নিরাপদ খাদ্যের টেকসই লক্ষ্য- আমরা কী পারছি?
আহমেদ মুশফিকা নাজনীন
প্রকাশিত: ১০:৪৭ এএম, ১৩ নভেম্বর ২০২০ শুক্রবার আপডেট: ১২:৪৫ পিএম, ১৪ নভেম্বর ২০২০ শনিবার
‘আফা নিশ্চিন্তে লন। মেঘনা নদীর মাছ এইডা। কোনো ভেজাল নাই। দেখেন কানের ফুলকা দেখেন। কেমন লাল টকটইকা’। রাজধানীর কারওয়ানবাজারে মাছওয়ালার এমন জোর আশ্বাসেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ফারহানা নামের এক ক্রেতা।
ফরমালিন দেওয়া মাছ নাতো! মনে ভাবেন তিনি। অসহায়ের মতো এ দোকান সে দোকান ঘুরতে থাকেন। তার ছেলে মাছ ছাড়া ভাত খেতে চায় না। কিন্তু তিনি সন্তানকে ফরমালিন দেওয়া মাছ খাওয়াবেন তাও তো হতে পারে না। সন্দেহ হওয়ায় তিনি মাছ না কিনেই বাড়ি চলে যান।
মগবাজারের বাসিন্দা আশফাক উদ্দিন যান শান্তিনগর বাজারে। মাংসের দোকানে গিয়ে ভালো করে পরখ করে দেখেন, মাংস গরুর নাকি মহিষের। যতই দোকানদার বলে স্যার গরুর খাঁটি মাংস। ওনার বিশ্বাস হয় না।
লালশাক বাসায় আনার পর তা ধোয়ার পর লাল রঙ বের হওয়ার পর থেকে আর শাকই খান না গৃহবধূ ঊর্মি। অন্যদেরও খেতে নিষেধ করেন। সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকেন কী খাচ্ছেন ভেবে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আয়শা। তিনি জানান, তার মেয়ে কাঁঠাল খেতে খুব পছন্দ করে। গত গ্রীষ্মে কদিন কিনতেও গেছেন। কিন্তু কেমিক্যাল দিয়ে পাকানোর ভয়ে আর কেনা হয়নি। কেন নিরাপদ খাবার আমরা সন্তানদের খেতে দিতে পারব না ? ক্ষুব্ধ প্রশ্ন তার!
খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আজ অনেক নাগরিকেরই মনে ভীতি। মাছে-ভাতে বাঙালির প্রবাদ ঘুচে যাচ্ছে যেন দিন দিন। কি যে খাচ্ছি! সারাক্ষণ মনে ভয়। নিরাপদ খাদ্য কোথায় পাই! বাঙালির প্রিয় সুস্বাদু মাছগুলো দিন দিন পরিণত হচ্ছে বিষে। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা মাছের পচন রোধে ফরমালিন মিশিয়ে দিচ্ছেন। আবার বিষাক্ত লেগুনে চাষ করা হচ্ছে মাছ। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। অপরিণত টমেটো, আম, কাঁঠাল, জাম, কলা পাকাতে দেওয়া হয় বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। ফরমালিন দেওয়ার কারণে পাকা আপেলগুলো দিনের পর দিন থাকে টাটকা। নষ্ট হয় না টমেটো, বেগুন, পটল, দুধ। প্রশ্ন জাগে মনে, আমরা খাচ্ছি কী তা হলে?
কি খাচ্ছি? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়- দিনাজপুরে চালে সুগন্ধ ও সাদা দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয় নষ্ট কনডেন্সড মিল্ক। এ ভয়াবহ চিত্র সারাদেশজুড়ে। লাভের আশায় অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব অনৈতিক কাজ করে চলেছেন দিনের পর দিন।
আশির দশকে এ দেশে ফরমালিন গবেষণাগার এবং শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরে নব্বইয়ের দশকে দেশে মাছের চাহিদা এবং ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে মাছ আমদানি করা হয়। আর এরপর থেকেই মাছ এবং খাদ্যে ফরমালিন মেশানোর বিষয়টি আলোচনায় আসে। আমদানিকৃত মাছের মাধ্যমেই দেশে ফরমালিন ব্যবহার শুরু হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান সাধারণত মাছ-মাংস টাটকা রাখতেই ফরমালিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে বড়ো মাছ যেমন- রুই, কাতলা, চিতলে ফরমালিন মিশিয়ে টাটকা রাখা হয়। এছাড়া কেঁচকি, মলা, ঢেলা, টেংরা এসব ছোটোমাছেও দেওয়া হচ্ছে ফরমালিন। সোয়ারীঘাটের এক মাছ ব্যবসায়ী জানান, বড়ো মাছের শরীরে সুঁই দিয়ে ফরমালিন দেওয়া হয়। ছোটোমাছের ক্ষেত্রে আগে একটি পাত্রে পানি দিয়ে তাতে তরল ফরমালিন মিশিয়ে সেই পাত্রে মাছ চুবিয়ে ফরমালিন মেশানো হয়। যে কাপড় দিয়ে মাছে ঘন ঘন পানি দেওয়া হয় সেই কাপড়টিও ফরমালিনের পানিতে ভেজানো থাকে।
শুধু মাছ নয়, ফরমালিন এখন ফলমূল, শাকসবজি থেকে শুরু করে প্রায় সব খাবারেই মেশানোর অভিযোগ উঠেছে। আঙ্গুর, আপেল ও নাশপাতির ক্ষেত্রে এসব ফল ফরমালিন মেশানো পানি দিয়ে ধুয়ে বিক্রেতারা দোকানে সাজিয়ে রাখেন।
শান্তিনগর বাজারের ফল ব্যবসায়ী জামালের দাবি, আমদানির আগেই এসব ফলে ফরমালিন দেওয়া হয়। এজন্য আমদানিকারকরাই দায়ী।
বিক্রেতাদের এক্ষেত্রে তেমন কিছুই করার থাকে না। নিরাপদ খাদ্য নিয়ে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সচেতন হলেও নিম্ন আয়ের মানুষদের ভাবার অতটা সময় যেন নেই। পরিবারের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে বাজার থেকে সস্তার জিনিস খোঁজেন তারা। সেখানে কীটনাশক বা ফরমালিন আছে নাকি নেই তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও কিছুই করার নেই তাদের। ফলে মানুষের শরীরে ঢুকে যাচ্ছে বিষ। এতে বিশেষ করে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
"ফরমালিন দেওয়া যে কোনো খাবার খেলে তা পাকস্থলিতে গিয়ে প্রদাহের সৃষ্টি করে। ফলে এসিডিটি বেড়ে যায়। হজমে গোলমাল দেখা দেয়। গ্যাস্ট্রিক ও আলসার হয়। ফরমালিন লিভারের এনজাইমগুলোকে নষ্ট করে দেয়। এমনকি লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিও দেখা দিতে পারে। গর্ভবতী মা, গর্ভের শিশু, ছোটো বাচ্চা, হাঁপানি রোগীর জন্য এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক।"
ডা. লেলিন চৌধুরী
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষকে খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগতে হচ্ছে।
নাগরিকদের জনস্বাস্থ্যের কথা ভেবে, খাদ্যকে নিরাপদে রাখার জন্য সরকারের উদ্যোগসমূহ:
'নিরাপদ খাদ্য বিল'- ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পাস হয়।
'জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা' ২০১৫ সালে গৃহীত এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ। যে লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম একটি হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য।
'ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন' ২০০৯ সালে এই আইন প্রণীত হয়
'নিরাপদ খাদ্য আইন' ও ‘নিরাপদ খাদ্য বিধিমালা’ প্রণীত হয় ২০১৩ সালে।
নিরাপদ খাদ্য আইনের অধীনে ২৩ ধরনের অপরাধে এক থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও চার লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। যদিও পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে এ ধরনের অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এমনকি মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য বিধিমালায় খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে।
কিন্তু আদৌ কি তার তেমন প্রয়োগ হচ্ছে? মাঝে-মাঝে অভিযান চালিয়ে ভেজালকারীদের জরিমানা করা হয়। পচা নষ্ট খাবার ফেলে দেওয়াও হয়। কিন্তু কিছুদিন পর আবার সেই চক্রগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। কি খাই, কোন খাবার খাই এ চিন্তায় ভালোমতো খাবারই খাওয়া হয় না। এর জন্য বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নতুন প্রজন্মকে। বিষযুক্ত ভেজাল খাবার খেয়ে তারা বেড়ে ওঠছে।
সুস্থ নাগরিক গড়ে তুলতে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে এখনই তাই নেওয়া দরকার কঠোর পদক্ষেপ। নয়তো সরকারের-২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে ভেজাল প্রতিরোধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। আমাদের দেশেও বেশকিছু আইন রয়েছে। কিন্তু আমরা নাগরিকরা ভোক্তা অধিকার নিয়ে কতটুকু সচেতন?
একথা সত্য যে, শুধু সরকারের একক উদ্যোগে জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব নয়। তবে মূল ভূমিকা সরকারকেই নিতে হবে। কারণ দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনধারণের জন্য খাদ্যের সংস্থান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রকেই নাগরিকদের জন্য খাদ্যের সংস্থানের পাশাপাশি সে খাদ্য যেন নিরাপদ হয় তা নিশ্চিত করতে হয়। বর্তমানে পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই নিরাপদ খাদ্যকে ভোক্তার অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়। এর ব্যত্যয় দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আমাদের দেশে আইন থাকলেও তার তেমন প্রয়োগ হয় না। তবে জনগণের স্বার্থে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্য ভেজালমুক্ত করতে হলে আইনের কঠোর বাস্তবায়নের পাশাপাশি দরকার সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন। নিরাপদ খাদ্য ইস্যুতে বাড়াতে হবে জনসম্পৃক্ততা। দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। এছাড়া সরকার কতটা কার্যকর ও জবাবদিহির সঙ্গে খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করছে তার নাগরিকদের জন্য সে তথ্যগুলোও আজ জানা দরকার। তাই প্রয়োজনীয় নীতিমালার পাশাপাশি যদি জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, সমতা ও বৈষম্য দূর করা যায় তবে দেশে খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে এবং তাহলেই ফারহানার মতো মায়েরা নিশ্চিন্তে তাদের সন্তানের মুখে তুলে দিতে পারবেন যে কোনো খাবার। গড়ে উঠবে সুস্থ, স্বাস্থ্যবান ভবিষ্যত প্রজন্ম। পিআইবি ফিচার।