অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

শব্দ কখন ভয়ংকর?

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ১২:০৭ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০২২ শুক্রবার   আপডেট: ১২:১০ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০২২ শুক্রবার

চুল পেকেছে। চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। তাই বলে কানে কম শুনবেন কেনো? না, এটি  হতে পারে  না। এটি আমাদের ভুল ধারণা। কানে কম শোনা শুনির সঙ্গে বয়সের কোনই সম্পর্ক নেই। আমার কথা নয়। বলেছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের মতে, ‘কানে কম শোনা’ এক ধরণের রোগ। বিশেষজ্ঞদের কাছে  যার স্থায়ী চিকিৎসা নেই। রয়েছে কেবল প্রতিরোধের উপায়। 

দৃশ্যপট:১
ক্যাথি প্যাক। গানবাজনা করেন। কান নিয়ে কখনো  কোনদিন ভাবনা চিন্তার দরকারই মনে করেননি মার্কিন এই শিল্পী। ব্যান্ডের তালে তালে বেইস গিটার বাজান।  এটিই তার  পেশা। পাঁচ বছর  পর আসল মজাটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেলেন এই শিল্পী। শব্দের চোটে এখন কান দু’টো তার ড্যামেজ। কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না । স্থায়ী বধির  হয়ে গেছেন তিনি ।

দৃশ্যপট: ২
প্রাংক গোরাল। নৌবাহিনীর  ফ্লাইট অফিসার। কে জানে যে তিনিও বধির হয়ে যাবেন? জেট ইঞ্জিনের শব্দ তার কান দু’টো  ছাই ভস্ম করে দেবে, কে জানতো?  ফ্লাইট অফিসার হিসেবে মাত্র পাঁচ বছর চাকুরি করেছেন।  কানের স্থায়ী সমস্যার কারণে ফ্লাইট ছেড়ে তিনি এখন অফিসিয়াল কাজ  নিয়েছেন। তবে ইতোমধ্যে যা হবার তা  তো হয়েই গেছে। মানে তার কান দু’টো এখন প্রায় ফিউজ।  শব্দ দূষণের জন্য কান নিয়ে আক্ষেপ করে তিনি বলেন: ‘আমার মনে হয়, ডানে বায়ে কেউ কিছু বলছে। কিন্তু কি বলছে? পাশের লোককে প্রায়ই প্রশ্ন করি।  উনি কি কিছু বলেছেন?  এটি আমার এখন বাজে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।’

শব্দদূষণ কি?
শব্দদূষণ বলতে মানুষের বা কোনো প্রাণীর শ্রæতিসীমা অতিক্রমকারী শব্দ সৃষ্টির কারণে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে বোঝায। যানজট, কলকারখানা থেকে দূষণ সৃষ্টিকারী এরকম তীব্র শব্দের উৎপত্তি হয়ে থাকে। বিমানের প্রচন্ড আওয়াজের ফলে বিমানবন্দর এলাকার আশেপাশে ব্যাপক শব্দ দূষণগত পরিবেশের সৃষ্টি করে। রাতে এবং ভোরে যদি বিমান পরিচালনা করা হয় তখন ব্যক্তির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। শুধুমাত্র অবতরণ কিংবা উড্ডয়নের জন্যই বিমানের আওয়াজ সৃষ্টি হয় তা কিন্তু নয়। বিমান মেরামত ও পর্যবেক্ষণের জন্যও এরূপ হয়ে থাকে। এর ফলে ব্যক্তি, বিশেষতঃ শিশুর শব্দদূষণগত কারণে শারীরিক এবং মানসিক বিকাশেও ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে।

কানের বারোটা
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানিয়েছেন: মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দু’কানের বারোটা বাজায়। উইলিয়াম ক্লার্ক, সেইন্ট  লুইম বধির সংস্থার বিশিষ্ট দুই বিজ্ঞানী। তারা বলেন: ‘আমেরিকানদের অনেকেই এখন কানে কম শুনেন। যার ৭৫ শতাংশ শব্দ দূষণের শিকার।’ শব্দ কি ভয়ংকর ভাবেই না শ্রবণশক্তি নষ্ট করে, ধারণাই করা যায় না। দু’ভাবে কানের ক্ষতি করে শব্দ। তাৎক্ষণিক এবং ধীরে ধীরে। তাৎক্ষণিক  ক্ষতিকে  বলে অ্যাকোস্টিক ট্রমা। বন্দুকের গুলির মতো শক্তিশালী। এই উচ্চগ্রাম শব্দ কান দুটো এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। 

ঝালাপালা শব্দ
ধীরে ধীরে শব্দ  দুষণের শিকার আমরা প্রত্যেকেই। নগর  জীবনের নানান শব্দ আমাদের কান ঝালাপালা করছে। ধীরে ধীরে ধ্বংস করছে কানের ভেতরের ইন্দ্রিয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের কানের ভেতরে বা অন্তকর্ণে ষোল হাজার সেল বা কোষ থাকে। এগুলো মস্তিষ্কে শব্দের অনুভূতি জাগায়। প্রতিনিয়ত এ কোষগুলোই  মারা যাচ্ছে উচ্চ শব্দ সইতে না পেরে।  এবার ধরা যাক-জীবন জন্তুর গজর্ন, চিৎকার, মানুষের চিৎকার, গাড়ির হর্ণ, গিটার বা বাঁশির শব্দ, ঢোল-ঢাকের বাদ্য বাজনা, অডিও ইত্যাদির কথা। এসবই উচ্চ গ্রামের শব্দ কম্পাংক তোলে। এসব শব্দের আঘাতে আমাদের কান থেকে রক্তপাত দৃশ্যমান হয়না বটে। কিন্তু শ্রবণ ইন্দ্রিয় ধ্বংস করে খুবই নীরবে।

শব্দের ক্ষতিকর মাত্রা
শব্দের একককে বলে ডেসিবল। সংক্ষেপে ডিবি। ৮৫ ডিবি শব্দ আমাদের কানের জন্য নিরাপদ। ওয়াশিং মেশিন, ভ্যাকিউম ক্লিনার ইত্যাদির শব্দ ৮৫ ডেসিবল। কিন্তু এর বেশি হলেই কান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাওয়ার ড্রিলের শব্দ ১শ ডিবি। দু’ঘন্টা এক নাগাড়ে এই শব্দ শুনলে কান হবে একদম শেষ। অডিও-ভিডিওর শব্দ সাধারণ মাত্রায় ১১০ ডিবি থাকে। শিশুদের চিৎকারের শব্দ ৯০ ডিবি, ঘড়ির এলার্ম ৮০ ডিবি আর পথঘাটের এলোমেলো শব্দ ধ্বনি ১শ ডেসিবলের উর্ধে থাকে। বন্দুকের গুলির শব্দ ১৪০ ডেবিবেল। হাতুড়ি পেটার শব্দ ১৩০ ডিবি। ৩.৮ মিনিট এই শব্দ শুনলেই কানে ঝিম ধরে যায়। ব্যান্ড মিউজিক ১২০ ডিবি। ৭.৫ মিনিটের বেশি শুনলেই  কানের কেল্লাফতে। পাওয়ার ড্রিলিং মেশিন ১০০ ডিবি। মাত্র দু’ ঘন্টা শুনলে কান ভোঁতা হয়ে যায়। ঘাস কাটার যন্ত্র ৯০ ডিবি। ৮ ঘন্টার বেশি শোনা যায় না। গবেষকরা জানিয়েছেন: মানুষ সাধারণত ২০-২০,০০০ হার্জের কম বা বেশি শব্দ শুনতে পারে না। মানুষের কান যেকোনো শব্দের ব্যাপারে যথেষ্ট সংবেদী। তাই তীব্র শব্দ কানের পর্দাতে বেশ জোরে ধাক্কা দেয়, যা কানের পর্দাকে নষ্টও করে দিতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর ক্ষতিকর প্রভাব সুদূর প্রসারী হয়ে থাকে। শব্দদূষণের কারণে মানুষের স্বাস্থ্য এবং আচার-আচরণ সব ক্ষেত্রেই সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে। অতিরিক্ত শব্দের কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাভাবিক কার্যকলাপ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।  এছাড়াও শব্দদূষণের কারণে দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, শ্রবণশক্তি  হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাতসহ অন্যান্য ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে।

শব্দ দুষণ এড়াবেন কিভাবে? যেখানেই থাকুন। যে অবস্থাতেই থাকুন। শব্দ আপনার কানের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এজন্য বাস্তব কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এক জোড়া ইয়ার প্লাগ কিনতে পারেন। পকেটে ইয়ারপ্লাগ রাখুন। অবস্থা দেখে ব্যবস্থা নিন। মনে রাখবেন উচ্চ শব্দ এড়াতে ফোম সিলিকন, মোম, এসব  কোন কাজে লাগে না। আর হ্যাঁ। কানে কখনো তুলো দেবেন না। তুলো শব্দ প্রতিরোধ করে না। যদি প্লাগ ব্যবহার করেও বাড়তি শব্দ নিয়ন্ত্রণ না হয়, তাহলে আপনার কান দু’টো বিষেশজ্ঞ চিকিৎসককে দেখান, পরীক্ষা করান। এছাড়া যেখানে উচ্চগ্রাম শব্দ হচ্ছে সেখান থেকে একটু দুরে গিয়ে দাঁড়ান। স্টেডিয়ামে  হৈ চৈ এর মধ্যে খেলা দেখলেন ভালো কথা। বাসায় এসে অমনি মিউজিক শুনবেন না। মাঝখানে বিরতি দিবেন। তা না হলে এসময় শিশুর ইলেকট্রিক গিটারের শব্দও মারাত্বক ক্ষতি করে। মনে রাখবেন, কান একবার বধির হলে কোন মতেই ঠিকঠাক মতো আর ফিরে পাওয়া যায় না। বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন শ্রবণযন্ত্র খুব একটা কাজ দেয় না। তাই প্রয়োজনে যখন যে অবস্থায়ই অডিও শুনবেন, ভলিউম এডজাস্ট করে শুনুন। কান মুল্যবান ইন্দ্রিয়। একবার বধির হলে আর ফিরে পাবার উপায় নেই। 

লেখক: বিজ্ঞান লেখক। এম.ফিল গবেষক। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।