শুভ জন্মদিন
কে বলে তুমি নেই!
সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:০৫ এএম, ১৩ নভেম্বর ২০২০ শুক্রবার আপডেট: ০১:০৫ এএম, ১৩ নভেম্বর ২০২০ শুক্রবার
হুমায়ুন আহমেদ [ছবি সংগৃহিত]
অনেক নেই-এর এই দেশেও ক্ষণজন্মা এমন কেউ কেউ থাকেন, যারা নিজেই হয়ে ওঠেন ইতিহাস। পরের প্রজন্মের কাছে আলোকবর্তীকার মতোন। বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে হুমায়ুন আহমেদ তেমনই একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। ৬৪ বছরের জীবনে ৪০ বছরই তিনি বিচরণ করেছেন সাহিত্যের বিচিত্র জগতে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক হিসেবে এখন পর্যন্ত উচ্চারিত তারই নাম। তিনি হুমায়ুন আহমেদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রের শিক্ষক হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্যের টানে অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর লেখক ও নির্মাতা হয়েছিলেন। ছোটগল্প, উপন্যাস লিখে গেছেন আমৃত্যু। নাটক, চলচ্চিত্র তৈরি করে চারচৌকের বাক্স আর সেলুলয়েডের ফিতায় আটকে রেখেছেন দেশের মানুষকে। যখন যে মাধ্যমে হাত দিয়েছেন, এসেছে চূড়ান্ত সাফল্য, খ্যাতি আর তুলনাহীন জনপ্রিয়তা।
১৯৮৩ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার কেন্দুয়ার কুতুবপুর গ্রামে লেখকের জন্ম। পারিবারিক আবহতেই ছিল লেখালেখি আর সঙ্গীত চর্চা। বাবা নাম রেখেছিলেন কাজল। এসএসসি, এইসএসসিতে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া ছেলেটি ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রে। পাস করে বেরুবার পর অধ্যাপনা শুরু প্রথমে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে নিজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডি করেছেন আমেরিকার নর্থ ডাকোটা ইউনির্ভাসিটি থেকে। কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধার এই সন্তান ফিরে আসেন দেশের মাটিতেই।
সত্তরের দশকে ছাত্র বয়সেই হুমায়ুন আহমেদের লেখালেখির শুরু। প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' দিয়ে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম লেখাই জয় করে নেয় পাঠকের মন, নজর কাড়ে সমালোচকদের। এরপর আর থেমে থাকেননি, লিখেছেন দুশোরও বেশি উপন্যাস আর গল্প। শঙ্খনীল কারাগার, এইসব দিনরাত্রি, সৌরভ, অপেক্ষা, কবি, নীল অপরাজিতা, সবাই গেছে বনে, তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, জনম জনম- তার সব রচনার সহজ-সরল কথকতা আর অনুভূতি ছুঁয়ে যাওয়া বর্ণনা পাঠককে করেছে মন্ত্রমুগ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধকে খুব কাছ থেকে দেখা এই লেখকের লেখায় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রসঙ্গ ফিরে এসেছে বারবার। ইতিহাসের নানার সময়ও উঠে এসেছে তার লেখনিতে। দেয়াল, মধ্যাহ্ন,বাদশাহ নামদারের মতো উপন্যাসে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর পাশাপাশি উঠে এসেছে সাধারণ মানুষের কথাও। পাঠকের পশ্চিম বাংলামুখী মানসিকতার পরিবর্তন এনেছেন তিনি।
জীবনকে সরস ও অনুপুঙ্খভাবে উপস্থাপনে তার জুড়ি মেলা ভার। প্রেম-বিরহের তীব্র অনুভূতি ফুটিয়ে তুলেছেন মর্মস্পর্শী কথনে। কলমের দোর্দণ্ড প্রতাপে বর্ণের মালা গেঁথে যে শব্দ হয়, শব্দ থেকে যে বাক্য, তাই দিয়ে পাঠককে জাগাতে পারতেন তিনি। তাই তো তিনি পরিণত হয়েছেন পাঠকের অভ্যাসে।
আশির দশকে বাংলা টিভি নাটককে তিনি নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়। মধ্যবিত্ত জীবনের আনন্দ-বেদনা আর টুকরো টুকরো অনুভূতি আনায়াসে উঠে এসেছে তার লেখা নাটকে। এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রিহী, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, নক্ষত্রের রাতের মতো ধারাবাহিক নাটক ছাড়াও অজস্র সাপ্তাহিক নাটক ও টেলিফিল্মে হুমায়ুন যে ইতিহাস তৈরি করে গেছেন, এখন পর্যন্ত তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। নাটকে তার অনবদ্য চরিত্র ‘বাকের ভাই’ এক কিংবদন্তী।
মিসির আলী আর হিমুর মতো চরিত্র সৃষ্টি করে লজিক আর এন্টিলজিকের দোলাচলে মাতিয়েছেন পাঠককে। জগতের সব রহস্যেরই বাস্তব ব্যাখ্যা মেলে মিসির আলীর কাছে। আর চেনা পৃথিবীর বাইরে এক রহস্যময় জগতের হাতছানি বোহেমিয়ান হিমুকে ঘিরে। মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে অসীম কৌতুহল উঠে এসেছে তার নানান লেখায়।
পরিচলক হিসেবেও হুমায়ুন অনবদ্য। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি তৈরি করলেন আগুনের পরশমনি সিনেমা। মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীকে পটভূমি করে তৈরি এই সিনেমাটিতে দেখানো হয় যুদ্ধের ভয়াবহতা, স্বজন হারানোর বেদনা আর দেশপ্রেম। আগুনের পরশমণির স্পর্শে হুমায়ুন এই প্রজন্মকে বোঝালেন ও দেখালেন, এই পতাকা, একটি জাতীয় সঙ্গীত আর ৫৭ হাজার বর্গমাইলের দেশটি এসেছিলো কাদের রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে।
তৈরি করেন শ্রাবণ মেঘের দিন, শ্যামলছায়ার মতো আরো অসংখ্য হৃদয়ছোঁয়া সিনেমা। তার সিনেমার বহু গানের রচয়িতা ও সুরকারও ছিলেন তিনি। তার সিনেমাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই জিতে নেয় জাতীয় পুরস্কার।
এ দেশের মানুষকে বইমেলামুখী করতে তার অবদান বিশাল। কয়েক দশক ধরে মানুষের এক অভ্যাস হয় তাকে ঘিরেই। তৈরি করেছেন বিশাল পাঠক সমাজ। মূলত তার বইকে কেন্দ্র করে মেলায় থাকতো সব বয়সের পাঠকের ভিড়। মৃত্যুর এত বছর পরেও যা চলমান।
বাংলা একাডেমি, একুশে পদকের মতো জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কার ছাড়াও বহু পুরস্কার পেয়েছেন এই গুণী লেখক।
বহুমাত্রিক প্রতিভাবান এই মানুষটিকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে, হয়েছে সমালোচনাও। তবুও তার কর্মের মধ্য দিয়ে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু তিনি আর আসবেন না। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে ক্যান্সারের কাছে হার মেনে অন্যভুবনে চলে যান তিনি।
মারণব্যাধির সাথে যুঝতে থাকা হুমায়ুন বলেছিলেন, আবারো ফিরবেন, লিখবেন। সহজ সরলতায় আবারো কঠিনতর ভাবনায় আর ভালোবাসায় বেঁধে ফেলে দেবেন দর্শক, পাঠক ও ভক্তদের। কিন্তু কেউ তো কথা রাখেনা। তিনিও না।
তবুও ফিরে ফিরে আসেন জননন্দিত এই কথাকারিগর। লেখনির অসামান্য বৈচিত্র্য আর চার দশকের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তাই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন। শুভ জন্মদিন জাদুকর।