সুঁই চিকিৎসা
শেখ আনোয়ার
প্রকাশিত: ১১:৩১ এএম, ২০ নভেম্বর ২০২০ শুক্রবার আপডেট: ০১:৪৩ পিএম, ২০ নভেম্বর ২০২০ শুক্রবার
ছোটবেলায় রূপকথার গল্পে সুঁচ রাজপুত্রের কাহিনী আমরা পড়েছি। সমস্ত শরীরে সূঁচ বিদ্ধ অবস্থায় অচেতন হয়ে থাকে রাজপুত্র। রাজকন্যা একটি একটি করে সুঁচ তুলে তুলে রাজপুত্রের ঘুম ভাঙায়। আপাতদৃষ্টিতে অবাস্তব মনে হলেও ‘আকুপাংচার’ তত্ত্বের সাথে মিলিয়ে দেখলে কাহিনীটিকে অতটা অবাস্তব মনে নাও হতে পারে। সাধারণভাবে ‘আকুপাংচার’ অর্থ হচ্ছে শরীরে অতিসুক্ষ্ম সুঁচ বিদ্ধ করে শরীরবৃত্তীয় কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করা।
পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ‘আকুপাংচার’কে বলা হয় নতুন বিকল্প ধারার চিকিৎসা পদ্ধতি। অথচ পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘আকুপাংচার’ একটি সফল চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ‘আকুপাংচার’ মূলত চাইনিজ চিকিৎসা পদ্ধতি এবং এর চাইনিজ প্রতিশব্দ হচ্ছে চ্যান-চ্যান। যার অর্থ হচ্ছে ছিদ্র করা। আকুপাংচার সম্পকির্ত প্রথম তথ্য পাওয়া যায় চার হাজার সাত’শ বছরের পুরনো ‘প্রাচীন হুয়াং-ডি-নেই-জিং’ নামক সম্রাটের ‘আভ্যন্তরীণ ওষুধ’ শীর্ষক গ্রন্থে। এই গ্রন্থটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম চিকিৎসা সম্পর্কিত গ্রন্থ। চাইনিজ চিকিৎসা পদ্ধতির জনক হিসেবে খ্যাত শেন নাং প্রদত্ত চিকিৎসা তত্ত্বের চাইতেও এই গ্রন্থটি বেশি পুরনো। ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের চারশত বছর আগে শেন নাং রক্ত সংবহন তন্ত্র, নাড়ী এবং হৃদপিন্ড সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য লিপিবদ্ধ করেন।
আকুপাংচার হচ্ছে সনাতন চাইনিজ চিকিৎসা বিজ্ঞান (ট্রাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন সংক্ষেপে টিসিএম।) এর একটি অংশ। টিসিএম এর তত্ত্ব অনুসারে একটি মানবদেহ গঠিত হয় চী অর্থাৎ জীবনী শক্তি ইন এবং ইয়াং অর্থাৎ ধনাত্বক এবং ঋণাত্বক শক্তি যেমন- কাঠ, আগুন, মাটি, ধাতু, ও পানি দ্বারা। যদি চী এর প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ, অসম বা অপর্যাপ্ত হয় তবে ইন এবং ইয়াং এর প্রবাহও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ফলে অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। চী প্রবাহিত হয় শরীরের কিছু বিশেষ বিশেষ খাতে। শরীরের উভয় দিকে খাতগুলোর সংখ্যা সমান অর্থাৎ জোড় সংখ্যক। সম্পুর্ণ শরীরে লম্বভাবে চৌদ্দটি মধ্যরেখা রয়েছে। এছাড়া শরীরের উভয় পাশে বারটি করে জোড় সংখ্যক মধ্যরৈখিক অঙ্গ রয়েছে। শরীরের যে সব অংশে মধ্যরেখাগুলো ত্বকের সংস্পর্শে আসে সেই সব অংশই আকুপাংচারের আয়ত্বের ভিতর থাকে। মোট বারটি খাতে তিনশত একষট্টিটি বিন্দু বা আকুপাংচার পয়েন্ট রয়েছে যাদের বলা হয় আকুপয়েন্ট। এই আকুপয়েন্টগুলোতেই সুঁই ঢুকানো হয়। প্রাথমিকভাবে ব্যথা বা অসুবিধা অনুভূত হলেও ধীরে ধীরে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে তা হ্রাস পায়। আকুপাংচারে একমাত্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে সুঁই ঢুকানোর পর যদি তা ভেঙ্গে ভেতরে থেকে যায় বা জীবাণু আক্রান্ত হয়। সাধারণত একবার ব্যবহারের পর সুঁই ফেলে দেয়া হয়।
আধুনিক ইলেকট্রিক আকুপাংচারের ক্ষেত্রে এক ধরনের জ্যাক ব্যবহার করা হয়। যার এক অংশ একটি উদ্দীপক যন্ত্রের সাথে এবং অন্য অংশ সুঁই এর মাথার সাথে যুক্ত থাকে। সুঁই এর অপর অংশ শরীরে প্রবেশ করানো হয়। সুঁই বিহীন আকুপাংচারের ক্ষেত্রে জ্যাকটি সরাসরি শরীরে প্রবেশ করানো হয়। যে কোন বয়সী মানুষই আকুপাংচার করাতে পারে।
বর্তমানে আকুপাংচার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনপ্রাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা। আকুপাংচার এর উপর আয়োজিত বার্ষিক সম্মেলনের সর্বাত্মক সহায়তা করে থাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে দেখা যায় যে আকুপাংচার অনেক রোগেরই একটি সফল চিকিৎসা হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। যেমন- অ্যালার্জি, অ্যাজমা , নার্ভের দূর্বলতা, প্যারালাইসিস, পোলিও , নার্ভের ব্যথা, মাথা ব্যথা, সাইনোসাইটিস, একজিমা, বাতের ব্যথা, নিদ্রাহীনতা, পাকস্থলির ব্যথা, পেপটিক আলসার, ব্রণ এবং চুলপড়া । আকুপাংচার রক্তের শ্বেতকণিকার ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।