজন এখানে শুয়ে আছে। কবরের গায়ে কেউ একজন কাঁচা হাতে চুন দিয়ে লিখে দিয়েছে মুসা খানের নাম। সেটাই যেন তার পরিচিতি এখন !
একটি গাছে ছায়ার নিচে আশ্রয় হয়েছে মুসা খানের। চারপাশ ঘিরে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় বিল্ডিং। ছাত্র-ছাত্রীদের আনাগোনা। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা কি জানেন কবরটি কার? কেউ কেউ বলতে পারলেন। অনেকেই পারলেননা। অনেকেই জানালেন, তারা এই কবরের পাশে অনেক আড্ডা দিয়েছেন। কিন্তু পরে জানতে পেরেছেন এটা আসলে মুসা খানের কবর।
একসময়ের বৃহত্তর ঢাকা, কুশিল্লা, ময়মনসিংহসহ আরো বেশ কয়েকটি অঞ্চলের শাসনকর্তা সাড়ে তিন হাত মাটিতে শুয়ে আছেন অবহেলা ও অযত্নে। কবরটি দেখলে, আপনার ভাবনা জাগবে, কতটুকু আসলে আমরা নিয়ে যেতে পারবো মৃত্যুর পরে…
কবরটির ঠিক সামনেই রয়েছে, মুসা খাঁ প্রতিষ্ঠিত মসজিদ। সপ্তদশ শতকের শেষ থেকে অষ্টাদশ শতকের শুরুর মধ্যে মসজিদটি নির্মিত বলে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন। তবে কেউ কেউ স্পষ্ট করে বলেন- মসজিদটি নির্মান ১৬৭৯ সালে।
দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদে রয়েছে তিনটি গম্বুজ। মসজিদটি নির্মাণ করা হয় তিন মিটার উঁচু একটি ভল্ট প্লাটফর্মের ওপর। প্লাটফর্মটির নিচে রয়েছে অনেকগুলো ঘর। কিন্তু এখন তা আর বাসযোগ্য নয়। এখানে দেখলাম কয়েকটা বাচ্চা নিয়ে কুকুর সংসার পেতেছে। অযত্ন অবহেলা আর সংস্কারের অভাবে নিচের ঘরগুলোতে প্রবেশ করা যাবেনা। ভিতরে জমেছে অনেক ময়লা।
দক্ষিণ পাশ দিয়ে ১২ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় মসজিদের দরজায়। পূর্ব দিকে খোলা বারান্দা। চওড়া দেয়াল। মসজিদের পশ্চিম ও পূর্ব প্রাচীর প্রায় ৬ ফুট পুরু। উত্তর ও দক্ষিণ প্রাচীর ৪ ফুট পুরু। পূর্বের দেয়ালে তিনটি ও উত্তর-দক্ষিণে দুটি খিলান দরজা। ভেতরে পশ্চিম দেয়ালের মধ্যে একটি প্রধান এবং পাশে দুটি ছোট মেহরাব। চারপাশের দেয়ালে মোগল রীতির নকশা। বাইরের দেয়ালের চার কোণে চারটি মিনারখচিত আট কোণ বুরুজ।
মসজিদের নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে আগুনে পোড়ানো ইট ও চুনসুড়কি। ব্যবহার করা হয়েছে পাথরও।
মসজিদ আর কবরের পাশেই চলছে মেট্ররেলের কাজ। শব্দ আর শব্দ, হোই-হুল্লোড় মেট্ররেল শ্রমিকদের। এর মধ্যেই কবর আর মসজিদের নীরবতা যেন জানান দিচ্ছে , বারোভূইয়াদের গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্ত্ব আর বীরত্বের।
রিকশা ফিরে যাচ্ছি আবারো ঢাকা গেট, তিননেতার মাজার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে শাহবাগ। রিকশা গতিতে বাগ-ঈ-মুসা থেকে ক্রমেই যেন বের হয়ে আসলাম বাস্তবের ইট পাথরের শহরে। ভাবনায় এলো, বাংলায় বারো ভূঁইয়াদের স্থাপত্যকর্মগুলোর আজ অধিকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত। ঢাকাতে একমাত্র মুসা খান মসজিদ ও মুসা খানের কবর তার আদিরূপ নিয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ভূঁইয়াদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য মসজিদ ও কবরটির উত্তম সংরক্ষণ ব্যবস্থা জরুরি। ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলো বাসের হেল্পার ডাকে। আমি যেখানে যাবো, সেই জায়গার নাম ধরে যাত্রী ডাকছেন তিনি।
দেখুন ভিডিও স্টোরি