নারী যত স্বাবলম্বী, পুরুষতন্ত্রের তত ভয়
মোহাম্মদ নূরুল হক
প্রকাশিত: ০৯:৫২ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০২২ বুধবার
নারীকে যত কারণে পুরুষতন্ত্র ভয় পায়, তার একটি স্বনির্ভরতা। সহায়-সম্বলহীন নারীকে ইচ্ছেমতো দাসীর মতো ব্যবহার চলে। কিন্তু স্বাবলম্বী নারীর ক্ষেত্রে অতটা সহজ হয় না। তাই নারী যেন স্বাবলম্বী হতে না পারে, তার জন্য পুরুষতন্ত্রের থাকে নানামুখী উদ্যোগ। যেভাবেই হোক, নারীর স্বনির্ভরতার পথ রুদ্ধ করে তাকে পুরুষনির্ভর করেই রাখতে হবে, এই হলো পুরুষতন্ত্রের মূলমন্ত্র।
অথচ কে না জানে, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভরতা নারী-পুরুষ; প্রত্যেকের জন্যই প্রয়োজন। বেঁচে থাকার জন্য আর্থিক সচ্ছলতা জরুরি বিষয়। এই সত্য পুরুষের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি নারীর জন্যও সত্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুরুষের আর্থিক সচ্ছলতাকে যেভাবে সম্মানের সঙ্গে দেখা হয়, নারীর ক্ষেত্রে সেভাবে বিবেচনা করা হয় না। এরও চেয়ে ভয়ানক তথ্য হলো, নারীর নিজস্ব সম্পত্তি থাকলেও তা রক্ষণাবেক্ষণের নামে মূলত ভোগ করে পুরুষরা। এমনকি ওই সম্পত্তি যে নারীর, সে নারীর ওপর সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণকারী পুরুষটি কর্তৃত্বও করে। হোক সে বাবা, হোক সে ভাই, হোক সে স্বামী কিংবা ছেলে। সব পুরুষেরই একই চরিত্র, একই স্বভাব।
কোনো সম্পর্কের পুরুষই নারীর স্বনির্ভরতাকে সম্মানের চোখে দেখে না। বরং এমন সব কৌশল অবলম্বন করে, যাতে নারী আর্থিকভাবে স্বনির্ভরতার জন্য নিজেকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন না ভেবে নিরাপত্তাহীন ভাবতে বাধ্য হয়। যে নারীর যত সম্পত্তি আছে, সে নারী যেন তত প্রাণহানির ঝুঁকির ভেতর থাকে। নারীর ভেতর এমন আতঙ্কের বীজ রোপণ করে দেওয়াই পুরুষতন্ত্রের মজ্জাগত স্বভাব। আর এই পুরুষতন্ত্রের অন্যতম সহযোগী কতিপয় ‘প্রথাগত-ধর্মভীরু’ নারীই। মূলত এই ‘প্রথাগত-ধর্মভীরু’ নারীরাই পরিবারের কর্তা পুরুষটিকে নানাভাবে উসকানি দিয়ে স্বনির্ভর নারীর ওপর ক্ষেপিয়ে তোলে। এমনকি কর্তৃত্ব করার জন্য প্ররোচিতও করে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, নারী স্বনির্ভর হলে পুরুষতন্ত্রের ভয় কিসে? এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে কয়েকটি বিষয়ের মীমাংসা হওয়া উচিত।
প্রথমত, প্রথা। সমাজ-চালনার প্রধান নিয়ামক হচ্ছে প্রথা। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রথা বলছে, সম্পত্তির মালিক হবে পুরুষ। পরিবার থেকে সমাজপর্যন্ত, সর্বত্রই পুরুষ কর্তৃত্ব করবে। নারী তার আজ্ঞাবহ দাসী মাত্র। পুরুষ যা বলবে, নারী তা অবনত মস্তকে মেনে নেবে। সেই অনুযায়ী কাজ করবে। নারী তার ভরণ-পোষণের জন্য পুরুষের শরণাপন্ন হবে। পুরুষ দয়া করে নারীকে ভরণপোষণ দেবে। বিনিময়ে ভোগ করবে, শাসন করবে, শোষণ করবে, প্রয়োজনে নিপীড়ন করবে। প্রয়োজন ফুরোলে ছুড়ে ফেলবে ডাস্টবিনে। সেখানে নারী স্বনির্ভর হলে পুরুষের কাছে তাকে যেতে হবে না। এই পুরুষনির্ভরতাহীনতাই পুরুষ তার জন্য মানহানির বলে মনে করে। তাই নারী স্বনির্ভর হলে তার যত ভয়।
দ্বিতীয়ত, ধর্ম। সমাজে বর্তমানে যত ধর্ম আছে, প্রায় সব ধর্মেই নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্ব ঘোষণা করা হয়েছে। সম্পত্তি যারই হোক, তার রক্ষণাবেক্ষণ করবে পুরুষ। তার আয়ব্যয়ের হিসাব রাখবে পুরুষ। নারীর ভরণপোষণ থেকে শুরু করে চিকিৎসা-শিক্ষাব্যয় সবই পুরুষ করবে। তাই ধর্মগুরুদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী নারীকে পুরুষের পদানত হয়েই থাকতে হবে। পুরুষের কর্তৃত্ব অস্বীকারকারী নারী ‘নরকবাসি-জাহান্নামি’ হতে বাধ্য। এই মন্ত্র নারীর কানে কানে সারাক্ষণ জপতে থাকে পুরুষতন্ত্রের আজ্ঞাবহ ধর্মগুরু ও তাদের দোসর একশ্রেণির নারীও।
তৃতীয়ত, সামাজিক মর্যাদা। সম্পত্তি যার, সমাজে মর্যাদাও তার। এই তত্ত্বে বিশ্বাসীদের ভয়, নারী স্বনির্ভর হলে তার অর্থবিত্ত তারই করায়ত্তে থাকবে। তখন পুরুষের কথায় ওঠবোস করবে না। সে চলবে স্বাধীনভাবে। পুরুষতন্ত্রকে পূজা করার দরকারই হবে না। নারীর এই স্বাধীনচেতা স্বভাবকে পুরুষ চিরকালই ভয় করে এসেছে, সন্দেহ করে এসেছে। এখনও তাই রয়ে গেছে।
চতুর্থ, প্রাণহানির ভয়। যে নারীর সম্পত্তি যত বেশি, তার ততবেশি প্রাণহানির শঙ্কা। এমন একটি তথ্য সমাজে ছড়িয়ে রেখেছে পুরুষতন্ত্র। তারা নারীকে বোঝায় সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ যদি নিজের করায়ত্তে রাখে, বেহাত হতে পারে। বেহাত না হলে তার পেছনে শত্রু লেগে যাবে, তার প্রাণহানিও ঘটতে পারে। সুতরাং নারীকে নিরাপত্তর দেওয়ার জন্য উপযুক্তি অভিভাবক দরকার। সেই অভিভাবককে আবার হতে হবে পুরুষ।
স্বনির্ভর নারীকে পুরুষের ভয় পাওয়ার অনেক কারণের মধ্যে উল্লিখিত চারটি কারণই প্রধান। এসব কারণে পুরুষতন্ত্র নারীকে স্বনির্ভর হতে দেয় না। এমনকি স্বনির্ভর নারী যদি বেতনভুক্ত লোকজন নিয়ে একা জীবনযাপন করতেও চায়, পুরুষতন্ত্র সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নানা রকম ভয়ভীতি তো দেখায়, সঙ্গে চরিত্রহীনা অপবাদ দিতেও ভুল করে না। এভাবেই স্বনির্ভর নারীকে পুরুষতন্ত্র কব্জা করার ষড়যন্ত্রে সারাক্ষণ লিপ্ত থাকে।
এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটাই পথ। সেই পথ নারীর ‘একলা চলোনীতি’র। নারীকে স্বনির্ভর হতে হলে কোনো পুরুষের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। দরকার নেই মানসিক সমর্থনেরও। প্রয়োজন কেবল নারীর ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনচেতা মনোভাব। কোনোভাবেই পুরুষতন্ত্রের চেতনার দাসত্ব নয়। চেতনার দাসত্ব নারীকে কেবল পুরুষতন্ত্রের যৌনদাসীতেই পর্যবসিত করবে। তাকে মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে না। অতএব, নারীকেই বুঝতে হবে, তার কোন পথে যাওয়া উচিত, কোন পথে তার অর্থনৈতিক ও মানবিক মুক্তি।
তাহলেই আর পুরুষতন্ত্র তাকে দাসীর মতো খাটাতে পারবে না। পণ্যের মতো যখন-তখন ভোগ করতে পারবে না। নারীকেও পুরুষের সমান মর্যাদা দেবে। তাকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবেই গণ্য করতে বাধ্য হবে।
লেখক: কবি-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক।