লোডশেডিংয়ে বাল্বের আয়ু কমে
শেখ আনোয়ার
প্রকাশিত: ১১:০৯ এএম, ১৯ আগস্ট ২০২২ শুক্রবার আপডেট: ১১:২৪ এএম, ১৯ আগস্ট ২০২২ শুক্রবার
আমাদের দেশে সর্বমোট যে সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম তা দিয়ে আমাদের দেশের মোট চাহিদা মেটানো সম্ভব। তবে বর্তমান বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতির জন্য সকল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র সম্পূর্ণ ক্ষমতার দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয় না কারণ চলমান জ্বালানি সংকটে যন্ত্র চালানোর সমস্যার জন্য কোনো কোনো সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। তখন প্রয়োজনের তুলনায় কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ফলে চাহিদার তুলনায় কম বিদ্যুৎ শক্তি থাকায় সব জায়গায় একই সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। তখন কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ অন্যান্য এলাকার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়। বিদ্যুৎ বন্টনের জন্য বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ রাখার এই পদ্ধতিটিকেই আমরা লোডশেডিং বলে জানি।
অধিকক্ষণ বিদ্যুৎ প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন কম হলে চক্রাকারে বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং করা হয়। ফলে প্রত্যেক অঞ্চলে অল্প সময়ের জন্য লোডশেডিং হয় এবং লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে থাকে। বিদ্যুতের সিস্টেম লস ও লোডশেডিং এর প্রভাব দৈনন্দিন সমাজ জীবনে ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। সিস্টেম লসের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে লোডশেডিংয়ের উপর। লোডশেডিংয়ের ফলে যে কোনো গতিশীল একটি ব্যবস্থা হঠাৎ ভেঙে পড়ে। বৈদ্যুতিক ও ইলেট্রনিক্স সামগ্রীর ব্যাপক ক্ষতিও হয়ে থাকে। কলকারখানায় উৎপাদনের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। যেমন আমাদের দেশের গার্মেন্টস কারখানার বিদেশী ক্রেতাদের চাহিদা মোতাবেক মালামাল সাপ্লাই দেয়া সম্ভব হয় না। এর প্রভাবে সাধারণ পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। মূলত: লোডশেডিং ও সিস্টেম লসের ফলে আমাদের সমাজে বিরূপ প্রভাব পড়ে।
অন্যদিকে হুট করে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া ব্যাপক ক্ষতিকর। হুট করে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার বেশ কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। যার অনেকগুলোই দেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই এখন হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করছেন। ঘনঘন বিদ্যুত চলে গেলে অথবা বিদ্যুতের ভোল্টেজ বেশি বা কম হলে অফিস, বাসার কম্পিউটার এর পাওয়ার সাপ্লাই বা মাদারবোর্ড ড্যামেজ হবার ভয় থাকে। সেজন্যে ঘনঘন লোডশেডিং হলে ইউপিএস বাধ্যতামূলক ব্যবহার করতে হয়। একথা সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, কাজ করতে করতে সিস্টেমের পাওয়ার চলে গেলে আপনার করতে থাকা যেকোনো কাজই নষ্ট হবে। আবার শুরু থেকে করতে হবে কাজ।
লোডশেডিংয়ে সবচেয়ে কমন সমস্যা হলো বৈদ্যুতিক বাতির আয়ু। বৈদ্যুতিক বাতির বাল্বের মোটামুটি কমপক্ষে ১০০০ ঘন্টা জ্বলার আয়ু থাকার কথা। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় যে, এর চেয়ে অনেক কম সময়ের মধ্যে বাল্ব বদলাতে হচ্ছে। এর কারণ আবিষ্কার কঠিন নয়। একটি ভালো ভোল্টমিটার দিয়ে বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহটা মাঝে মাঝে মেপে নিলে খুব সম্ভবত: দেখা যাবে- এটা নির্দিষ্ট ২২০ ভোল্টের বেশি রয়েছে অথবা তার চেয়ে কম। ভোল্টেজ যদি বেশি হয় কিংবা কম হয় তাহলে বাল্বের আয়ু অনেকখানি কমে যাওয়ার আশংকা থাকে।
যখন বলা হয় যে বিদ্যুৎ সরবরাহ আমাদের কে ২২০ ভোল্টে বিদ্যুৎ দেবে। সেটি একটি গড় ভোল্টেজ মাত্র। এর ১৪/১৫ ভোল্ট বেশি বা কম ভোল্টেজ দেওয়াটাকে একেবারেই স্বাভাবিক মনে করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বেশি বা কম হবার পরিমাণ অনেক বেশি। সাব ষ্টেশনের কাছাকাছি জায়গা গুলোতে পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। সাব স্টেশনের কাছাকাছি জায়গা গুলোতে ভোল্টেজ বেশি থাকে। আবার দূরে থাকে অনেক কম। দূরের গুলোতে যথেষ্ট ভোল্টেজ যোগাতে কাছের গুলোতে বেশি রাখতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন সময় এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবহারের তারতম্য ঘটে। কম ব্যবহৃত হলে ভোল্টেজ উঠে যেতে পারে।
অতিরিক্ত ভোল্টেজ বিদ্যুৎ খরচ বাড়িয়ে বিদু্যূতের ব্যয় বাড়ায়। আবার সাথে সাথে বাল্বের আয়ু কমিয়ে দিয়েও ক্ষতির কারণ ঘটায়। সেক্ষেত্রে বাতিটি পুড়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। একথা কে না জানে, সাধারণ বাল্বের আকার একটি গোলাকার বলের মতো হয়ে থাকে। যেখানে এক বিশেষ ধরনের গ্যাস দ্বারা পরিপূর্ণ করা থাকে। এর ভেতরে অতি সূক্ষ্ম তার থাকে। যে অংশটি উত্তপ্ত হয়ে জ্বলে সেটাকে ফিলামেন্ট বলে। যেটা একটি সূক্ষ¥ তার হয়ে থাকে। এতে একটি বিশেষ ধাতুর প্রলেপ থাকে। যখন এর মধ্যদিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করানো হয় তখন ফিলামেন্ট প্রচÐ উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ধাতুর অ্যাটম গুলো সেই তাপ শোষণ করতে আরম্ভ করে। এতে পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রনগুলো এক্সট্রা এনার্জি পাওয়ার ফলে অনেক আন্দোলিত হয়ে উঠে। ফলে ইলেকট্রনগুলো অনেক অস্থির হয়ে পরে। কিন্তু আবার তাদের আগের অবস্থায় ফিরে আসা প্রয়োজনীয়, আর আগের অবস্থানে ফিরতে ইলেকট্রনকে কিছু এনার্জি ত্যাগ করতে হয়। এই ত্যাগ করা এনার্জির অংশ হচ্ছে ফোটন, যেটা জ্বলতে থাকে। আমরা জানি, গরম বা উত্তপ্ত জিনিস সর্বদা আলো সৃষ্টি করে। এজন্যই দেখা যায়, সাধারণ বৈদ্যুতিক বাল্ব গুলো প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে থাকে। হাতে ছোঁয়া একেবারেই অসম্ভব হয়। তাই হঠাৎ বিদ্যুৎ বেশি হলে বা ভোল্টেজ বেড়ে হলে এসব বাল্ব অনেক সময় বিস্ফোরিত হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, ভোল্টেজ মাত্র ১২ ভোল্ট বাড়লেই বাল্বের আয়ু অর্ধেক হয়ে যেতে পারে। কাজেই সাধারণ স্বাভাবিক বাড়াতেই আমরা প্রাপ্য আয়ুর অর্ধেকের বেশি আশা করতে পারিনা। অতিরিক্ত বাড়ার তো কথাই নেই।
লোডশেডিং বা বিদ্যুতের কম-বেশি ভোল্টেজে বাতির আয়ু কমার জন্য বাতিও কম দায়ী নয়। এক্ষেত্রে সাধারণ বাতি থেকে সিএফএল সম্পূর্ণ আলাদা পদ্ধতিতে কাজ করে। এটি তাপ থেকে আলো উৎপন্ন না করে ফ্লোরেসেন্স নামক এক আলাদা প্রসেস ব্যবহার করে কাজ করে। সাধারণ লাইট বাল্ব ৯০% এনার্জি অপচয় করে আর মাত্র ১০% এনার্জিকে আলোতে পরিনত করে। এখানেই সিএফএলের সবচাইতে বড় সুবিধা। সিএফএলে কোন ফিলামেন্ট থাকে না। আর কিছু উত্তপ্ত করারও প্রয়োজন পড়ে না। এতে থাকে একটি প্যাঁচানো কাঁচের টিউব। টিউবের মধ্যে থাকে আর্গন এবং পারদের বাষ্প মেশানো গ্যাস। টিউবের উপরের দিকে একটি ইলেকট্রনিক সার্কিট লাগানো থাকে। যেটা বিদ্যুৎকে ঠিকঠাক মতো টিউবের মধ্যে পরিচালনা করে। বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের গ্যাস উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং আলট্রাভায়োলেট লাইট (অতিবেগুনি রশ্মি, যেটাকে দেখা যায় না) তৈরি করে। খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এসব বাল্বের প্যাচানো টিউবের ভেতর দিকে সাদা কিছুর প্রলেপ দেওয়া থাকে। এটি ফ্লোরেসেন্ট প্রলেপ। যেটা আলট্রাভায়োলেট লাইটকে ভিজিবল বা দৃশ্যমান আলোকে পরিনত করে। যদিও সিএফএল সাধারণ লাইট বাল্ব থেকে অনেক বেশি এনার্জি সেভিং করতে সক্ষম তারপরেও এর কিছু অসুবিধা রয়েই যায়। যেমন- সিএফএলও কিন্তু এক সময় আপন মনে কাজ করা বন্ধ করে দেয় বা নষ্ট হয়ে যায়। এর প্যাচানো টিউবের উপরের অংশে ইলেকট্রনিক সার্কিট লাগানো থাকে। ফলে এটিকে রিসাইকেল করাও অনেক দুষ্কর হয়ে উঠে। আবার এর টিউবের মধ্যে থাকে পারদ। যেটা সম্পূর্ণই বিষাক্ত!
ডিজিটাল যুগে সিএফএল এর সবচাইতে ভালো বিকল্প হচ্ছে এলইডি বাল্ব। এলইডি আরো বেশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী। সিএফএল থেকে একটু বেশি লাস্টিং করে। আর পারদের তো কোন প্রশ্নই আসে না। সবচাইতে ভালো কথা হচ্ছে এই বাল্ব অন করার সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাক্সিমাম ব্রাইট হয়ে যায়। যেখানে সিএফএল গ্যাস গরম করতে কিছুটা সময় নেয়। এর সেমি কন্ডাকটরের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন প্রবাহিত হলেও শেষে কোন ফিলামেন্ট না থাকায় এই বাল্ব গরম হয় না। সাধারনত ১.৫ ভোল্ট ডিসি (ডাইরেক্ট কারেন্ট) তে চলে। যেহেতু এটি অনেক কম ভোল্টেজে চলতে পারে, তাই বিদ্যুৎ খরচ কম হয়। এই বাল্ব অতি ভোল্টেজে বিস্ফোরিত হয় না এবং কম ভোল্টেজে নিভু নিভু করে আলো দেয়। তবে এই বাল্বের আয়ু অনেক কম হয়ে থাকে।
মানব সভ্যতার বর্তমান অগ্রগতির যুগে বিদ্যুতের ভ‚মিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিদ্যুতের উপর এতোটাই নির্ভরশীল যে বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা কোনো কিছুই করতে পারিনা। বিদ্যুৎ আমাদের বাতি জ্বালায়, পাখা ঘোরায়, কলকারখানার যন্ত্রপাতি চালু হয়, রেডিও, টেলিভিশন, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, মোবাইল, হিটার, রেফ্রিজারেটর, ওভেন, কম্পিউটার, এসি ইত্যাদি তড়িৎ উপকরণ ব্যবহার করতে পারছি। সুতরাং এর ব্যবহারকে ভালো ভাবে বুঝতে হলে আমাদের এর কিছু সাধারণ কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে এবং যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে এর অপচয় রোধ করতে হবে। আসুন, বিদ্যুৎ ব্যবহারে নিজে আরও যতœবান হই। অন্যদের সচেতন হতে সাহায্য করি।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।