অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

টেড হিউজের কবিতা

অনুবাদ: আসাদ আলম সিয়াম

প্রকাশিত: ০২:৪৯ পিএম, ২০ নভেম্বর ২০২০ শুক্রবার   আপডেট: ০২:৫৬ পিএম, ২০ নভেম্বর ২০২০ শুক্রবার

সাইমন আর্মিটেজ
অনুবাদ: আসাদ আলম সিয়াম

[সাইমন আর্মিটেজ ব্রিটেনের অন্যতম সমকালীন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার এবং ‘রয়াল সোসাইটি অফ লিটারেচার’ এর ফেলো। ‘বুকস অফ ম্যাচেট’, ‘ডেড সী পোয়েমস’, ‘কিড’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য  গ্রন্থ। সাইমন, রেডিও এবং টেলিভিশনের জন্যও কাজ করেন। অনুদিত প্রবন্ধটি সাইমনের সংকলিত কবি টেড হিউজের কবিতা সংকলনের মুখবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়। পরে প্রবন্ধটি পরিমার্জিত রূপে ‘দ্যা গার্ডিয়ানে’ও প্রকাশিত হয়েছে। টেড ও সাইমনের মধ্যে কিছু সুন্দর মিল রয়েছে– দু’জনেরই জন্ম ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার অঞ্চলে, দু’জনেই ব্রিটেনের রাজকবি হয়েছেন। টেড ’৮৪ সালে রাজকবি হন, আর সাইমন, ২০১৯ সাল থেকে রাজকবি হিসেবে রয়েছেন।]

 

কুড়ি বছর আগের চাইতে আজকের দিনে কবি টেড হিউজের নির্বাচিত কবিতার একটা সংকলন প্রকাশ করা অনেকটাই ভিন্ন মাত্রার একটা কাজ। ’৯৮ সালে হিউজ যখন মারা গেলেন তখন তিনি তাঁর কর্মজীবনের যে কোনো সময়ের মতই সমান মূল্যায়িত এবং আদৃত ছিলেন। আর তাঁর শেষ দুটো কবিতার বই – ‘টেলস্ ফ্রম ওভিদ’ ও ‘বার্থডে লেটার্স’ উচ্চকিত প্রশাংসা পেয়েছিলো। শুধুমাত্র সেই দৃষ্টিকোন থেকেই এই বইটি সন্নিবেশ করার কাজটিতে সবধরণের রোমাঞ্চ আর তাৎপর্যের সমাহার ঘটেছে।

তবে, পাঠক বা লেখক যে হিসেবেই হোকনা কেন, সত্তর বা আশির দশকে হিউজের পক্ষে কথা বলার অর্থ ছিলো একটা সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়া। হিউজের কবিতার সমর্থন করার অর্থ ছিলো যেন ব্যক্তি হিউজকেই সমর্থন করা, যাকে তখন এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে পরিগনিত করা হতো, যার আদর্শিক অবস্থান ছিলো প্রচলিত ধারার বাইরে, আর যার কবিতা শৈলীকে অনেক মনে করেছিলেন একগুয়ে আর অমার্জনীয়। হিউজ নিজেও তখন ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন আর তাঁর কবিতাও যেন তাঁর সাথে ক্রমে অন্তরালে চলে যাচ্ছিলো। তাঁর প্রথম স্ত্রী, কবি সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যুতে হিউজের ভূমিকা নিয়ে সমলোচনা এমন তুঙ্গে পৌঁছেছিলো– বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে– যে, এমনকি যাদের কবিতা সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞানও ছিলোনা তারাও তাঁর কবিতা সম্পর্কে মতামত দিতে পিছপা হতেননা। অনেকেই মনে করতেন যে তিনি তাঁর সমসাময়িক আদর্শ ও আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার সম্পুর্ণ বিপরীত ধারার প্রতিনিধিত্ব করতেন। ‘৮৪তে রাজকবির পদ গ্রহন করা, শিকার করা, মাছ ধরা, বন্দুক চালনায় তাঁর প্রকাশ্য আগ্রহ– সব কিছু নিয়ে তাঁকে সহজেই ব্যঙ্গ করা হতো। সেই সময় তাঁর লেখার প্রসারে কাজ করবার অর্থ ছিলো প্রায় স্পর্ধার কাজ করা– আজকের মতো তা তাঁর প্রতিভার সমাদর করবার মতো কাজ নয়। সত্যি, কতো দ্রুত আর অদ্ভুতভাবেই না পরিস্থিতি বদলে গেছে।

হয়তো, পরিস্থিতি আবারো বদলে যাবে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিউজের কবিতা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। তাঁর ‘বার্থডে লেটার্স’ এখন সর্বকালের অন্যতম সর্বাধিক বিক্রিত একটা বই, যা প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। এই বইয়ের পাঠককুলের মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক পরচর্চাকারী, পৈশাচিক ও বিকৃ্ত মানসিকতার পাঠকও রয়েছেন, যাদের যতো আগ্রহ বইটাতে লেখা সিলভিয়া ও নিজের সম্পর্কের বিষয়ে হিউজের খোলামেলা বর্ণনায়, পরস্পরের সাহচর্যে পরস্পরের প্রতি তাঁদের অনুরাগের তীব্রতার বিবরণে- যার পরিণতি সিলভিয়ার আত্মহত্যায় – তার বিন্দুমাত্র আগ্রহও নেই তাদের সেই বর্ননার সাহিত্যমূল্যে। তার উপর বইটাতে রয়েছে হিউজের দ্বিতীয় সম্পর্কেরও বিশদ বিবরণ – যার সমাপ্তি কিনা আরো করূণ ট্রাজেডিতে। প্রকৃ্তপক্ষে, ‘বার্থডে লেটার্স’ বইটাতে হিউজের লেখার গুনগত মান– যার অসাধারণত্বের সাথে হিউজের অনেক ভক্ত বরাবরই পরিচীত ছিলেন– তাঁকে প্রভূত স্বীকৃ্তি এনে দেয়। এখানে বলা দরকার যে হিউজকে তাঁর সমসাময়িক লেখকরা নিয়মিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনেকটা আবশ্যকভাবে যে  স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তার পাশাপাশি, নতুন প্রজন্মের লেখকরাও হিউজের লেখার প্রতি পাঠকের আগ্রহ নবায়ন ও পূনরোজ্জীবিত করতে সাহায্য করেন। তাদের অনেকেই হিউজের কবিতার গুরুত্ব ও প্রভাব সম্পর্কে বলতে শুরু করেন। হিউজ তাঁর শেষদুটো বইয়ের জন্য যে প্রভূত পুরস্কার আর প্রশাংসা পান, বিশেষ করে ‘বার্থডে লেটার্স’ যে বিপুল স্বীকৃতি পেয়েছিলো, সেই কৃ্তিত্বের অনেকখানিরই দাবীদার এই নতুন ধারার লেখকরা, যারা বছরের পর বছর হিউজের লেখার প্রতি তাঁরা যে দূর্বলতা অনুভব করেছিলেন তা প্রকাশ্যে আনার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। এটা যেন ছিলো কবিদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের বিষয়, কবিতার সৃষ্টিশীলতাকে প্রতিষ্ঠিত করবার বিষয়। আর তা যখন একবার ঘটে গেলো, তখন গনমাধ্যমের বরাবরের অভ্যাসগত প্রতিকুলতাও যেন রাতারাতি উলটে গেলো। হঠাৎ করেই যেন জনসম্মুখে বা খোলা জায়গায় কবিতার বই পড়া গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠলো, এমনকি সে বই যদি কবি টেড হিউজের বই হয়, তাও।

যদি এ সংস্করণের সম্পাদনা করা আমার জন্য রোমাঞ্চের হয়, তবে এখানে এও বলা দরকার যে তার পাশাপাশি একটা উৎকন্ঠা আর গুরুদায়িত্বের বোধও আমার রয়েছে। হিউজ সারা জীবন ধরে তাঁর কাজের উপর একটা কঠোর নিয়ন্ত্রণ চর্চা করেছেন, নিজের কাজের পটভূমি, উপস্থাপন, প্রকাশের সময় ইত্যাদি সম্পর্কে হিউজ বরাবর অত্যন্ত সাবধানী ছিলেন। নিজের কবিতাগুলো তিনি কঠিন নিয়ন্ত্রনে রাখতেন, প্রায়শই কবিতা পাঠের নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতেন, আর গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান ও রাশিচক্রের গননা অনুযায়ী বই প্রকাশনার দিন-তারিখ নির্ধারণ করতেন। বিস্ময়করভাবে, হিউজের মাপের একজন লেখকের উপর বাজারে খুব কমসংখ্যক সাহিত্য আলোচনার বই পাওয়া যায়, যাওবা পাওয়া যায় তা যদিও বেশ স্বকীয়ধারণার বা আগ্রহোদ্দীপক, কিন্তু সেগুলো যে সকল উৎস বা লেখকের কাছ থেকে কাংখিত ছিলো, তাদের দ্বারা রচিত হয়নি (পক্ষান্তরে, সিলভিয়া প্লাথের উপর লেখা আলোচনার সংখ্যা এখানে একটা কৌতুহলহোদ্দীপক তুলনা হতে পারে)। যেহেতু নিজের কবিতার তদারকি করবার জন্য হিউজ আর উপস্থিত নন, সেহেতু নিশ্চয়ই আগের সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। আর নিঃসন্দেহে তাঁর মৃত্যু সংবাদ কারো কারো কাছে কোন প্রতিযোগিতা শুরু করার বাঁশির মতোই লেগেছে, যা কিনা কতগুলো অননুমোদিত জীবনীগ্রন্থের সূচনা ঘটাবে। আমরা যেমন ভাবছি, হয়তো তারও আগেই আমরা হিউজের উপর লেখা জীবনীগ্রন্থ পেয়ে যাবো। মৃত্যুগাঁথার লেখকদের মতো জীবনিকারদেরও একটা প্রবনতা থাকে ঘটনা ঘটবার আগেই শুরু করবার, আর তারা কোন ব্যক্তির জীবনকাহিনী উপর কাজ করবার জন্য সবসময় তাদের মৃত্যুর জন্যও অপেক্ষা করেননা। আমরা শুধু এটুকুই আশা করতে পারি যে এমন যে কোন বই যেন তার উপজীব্যের প্রতি সুবিচার করে।

বোধ করি লেখালেখির জগতে, এমন কি তার বাইরেও, এমন একটা ধারণা ছিলো যে টেড হিউজ এমন এক ব্যক্তি যার সাথে কোন গোলমাল বাঁধানো ঠিক নয়, এবং তাই তাঁর কবিতাও এমনই কিছু, যে সেগুলো সম্পর্কে কোন বিভ্রান্তি ছড়ানো ঠিক হবেনা। এটা হিউজের এমন এক ভাবমূর্তি যা কিনা তাঁর উপকারী, উদার ও রহস্যময় ব্যক্তিত্ব – অনেকেই তাঁকে যেভাবে চিনেছেন– তার বিপরীত। কিন্তু তাঁর এই রুক্ষ ভাবমূর্তিটাই শেষপর্যন্ত টিকে গিয়েছিলো, হয়তো তাঁর কবিতার বিষয় ও কাব্যশৈলীর প্রলম্বন হিসেবে। আমি জানি যে এখন পর্যন্ত তাঁর কাজের এমন কোন সংকলন প্রকাশিত হয়নি, যেখানে হিউজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিলোনা অথবা যেখানে নিদেনপক্ষে তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে হিউজ তাঁর অর্থবহ উপস্থিতি নিশ্চিত করেননি। তাঁর সেই উপস্থিতিকে আমি অনুভব করি এবং তাকে আমার শ্রদ্ধা করবার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর ‘নিউ সিলেক্টেড পোয়েমস’, হিউজের মৃত্যুর ঠিক তিন বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিলো। কিছু সংখ্যক লেখক আছেন যারা তাদের জীবন সায়াহ্নে এক ধরণের আত্মসংশোধনের চেষ্টা করেন যা সময় সময় কান্ডজ্ঞানহীনতার সীমা ছোঁয়, যেখানে তারা তাদের কাজের নিশ্চিত ও চূড়ান্ত নির্বাচন করে থাকেন, যা গবেষক ও পাঠকদের বিভ্রান্ত করে এবং তারা লেখকদের নিজেরদের করা ঐ নির্বাচনের সাথে সহমত পোষন করেননা ও এর বিরোধী হয়ে ওঠেন। পক্ষান্তরে, হিউজ কিন্তু এমন সময়ে বরাবরের মতই তীক্ষ্ণধার ছিলেন, এবং সম্ভবত শেষ দিককার বছরগুলোতেই হিউজ তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিচক্ষন ছিলেন, তাঁর ‘বার্থডে লেটার্স’ প্রকাশনার সময় তাই ইঙ্গিত করে। তাই, নিজের যে কবিতাগুলোকে তিনি সার্থক ভেবেছিলেন, তার মধ্য থেকে যে চূড়ান্ত নির্বাচন করেছিলেন, সেই নির্বাচনের উপর আস্থা রাখার সবরকম কারণই রয়েছে। হিউজের সেই নির্বাচনকে পূনর্বিবেচনা করা আমার এই সংকলনের উদ্দেশ্য নয়, বরং তাকে আরো পরিমার্জিত করে নিবিড় কাঠামো দেয়া এবং সেই সমীকরণে অনুঘটকের কাজ করে এমন কিছু উপাদান সংযোজন করা আমার লক্ষ্য। আদর্শ পরিস্থিতিতে আমি এই সংকলনে হিউজের নাটকের উপর কিছু কাজ, এবং কমপক্ষে একটা ছোটগল্প, খুব সম্ভবত – ‘দ্যা ডেড ফল’ সংযোজন করতে চাইতাম। কিন্তু এ মুহূর্তে তাঁর কবিতার উপর মনোযোগ দেবার জন্য চাপ রয়েছে। আশা করি যে পাঠকরা হিউজের অন্যধরণের সৃষ্টিকর্ম অন্বেষনেও উদ্বুদ্ধ হবেন, যেমন হিউজ নাটক আর গদ্যরচনার মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের প্রতিভার সীমা পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন।

যখন হিউজ জনমত প্রভাবিত করতে সক্ষম এমন ব্যক্তিবর্গের সুদৃষ্টিতে ছিলেননা, এমনকি তখনো তিনি যে মাত্রায় সকলের মনোযোগ আকর্ষন করতে পারতেন, তা পাবার জন্য অনেক কবিই প্রানান্ত চেষ্টা করবেন। তাঁর বইয়ের গভীর সমলোচক থেকে শুরু করে তাঁর বাড়ী আর পাশের গোরস্তানকে আলাদা করা সীমানা নির্ধারণী দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে জানালার মধ্য দিয়ে তাঁর ফটো তোলার চেষ্টা করা সব সাংবাদিক, সকলেই হিউজের প্রত্যেকটা পদক্ষেপে নিশ্চিত আকর্ষন অনুভব করতেন। প্রকৃ্তপক্ষে তাঁর প্রথম বই, ‘হক ইন দ্যা রেইন’ এর প্রকাশের মুহূর্ত থেকেই হিউজ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। নিজের লেখায় এমন কিছু বিষয়ের উপর তিনি তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ করেন যা তাঁকে তাঁর সমসাময়িকদের থেকে আলাদা করে তোলে। পশুর সহজাত প্রবৃত্তি, প্রাচীন গাঁথা, প্রকৃতির বহিঃপ্রকাশ– ইত্যাদির প্রতি হিউজের আগ্রহ তাঁর সমসাময়িক কবিদের গতানুগতিক সামাজিক অনুসন্ধিৎসা থেকে সম্পুর্ণ ভিন্ন ছিলো। সতীর্থ কবিদের প্রতিমুহূর্তে নিত্যনতুন শব্দ উদ্ভাবনের চেষ্টার বিপরীতে বাইবেল থেকে কৃ্ষিজ উপভাষার ব্যবহার, হিউজকে সতীর্থদের থেকে বিস্তর দূরত্ব এনে দিয়েছিলো। ইউরোপীয় কবিতার প্রতি তাঁর আগ্রহ নিঃসন্দেহে হিউজের নিজস্ব কাব্যস্বরকে অবয়ব দিতে ও পরিণত করতে সাহায্য করেছিলো; বিশেষ করে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘ক্রো’তে, যেখানে হিউজ ছিলেন প্রবল, অনমনীয় আর জগতের চূড়ান্ত ধংস্বের বার্তাবাহক।

কৌতুহলোদ্দীপক হলো যে তাঁর কবিতায় জটিল দার্শনিক বিষয়বস্তুর উপস্থাপন্ন সত্ত্বেও বৃটেনের স্কুলের শ্রেণীকক্ষেই হিউজ তাঁর সবচেয়ে গুনমুগ্ধ পাঠক পেয়েছিলেন। একটা মাধ্যমিক স্কুলের সাধারণ ও মামুলি ছাত্র হিসেবে হিউজের কবিতার মাধ্যমে ইংলিশ সাহিত্যে আমার মুগ্ধ হবার যে প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো, সে অভিজ্ঞতা আমার সমবয়সীদের অনেকেরই হয়েছে। আর আমাদের শিক্ষকরা যেভাবে তাঁর কবিতা পাঠ ও ব্যাখ্যা করতেন, তাতে তারা, হিউজের কবিতায় তাদের অসীম উৎসাহ এবং আমাদের সাথে তা ভাগাভাগি করে নেবার প্রবল আগ্রহকে লুকাতে পারতেন না। তাঁর ‘উইন্ড’, ‘দ্যা বুল মোজেস’, ‘দ্যা হর্সেস’, এবং অবশ্যই ‘হক রুস্টিং’ এর মত কবিতাগুলো যে শুধু একটা পুরো প্রজন্মের কল্পনার জগতকে উসকে দিয়েছিলো তা নয়, বরং আমার মতো কারো কারো জন্য তা হয়ে উঠেছিলো ‘রোসেট্টা স্টোন’ এর মতো, যার মাধ্যমে আমরা হঠাত আমাদের চারপাশের পৃথিবীর ভাষা বুঝতে, অনুধাবন করতে, আর অনুভব করতে শুরু করি। হিউজের কবিতার এটা একটা বিশেষ গুন – যা কিনা অন্যান্য সব সেরা কবিদের মধ্যেও দেখা যায়– হলো, স্পষ্টতা ও দূর্বোধ্যতা স্থির ও স্বচ্ছ জলাশয়ের মতোই সহাবস্থান করে যাতে একজন অনায়াসেই তার গভীরতা দেখতে পায়। কেউই কখনো হিউজের কবিতাকে সরল বা হালকা মেজাজের বলে অভিযোগ করবেনা, তবু তাঁর কবিতায় এমন এক নৈকট্য রয়েছে যে ছাত্ররা– এমনকি অল্প বয়সের ছাত্ররাও, তার মধ্যে একটা আকর্ষণ ও সত্যতা খুঁজে পায়। কৃষ্ণ বিবরের মতোই তা পাঠককে আকর্ষণ করে যার ফেরত না আসবার সীমারেখাটা তাৎক্ষণিক, কিন্তু তীব্রতা অসীম এবং যা পাঠককে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেয়। নূহনবীর তালিকার মতো হিউজের কবিতায় জীবজগতের প্রাণীদের সমাহার নিঃসন্দেহে অল্প বয়সী পাঠকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ। হিউজ ছিলেন এক নিবেদিত শিক্ষাবিদ। স্কুল ব্রডকাস্টিং বিভাগের অনুষ্ঠানের জন্য লেখা তাঁর রচনাগুলোর সংকলন -  ‘পোয়ট্রি ইন দ্যা মেকিং’,  নবীন বা প্রতিষ্ঠিত যাই হন না কেন, যে  কোন বয়সের কবির জন্য এক মূল্যবান পাঠ্য। তাঁর সৃষ্টির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হলো শিশুদের জন্য লেখা বই। তাঁর সৃষ্টির একজন একনিষ্ঠ অনুগামী হিসেবে তাঁর এসব রচনাকে নিছক দূর্ঘটনা বা আবেগপ্রসূত রচনা হিসেবে দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব, বরং আমি এগুলোকে দেখি তাঁর কৌশলগত রচনা হিসেবেই; দেখি হিউজের স্বজ্ঞা, নিষ্পাপতা আর সম্ভাবনার জগতে প্রবেশ করবার উচ্চাশার অংশ হিসেবে।

বিক্ষিপ্ত বিশেষণ বাদ দিলে, আমি হিউজের সৃষ্টিকর্মের কোন বর্ণনা ছাড়াই এই রচনার এদ্দুর লিখে ফেলেছি। হয়তো তাঁর কবিতাই এখন তাঁর সৃষ্টির পরিচয়, যার আর কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই; হয়তো ডজনখানেক বইয়ে প্রতিভাত হিউজের সৃষ্টির একটা সারবত্তা টানা এই রচনার পরিসরের বাইরে।  অথবা, আমাদের অনুভবের যে সতত বিস্তার কবিতার দ্বারা ঘটবার কথা, হয়তো কাব্যিক উদ্দেশ্য ও অর্জনের যে কোন চুলচেরা বিশ্লেষণ, তার পরিবর্তে আমাদের কেবলই এক সংকীর্ণ ব্যাখ্যার দিকে তাড়িত করে। সে যাই হোকনা কেন, হিউজের কবিতার সীমা এতটাই ব্যপ্ত যে আংশিক কোন সারবত্তা তাঁর কবিতার প্রতি সুবিচার করবেনা। ইতিহাস ও প্রাক-ইতিহাসের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ, মানব কল্পনার সার্বভৌম কাঠামোর পক্ষে তাঁর যুক্তি, প্রকৃ্তির বিষয়ে তাঁর নিজস্ব ভাবনা, প্রায় আচ্ছন্নের মতো প্রথম মহাযুদ্ধের প্রতি তাঁর  আসক্তি, কবিতার মধ্য দিয়ে কবিদের যৌন-পূর্বরাগ চর্চার বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষন– এগুলো হলো পরস্পরের সাথে গ্রন্থিত জট পাকানো তাঁর কয়েকটি দিক মাত্র। যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগুলোর বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

কিন্তু একটা বিষয় আরো ব্যাপক আলোচনার দাবী রাখে। আর তা হলো, অতিপ্রাকৃ্ত ও আধিভৌতিক বিষয়ের প্রতি হিউজের প্রবল আকর্ষণ। খুব অল্প বয়স থেকেই হিউজ যা কিছু অপার্থিব তার প্রতি এক অপ্রচলিত আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পছন্দের পড়বার বিষয় নির্বাচন এবং এ সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক পাঠের মধ্য দিয়ে হিউজের এই আগ্রহ আরো প্রবল হয়।  যে কেউই, তাঁর সাথে যতটুকু সময়ই কাটান না কেন, একথা প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করবেনঃ তাঁর আলাপচারিতা অপার্থিব আর অলৌকিক বিষয়ে ঠাঁসা থাকতো। এর মধ্যে ঢিল-ছোঁড়া ভুত থেকে শুরু করে ক্ষুদে পরী, ডাকিনীবিদ্যা থেকে ওইজা বোর্ড, জোর্তিবিদ্যা থেকে মৃতের আত্মা হাজির করা, জলে ডোবা থেকে ভবিষ্যত বলা এবং আরো অদ্ভুত বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এগুলোকে সহজেই কবির এক ধরণের ভেলকিবাজি হিসেবে উপেক্ষা করা যায়। কবিতায় এন্তার বিষয়বস্তু যোগানো ছাড়া যার আর কোন সাহিত্যিক মূল্য নেই, অথবা বলা যায়, ভবিষ্যতে ডাকিনীবিদ্যার একজন তান্ত্রিক হিসেবে কবির গ্রহনযোগ্যতাকে স্ফীত করা ছাড়া যার আর কোন উপযোগিতা নেই।  কিন্তু হিউজ এমন কেউ ছিলেন না যিনি কোন কারণ ছাড়াই বা হেলাফেলায় তাঁর আগ্রহের বিষয়ে মনোনিবেশ করবেন। গুপ্তবিদ্যায় তাঁর পড়াশুনা তাঁর কাছে তাঁর কাজের দরকারী অংশ বৈ কম কিছু ছিলোনা। কবি হিসেবে নিজের ভূমিকা আর প্রাচীন কবির (Shaman) ভূমিকাকে হিউজ একইভাবে দেখেছিলেন। এমন কি কবিতার অধিবিদ্যামূলক সম্ভাবনার বাইরেও হিউজ কবিতাকে দেখেছিলেন এমন এক লেখনী হিসেবে যার কিনা নিরাময়ের ও রূপান্তরের ক্ষমতা রয়েছে। তিনি সংযোগ করবার ক্ষমতার পরিবর্তে আরো বেশী কিছু হিসেবে কবিতাকে দেখেছিলেনঃ কবিতাকে পরস্পরের সংস্পর্শে আসার অথবা ইন্দ্রিয়গত উপলব্ধি করবার এক ধরণের সেতু হিসেবে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যেখানে কাব্যরস আর পাঠক কবিতার মধ্য দিয়ে পরস্পর, পরস্পরকে অধিকার করে নেবে, আর কবি যেখানে কাজ করবেন আধিভৌতিক মাধ্যম হিসেবে। আর ভাষাকে তিনি দেখেছিলেন বিশ্বজগতের সবচেয়ে কম অনুধাবিত শক্তি হিসেবে। ভাষাকে দেখেছিলেন বৈদ্যুতিক, মাধ্যাকর্ষণিক, আনবিক, চৌম্বক শক্তির একই কাতারে, যা কিনা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করা যায়। তিনি খুব গুরুত্বের সাথে কবিকে তান্ত্রিক হিসেবে দেখবার দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহন করেছিলেন। কোন ধরণের বিন্দুমাত্র অস্বস্তি ব্যতিরেকেই তাঁর অনেক কবিতাই যেন আধ্যাত্মিক জগতে এক অলীক ভ্রমন, ‘অন্য পাড়ে’ সফর, যেখানে হিউজ তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুর প্রকৃ্তির মধ্যে দিব্যি বাস করতে পারতেন, তা সেই বিষয়বস্তু একটা প্রাণী, খনিজ পদার্থ বা বনস্পতি, অথবা একটা  জাগুয়ার বা তুষার কণা বা এক প্রস্তরাকীর্ণ পর্বতচূড়া, যাই হোকনা কেন। নিজের কর্তব্য সম্পর্কে তাঁর একটা পরিস্কার ধারণা ছিলো, এবং সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পাঠকের প্রত্যয় তৈরি করা। হিউজ তাঁর কন্ঠস্বরের সামর্থ্য ও কতৃ্ত্ব সম্পর্কে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল ছিলেন, তাঁর ব্যক্তিত্বের কথা নাহয় নাই বা বলি। আর নিজের এসব গুনাবলীর সদব্যাবহারই তিনি করেছিলেন। এর সবই তাঁর কাজের অংশ ছিলো। তাঁর উপর আস্থা রাখতে মানুষ বাধ্য হোতো। আজকের দিনে আমাদের কাছে ম্যাজিক শব্দটা কেউ তার টুপি থেকে খরগোশ বা আস্তিন থেকে তাস বের করছে - হাতসাফাইয়ের এমন এক দৃশ্যেকল্পের অবতারণা  করে। কিন্তু হিউজের কাছে ম্যাজিক ছিলো তাঁর লেখা। একটা পরিস্কার সাদা কাগজে তিনি কতগুলো ছোট চিহ্ন আঁকতেন, আর সেইসব চিহ্নগুলো, কোন না কোন ভাবে, একটা পাখী, একটা ইল মাছ, অশ্বশাবক, নেকড়ে অথবা একটা  ভালুকের বস্তুগত বা আচরণগত জীবন্ত বিবরণ হয়ে উঠতো। কখনো কোনো যাদুকর এর থেকে বড় কোনো ম্যাজিক দেখাতে পেরেছে কি?

আমার জন্য হিউজ ছিলেন পাহাড় পেরিয়ে ওপাশের ইয়র্কশায়ার উপত্যাকার মানুষ, আর তাঁর কবিতা আমার মধ্যে বই পড়বার তৃষ্ণা জাগাতো। পরবর্তীতে আমার গৃহকাতরতা আমাকে তাঁর লেখায় টেনে নিয়েছে। ইতোমধ্যেই তাঁর কবিতা আমাকে লিখতেও অনুপ্রাণিত করেছে। আমি মনে করি, হিউজ এবং আমি পৃথিবীর একই প্রান্তের জন্য স্মৃতিকাতর ছিলাম, এমনকি এই গ্রহের সেই ছোট্ট টুকরোটুকু যদি আমাদের দু’জনের কাছে ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব বহন করে, তাহলেও।

আমি হিউজকে প্রথম দেখি ‘হেবডন ব্রিজ’ এ, স্কুলের একটা শিক্ষা সফরে। সেখানে পোকায় খাওয়া একটা সিনেমা হলের জীর্ণ মখমলের পর্দার সামনে ক্যাচক্যাচে শব্দ করা একটা নড়বড়ে চেয়ারে বসে তিনি তাঁর কবিতা পড়ছিলেন। তার পরের কুড়ি বছরে তাঁর সাথে আমার প্রায় ডজন খানেক বার দেখা হয়েছে – খুব অস্পষ্ট পরিবেশে এবং অদ্ভুত সাহচর্যে। কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে আমাদের দু’জনেরই আগ্রহ ছিলো। কিন্তু আমাদের এই সাক্ষাতগুলো – যদি তাদের সংগায়িত করতেই হয়– তবে তা ছিলো একমুখী এবং ভারসাম্যহীন; কারণ হিউজ নিজেই আমার আগ্রহের একটা বিষয়বস্তু ছিলেন। আমাদের শেষ সাক্ষাতে, তিনি তাঁর ‘টেলস ফ্রম ওভিদ’ বই থেকে তাঁর পাঠের শেষ রেকর্ডিং করছিলেন,আর আমি কাছে বসে শুনছিলাম । এটা ধারণ করা হয়েছিলো তাঁর বাসায় এবং প্রচার করা হয়েছিলো বিবিসি ফোর রেডিওতে। হিউজ, তাঁর মাথাটা মাইক্রোফোনের উপর নামিয়ে এনেছিলেন এবং বিন্দুমাত্র ক্লেশ ছাড়াই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন কথকের মতো – যা তিনি  সত্যিই ছিলেন – পুরো গল্পটা বলে গিয়েছিলেন। সকলেই এখন ঐ ক্যসেটগুলো কিনতে পারেন। ক্যসেটগুলোর চকচকে মোড়ক আর বিজ্ঞাপন স্বত্বেও ওগুলো যেন আমার জন্য এক প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য নিষিদ্ধ নেশার গুনাবলী ধারণ করে। যে কেউই তা মনোযোগ দিয়ে শুনলে শুধু যে হিউজের প্রগাঢ় অশরিরী কন্ঠস্বরই শুনতে পাবেন তা নয়, তারা তাঁর চারপাশের ‘ডেভন’ এর প্রান্তরের অন্য শব্দমালাও শুনতে পারবেনঃ এক সময় একটা ট্রাকটরের শব্দ, তার একটু পর, চার্চের ঘন্টার শব্দ, এবং অবশেষে মঞ্চের অভিনেতাকে দেয়া নির্দেশের মতই একটা কাক রেকর্ডিং করতে থাকা স্টেরিওর এক প্রান্ত থেকে ঢুকে যেন আর এক প্রান্ত দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেছে। এ যেন ছিলো এমন একজন কবির সৃষ্টির প্রতি প্রকৃতির প্রবল স্বীকৃ্তি যার সবচেয়ে বড়ো কীর্তি হলো মানব মস্তিষ্কের  অন্তর্গত কর্ম প্রক্রিয়াকে বাইরের পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করা এবং একই সাথে বাইরের পৃথিবীকে মানুষের মননে প্রোথিত করা।

আসাদ আলম সিয়াম: কবি ও অনুবাদক। 

আসাদ আলম সিয়াম এর আরও লেখা পড়ুন:

আসাদ আলম সিয়াম-এর একগুচ্ছ কবিতা

সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই