অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭

প্রকাশিত: ০৪:১১ পিএম, ১৯ নভেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ০১:৪০ পিএম, ৩০ নভেম্বর ২০২০ সোমবার

শঙ্কিত পদযাত্রা

ধারাবাহিক আত্মকথা

। খ ম হারূন ।

খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।

[পর্ব-৭]

বাসার এলোমেলো অবস্থা, সবকিছু ছড়ানো ছিটানো। কয়েকটি প্রাইজবন্ড মেঝেতে পরে আছে। ১৯৭৯ এর নভেম্বরে এই বাসাতেই সংসার পেতেছিলাম। ঢাকায় আমাদের প্রথম বাসা। অনেক কষ্টে সাজানো। কারন বিয়ের সময় আমরা দুজনই পড়াশুনা করি। জেবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর আমি এনএসডি দিল্লিতে। আমি ফিরে আসার পর বেশ কিছুদিন বাংলামটরে আমার বড় বোনের বাসায় ছিলাম। আর জেবু তখন অনার্স পরীক্ষার্থী, ধানমন্ডিতে তার বড় বোনের বাসায় থাকতো। ইউনিসেফে চাকরি পাবার কারণে আমার পক্ষে একটি আলাদা বাসা নেয়া সহজ হয়ে যায়। সেসময় টিএসসিতে আমার নির্দেশিত নাটক ‘রাজা রাজা খেল্’ এর মহড়া চলছিলো। বন্ধু সিরাজুস সালেকিন (সঙ্গীতশিল্পী, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী) ছিল নাটকের একজন শিল্পী। নাটকের মহড়া শেষে তার মটরসাইকেল নিয়ে মাঝে মাঝে বাসা খুঁজতে বের হতাম। অবশেষে সিদ্ধেশ্বরীর ‘তরুতল’ নামের এই বাসাটা পছন্দ হয়ে যায়। 

বাসাতো পেলাম। কিন্তু হাতে কোনো টাকা নেই। একটা ডাবলবেড, চেয়ার টেবিল, আলমারি- এসব কেনার টাকা কোথায় পাবো! কোনো সঞ্চয় নেই। আমার পিতা অবসরে গেছেন কয়েক মাস আগে। বড়বোন, দুলাভাই, তাদের দুই মেয়ে- লাজুক ও রূনা, অনেক সুন্দর সময় কাটে তাদের নিয়ে বোনের বাসায়। দুলাভাইয়ের ছোটো এক ভাই সোহেল, আমরা একই সময়ে ঢাকায় ভর্তি হয়েছিলাম, সে বুয়েটের ছাত্র ছিলো, ইন্জিনিয়ার হবার পর চাকরী নিয়ে আবুধাবি চলে যায়। ছুটিতে সোহেল তখন ঢাকায়। একদিন সে আমার সাথে সিদ্ধেশ্বরীর বাসাটা দেখে আসে। তারপর অবাক করে দিয়ে সে আমাকে পাঁচ হাজার টাকার একটা বান্ডিল ধরিয়ে দেয়। আমি এই টাকা কিভাবে পরিশোধ করবো, তাই প্রথমে টাকাটা না নেবার কথা বলি। সোহেল বলে, পরিশোধ করার কোনো সময়সীমা নেই। চলেন কিছু ফার্নিচার কিনি আপনার বাসার জন্যে। পরবর্তিতে ঐ টাকা আমি আর পরিশোধ করতে পারিনি, পরিশোধ করার উদ্যোগ নিলেই সোহেল বলতো, সে ঐ টাকাটা আমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলো। 

ফার্নিচারতো হলো, কিন্তু রান্নাবান্নার জন্য অনেক কিছু কেনাকাটা করা দরকার। প্লেট, বাটি, চুলা, হাড়ি, পাতিল ইত্যাদি। অবশেষে আমাকে না জানিয়ে জেবু একদিন তার অবসরপ্রাপ্ত পিতাকে সাথে নিয়ে সোনালী ব্যাংক সচিবালয় শাখায় গিয়ে তার কিছু সোনার অলঙ্কার বন্ধক রেখে চব্বিশশো টাকা নিয়ে আসে। তারপর ঐ টাকা দিয়ে বাসার সব প্রয়োজনীয় ক্রোকারিজ কেনে তার বান্ধবী কিসমতকে সাথে নিয়ে।

অবশেষে ১৯৭৯ সালে নভেম্বর মাসের ১ তারিখে নতুন বাসা ‘তরুতল’ এ থাকা শুরু করি। আমাদের সংসার জীবনের প্রথম বাসা। যার স্মৃতি কখনো ভোলা যাবেনা। সেই বাসা এক বছর পর আজ লন্ডভন্ড। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকি। জেবু যে অলঙ্কারগুলে ব্যাংকে রেখেছিলো, ভাগ্যক্রমে তা রক্ষা পায়। রাতে ঘুমাতে পারিনা। আমি বাসাতে ঢোকার পর ফরিদুর রহমানের একটা চিঠি পাই। সেখানে কিভাবে চুরির ঘটনা ঘটেছে তার বিবরণ ছিলো। আমাকে দিল্লিতে সে চিঠি লিখে জানায়নি কারন সে আমার সুন্দর সময়টা নষ্ট করতে চায়নি।

পরদিন খুলনা গেলাম। জেবু মাত্র চারটা শাড়ি নিয়ে খুলনা গিয়েছিলো। সে ক’টাই সম্বল। বেশ কয়েক বছর এই ক'টি শাড়িই তাকে ব্যবহার করতে হয়েছে। আমিও দিল্লি থেকেও তেমন কিছু আনতে পারিনি। আগে জানলে দু’চারটা শাড়ি নিয়ে আসা যেতো। তাকে চুরি হবার কথা জানাবার পর কতক্ষন সে চুপ করে বসে থাকে, মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করারতো নেই।

বিটিভিতে প্রথম দশ বছর অনেক অর্থ কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছে। ১৯৮২ সালে সিদ্ধেশ্বরীর বাসাটা ছেড়ে দেই। চলে আসি রামপুরায় টিভি ভবনের কাছেই কলিমউল্লাহ সাহেবের ‘আসসালামুআলাইকুম’ নামের একটি বাসার পাঁচতলায়। সেখানেও দুটি রুম, তবে বাসার সামনে প্রশস্ত টেরেস। পাঁচতলা  হওয়াতে অনেক গরম ছিলো ঘরগুলোতে। একটা মাত্র ফ্যান। জেবু এর মাঝে চাকরীর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। কিযী অনেক ছোটো। সরকারি একটা বাসা পাওয়া যায় কিনা সে চেষ্টা করছি। সরকারি বাসা বরাদ্দ দেয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। একটি আবেদনপত্র জমা দেই। 

১৯৮৩, তখন বিটিভির নতুন মহাপরিচালক সাঈদ আহমদ। এম এ সাঈদ এর পর সাঈদ আহমদ। ওনার সাথে আগে থেকেই পরিচয়। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। মহাপরিচালক হবার আগে বিটিভিতে আমার নাট্য বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘বৃত্তের বাইরে’ ও ‘বিশ্ব নাটক’ উপস্থাপনা করতেন। মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করার পর উপস্থাপনায় সাময়িক বিরতি দেন। বিটিভি থেকে চলে যাবার পর আবার উপস্থাপনা শুরু করেন। পরবর্তিতে তার লেখা নাটক ‘শেষ নবাব’ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জন্য আমি পরিচালনা করেছিলাম ১৯৮৯ সালে। 

সাঈদ আহমদকে আগে থেকেই সাঈদ ভাই বলতাম। মহাপরিচালক হবার পরও স্যার বলতে পারিনি। একদিন সচিবালয়ে বাসার জন্য তদবির করে বিটিভিতে এসে সরাসরি ডিজি সাহেবের রুমে ঢুকি। সেখানে বার্তা বিভাগের পরিচালক হুমায়ূন চৌধুরী বসা। সাঈদ ভাই সাধারণত ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলা পছন্দ করতেন। তবে উপস্থাপনার সময় শুদ্ধ বাংলাই বলতেন। ইংরেজীও বলতেন দারুন। তারমতো বাগ্মী পন্ডিত মানুষ কমই পাওয়া যায়। নাট্যকার, নাট্যগবেষক, সেতারবাদক, সরকারি আমলা, তারওপর ভীষন আড্ডাপ্রিয়। মাঝে মাঝেই তার বাসায় বিভিন্ন আড্ডায় উপস্থিত থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ গ্রহন করেছি। 

সাঈদ ভাই আমাকে দেখে প্রথমেই বললেন হুমায়ূন চৌধুরীর কথা। তিনি লিয়েন নিয়ে কুয়ালালামপুর চলে যাচ্ছেন ‘এশিয়া ভিশন’ এর বার্তা প্রধান হিসেবে। অভিনন্দন জানালাম। তিনিও বললেন, তুমিতো কুয়ালালামপুর আসবে মাঝে মধ্যে। ভালোই হবে, আমাকে আগেই জানাবে। এরপর আমি সাঈদ ভাইকে বললাম আমার বাসার কথা। আমি যে আবেদন করেছি তাও বললাম। তিনি আমাকে বসিয়ে সরকারি বাসস্থান পরিদপ্তরের পরিচালক সালামতউল্লাহ সাহেবকে ফোন করলেন। সাঈদ ভাই ফোন রেখে আমাকে বললেন, ‘যাও মিয়া, কাইলই সালামাতউল্লাহর সাথে দেখা কইরবা। কাম হইবো।’

সত্যিই কাজ হয়েছিলো। মহাপরিচালক সাঈদ আহমদের এক টেলিফোনে টিকাটুলির সরকারি ইলিশিয়াম রেষ্ট হাউজের ৮০৮ নাম্বার স্যুইটটি বরাদ্দ পেয়েছিলাম। যেখানে ছিলাম ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত। ঐ বাসায় থাকার সময় অনেক অনেক ঘটনা ঘটে যা আমার পেশাগত জীবনকে অনেক সমৃদ্ধ করে। 

১৯৮৫ সালে জেবু বিসিএস পরীক্ষা দেয়। তখন পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেতে পেতে তিন বছর সময় লাগতো। সে মেধাবী ছিলো। তার বিসিএস পরীক্ষা দেবার প্রায় দু'বছর পর আমার দ্বিতীয় কন্যা বৃতির জন্ম। যেদিন বৃতির জন্ম হয় সেদিনই জেবুর পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। শিক্ষা ক্যাডারের জন্য মনোনীত হয়েছে। তার প্রথম অপশনই ছিলো শিক্ষা ক্যাডার। যাতে ঢাকার বাইরে যেতে না হয়। সামনে তার সাইকোলোজিকাল টেস্ট, হেলথ টেস্ট, পুলিশ ভেরিফিকসন ইত্যাদি। সবকিছু শেষ হলে পোস্টিং। 

১৯৮৭ এর শেষ দিকে, বিটিভির প্রাক্তন মহাপরিচালক এম এ সাঈদ তখন শিক্ষা সচিব। পিএসসি থেকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নাম এসেছে শিক্ষা ক্যাডারের অফিসারদের পোস্টিং এর জন্য। আমি সরাসরি চলে গেলাম সচিবালয়ে। আমার এক বন্ধু বিসিএস কর্মকর্তা এস এম হারুন তখন শিক্ষা সচিবের পিএস। তাকে বললাম আমি সাঈদ স্যারের সাথে দেখা করবো। সে সাথে সাথে ব্যবস্থা করে দিলো। সচিব এম এ সাঈদ আমাকে দেখে খুব খুশী হলেন। বিটিভির অনেক কথা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি জেবুর কথা জানালাম। তিনি সাথে সাথে পি এস হারুনকে ডাকলেন। নাম ও  গ্রেডেশন তালিকা বের করলেন। তাকে বলে দিলেন ঢাকার কোন সরকারি কলেজে লেকচারার পোস্ট খালি আছে দেখতে। 

এম এ সাঈদ সাহেব সব গুরুত্বপূর্ণ কথা তার একটা ডায়রিতে নোট করে রাখতেন। আমি অনেকটা নিশ্চিত হয়ে বাসায় চলে এলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে বন্ধু হারুনের ফোন শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। বললো “শোন, ভাবীর জন্য দুটো কলেজ পেয়েছি একটা মুন্সিগন্জ হরগঙ্গা কলেজ, আরেকটা নারায়নগন্জ তোলারাম কলেজ। ভাবীকে জিজ্ঞাসা কর কোনটায় যাবে। ঢাকা শহরে কোনো কলেজে পোস্ট খালি নেই।" তাই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম তোলারাম কলেজ। আমাদের বাসা টিকাটুলি থেকে বাসে আধা ঘন্টার মধ্যে সে যেতে পারবে নারায়নগন্জ। 

১৯৮৮ জানুয়ারি। এক মাসের একটা কোর্স করতে আমি তখন মালয়েশিয়াতে। ১৯৮৩ এর পর দ্বিতীয়বার এখানে আসা। মনে আছে জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে কুয়ালালামপুর থেকে তিনদিনের জন্য এআইবিডি কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে পেনাং নিয়ে এসেছে। সেদিন ২৮ জানুয়ারি, রাতের খাবার খেয়ে রুমে ঢুকেছি। বেশ রাত। হঠাৎ জেবুর ফোন। হোটেল রিসিপসন থেকে রুমে কানেক্ট করে দিয়েছে। বাসায় আবার কোনো অসুবিধা হয়নিতো! কিন্তু না, সে খুব খুশী মনেই জানালো গতকাল চাকরীর নিয়োগপত্র পেয়ে আজ সকালে সে সরকারি তোলারাম কলেজে গিয়েছিলো যোগদান করতে। মতিন ভাই তাকে গাড়ী দিয়েছিলো। খুব খুশী মনেই সে আমাকে তার চাকুরীর প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলো। 

চলবে...

আরও পড়ুন:

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৬

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৫

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৪

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১