গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
মোহাম্মদ নূরুল হক, প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৩:৫৪ পিএম, ১২ নভেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার আপডেট: ০৪:৫৫ পিএম, ১২ নভেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার
মানুষ ভুল করলে শোধরানো যায়, কিন্তু রুচির বিকার ঘটলে তাকে বাঁচানো যায় না।
কথাটা যত সহজে বলা যায়, বিষয়টি তত সহজ নয়। এর পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘকালের পারিবারিক-আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিক চর্চা-অভ্যাস-আচরণ। এসবের সমন্বয়েই একজন মানুষের রুচি গড়ে ওঠে। এই কথাগুলো সমাজের দশজন সাধারণ মানুষের জন্য যেমন সত্য, তেমনি গণমাধ্যমকর্মীদের জন্যও।
সম্প্রতি অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোয় হিট বাড়ানোর জন্য এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এই প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে শিরোনাম নিয়ে অতিরঞ্জন, ভাইরাল হওয়া ঘটনা নিয়ে দ্রুত প্রতিবেদন তৈরি করা। রয়েছে যেকোনো কথা শোনামাত্রই তথ্য যাচাই ছাড়াই প্রকাশ করার ঘটনাও। এমন চর্চার মাধ্যমে পাঠকশ্রেণীকে হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে আকৃষ্ট করা যায় কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তাদের ধরে রাখা যায় না। তথাকথিত হিটকামী গণমাধ্যমগুলো যতই ‘ব্রেকিং নিউজ’ করে মানুষকে চমকে দিতে চায়, পাঠক ততই সন্দেহের চোখে তাকায়।
কারণ, মানুষ মাত্রই জনপ্রিয়তার দিকে তাকায় করুণামিশ্রিত চোখে। অজনপ্রিয় দৃঢ়-ব্যক্তিত্বসম্পন্নদের দেখে সমীহের চোখে। সংকটে-বিহ্বলতায় এই দৃঢ়-ব্যক্তিত্বসম্পন্নদেরই শরণাপন্ন হয় তারা। বিপরীতে জনপ্রিয়দের কেবল মনোরঞ্জনের স্বার্থেই ব্যবহার করে। ব্যবহার শেষে ছুড়ে ফেলে আস্তাকুঁড়ে। কারণ ওই ভাগাড়ই বেশিরভাগ জনপ্রিয়ের আসল ঠিকানা।
এত কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য। রুচির সংকটে ভুগতে থাকা গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক চিত্র দেখলে যেকোনো মনোযোগী পাঠক-সংবাদকর্মী মর্মাহত হবেন। কারণ, বর্তমানে অধিকাংশ গণমাধ্যমেই রুচির পতন হয়েছে। দ্রুত ধেয়ে যাচ্ছে আরও পতনের দিকে। যেসব কারণে সম্প্রতি গণমাধ্যম পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১। অনলাইন পোর্টালকে মাল্টিমিডিয়া হিসেবে গড়ে তোলার অপচেষ্টা।
২। ভাইরাল ঘটনা মাত্রকে সংবাদমূল্য দিয়ে প্রচারণা চালানো।
৩। হিট দেখে নিউজের গুরুত্ব নির্ণয় করা।
৪। প্রতিবেদনের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় হলেও একটি ভিডিও যুক্ত করে দেওয়া।
৫। শিরোনাম আকর্ষণীয় করার নামে তথ্য বিকৃতি।
৬। রুচি গঠন বাদ দিয়ে গণরুচির জোগান দেওয়া।
৭। সংবাদের এথিকস ভুলে, জনপ্রিয়তার ইঁদুরদৌড়ে সামিল হওয়া।
দ্বিরুক্তি এড়ানোর স্বার্থে উল্লিখিত ইস্যুগুলো একসঙ্গে আলোচনা করা যাক। একথা অনেকেই জানেন, প্রকৃতিতে ‘নিয়মের রাজত্ব’ বলে একটি কথা চালু আছে। এখানে নিয়মের লঙ্ঘন সাধারণত হয়ই না। আর যখন হয়, তখনই নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। সেই বিপর্যয়ে জীবজগতের পাশাপাশি জড়বস্তুর অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়ে। যেমন, পৃথিবীর যে অঞ্চল বরফ আচ্ছাদিত, তাকে সেভাবেই রাখা হয়। কিন্তু কেউ যদি সেখানে গিয়ে অতিরিক্ত তাপ উৎপাদনের মাধ্যমে বরফ গলাতে চেষ্টা করে, তাহলে তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পানির উচ্চতা যায় বেড়ে। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের মানববসতি হয় প্লাবিত।
আবার প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বনাঞ্চল পুড়িয়ে দিলে কেবল পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নয়, কাছাকাছি মানববসতি তো বটেই, পুরো পৃথিবীর তাপমাত্রা যায় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে। হারিয়ে যায় শত শত প্রজাতির প্রাণী। অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে বিচিত্র সব উদ্ভিদ। আর এসবের পরিণতি হতে পারে মানবজাতির অস্তিত্বের প্রতি বড় ধরনের হুমকি। সুতরাং প্রকৃতিকে তার আপন নিয়মেই চলতে দেওয়া উচিত। সভ্য দুনিয়ার বাসিন্দারা তা-ই করে।
এসব কথা বলার উদ্দেশ্য—একশ্রেণীর গণমাধ্যমে সর্বশ্রেণীর বৈশিষ্ট্য সাধারণের অসুস্থ প্রতিযোগিতার মানসিকতা। নিউজ পোর্টালকে করে তুলতে চায় সর্বশ্রেণীর মিডিয়া। আরও সহজ করে বললে বলতে হয়, টেক্সটনির্ভর নিউজ পোর্টালকে মাল্টিমিডিয়ায় পর্যবসিত করতে চায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ তারা একের ভেতরে সব চায়। তবে, গণমাধ্যমকর্মীকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে—পৃথিবীতে ‘অল ইন ওয়ান’ বলে কিছু নেই। ‘অলরাউন্ডার’ও নয়। যা ‘আছে বলে’ প্রচারণা চালানো হয়, তা কেবল অন্তসারশূন্যই নয়, নিতান্ত হাস্যকরও। কারণ, ‘Jack of all trades, master of none’। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। প্রতিটি মানুষেরই কোনো একদিকে বিশেষ জ্ঞান থাকলে অন্যদিকে কমতি থাকে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
বিষয়টি অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যাক। নারীর শারীরিক গঠন এক ধরনের। পুরুষের আরেক ধরনের। তাই শরীরের ক্ষুধা মেটাতে নারী-পুরুষ উভয়েই মিলিত হয়। এই নারী-পুরুষের মিলনকে প্রকৃতি ও মানবজাতি স্বাভাবিক মিলন হিসেবে দেখে। তবে, শুধু নারীতে-নারীতে কিংবা শুধু পুরুষে-পুরুষে মিলনকে দেখে বিকৃতি হিসেবে। কারণ প্রত্যেক লিঙ্গের মানুষ আলাদা ও স্বাভাবিক চাহিদা-বৈশিষ্ট্য দিয়ে তৈরি। এ কারণে প্রকৃতিতে একই শরীরে নারী-পুরুষ উভয় সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।
শরীরের চাহিদা মেটানোর জন্য যেমন ‘অলরাউন্ডার’ বলে কিছু নেই, তেমনি মানবজীবনের অন্যান্য কর্মযজ্ঞেও নেই। ‘অলরাউন্ডার’ বিষয়টি অনেকটা গ্রামের কবিরাজের কাজের মতো। তারা ডায়রিয়া থেকে শুরু করে আমাশয়, হৃদরোগ, মাথাব্যথা, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট; এমনকী সদ্য ছড়িয়ে পড়া করোনার চিকিৎসাও করেন। তাদের কাছে কোনো রোগের চিকিৎসাই অসাধ্য কিছু নয়। কিন্তু যিনি চিকিৎসাবিদ্যায় এফআরসিএস কিংবা এমবিএস ডিগ্রি নিয়েছেন, তিনি হয়তো নাকের চিকিৎসা করেন, না হয় গলার। কিন্তু যিনি হৃদরোগের চিকিৎসা করেন, তিনি ভুলেও আমাশয়ের চিকিৎসা করেন না। তারা বিশেষ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হন। অর্থাৎ তারা Jack of all trades হন না। হন কেবল master of বিশেষ trade. এজন্য তাদের হাতে মানুষের জীবন যতটা নিরাপদ, ঠিক ততটাই ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামের ‘অলরাউন্ডার’ কবিরাজের হাতে।
এই তিক্ত কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য একটাই। গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, অনলাইন নিউজ পোর্টালকে মাল্টিমিডিয়ায় ‘পর্যবসিত’ করার বেশ হিড়িক পড়েছে। এই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সংবাদকর্মীরা টেক্সটকে প্রায় গুরুত্বহীনভাবে উপস্থাপন করছেন। বিপরীতে ইউটিউব-ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করে, তার লিংক দিচ্ছেন পোর্টালে। এর মাধ্যমে তারা চেষ্টা করছেন, অধিকসংখ্যক পাঠক-ভোক্তাশ্রেণীর মনোরঞ্জন করতে। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে তারা ভুলে যাচ্ছেন, যিনি টেক্সট-এর ভোক্তা তিনি ভিডিও পছন্দ না-ও করতে পারেন। যদি তিনি ভিডিও দেখতে পছন্দও করেন, তাহলে তার জন্য তো টিভির ভিডিও লিংক, ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো ভিডিও লিংক রয়েছেই। তিনি কেন টেক্সট পড়তে এসে অনলাইন পোর্টালে ভিডিও দেখবেন? হয়তো দেখবেন, কিন্তু কতক্ষণ? কারও পেটের ক্ষুধা লাগলে, তখন ভাত বা এমন ভারী খাবার না খেয়ে যতই আকর্ষণীয় হোক ‘হুইস্কি’তে চুমুক দেবে?
আমাদের মনে রাখতে হবে—‘যত প্রিয় মোহন মিথ্যারা, সত্য তত প্রিয় নয়।’ তাহলে সহজেই বোঝা যাবে, সত্য ঘটনা ভাইরাল হয় কম, সাধারণত মিথ্যার মিশেল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের আগে। আর এসব ভাইরাল সাধারণত গুজবনির্ভর হয়। সাধারণ পাঠক-ভোক্তাশ্রেণী সত্য ঘটনার চেয়ে গুজবে মোহিত হয় বেশি। এই শ্রেণীর পাঠক-ভোক্তার রুচির জোগান দিতে গিয়ে গণমাধ্যমগুলোও প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায় ভাইরাল-গুজবনির্ভর ঘটনাকে সংবাদমূল্য দিয়ে প্রচারণা চালাতে। এতে হয়তো পোর্টালের হিট বাড়ে, প্রিন্ট পত্রিকার কাটতি বাড়ে, কিন্তু আখেরে ক্ষতি হয় পুরো সংবাদজগতের। রুচিশীল পাঠক মাত্রই তখন সন্দেহের চোখে তাকায় সংবাদজগতের দিকে।
প্রায় অনলাইন গণমাধ্যমে দেখা যায়—রাজনৈতিক-কূটনৈতিক-বিজ্ঞানের আবিষ্কার-কৃষি-বাণিজ্যের সংবাদের মতো ভারবাহী প্রতিবেদনগুলো অযত্নে-অবহেলায় নিতান্তই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। বিপরীতে কোন নায়িকা কত বিয়ে করলেন, কোন খেলোয়াড় বাবা হলেন, এসব প্রতিবেদন লিড-সেকেন্ড লিড হয়। এর কারণ হয়তো এই যে, খেলা ও বিনোদনের খবরের পাঠক বেশি। তাই এই খবরগুলো বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিতও হয়। আর রাজনৈতিক-কূটনৈতিক-বিজ্ঞানের আবিষ্কার-কৃষি-বাণিজ্যের খবরের পাঠক হাতেগোনা। তাই হিট কম। আর হিট কম বলে সেই প্রতিবেদনগুলো গণমাধ্যমের কাছে গুরুত্বও পায় না। একথা ভুলে গেলে চলবে না—যৌনসঙ্গমের কলাকৌশল শেখানোর টিপসের পাঠক কয়েক লাখ হলেও করোনার টিকা আবিষ্কারের সংবাদের পাঠক হয়তো ত্রিশজনও হবে না। তাই বলে যিনি নিউজ পোর্টালকে কেবল সঙ্গমের প্রতিবেদন প্রচারণার প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে ফেলেন, তিনি হয়তো রসময়গুপ্তের স্বগোত্রীয়। তাই রুচিহীন কামকাতর পাঠকশ্রেণীর আরাধ্য তিনি। কিন্তু বৃহত্তর রুচিশীল পাঠকের কাছে তীব্র ঘৃণার পাত্র। এর বেশি কিছু নন।
টেক্সট ও ভিডিও—দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রুচি-ভিন্ন ঘরানার বিষয়। কোনো কারণে টেক্সট যদি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় কিংবা ভাষা ও ব্যাখ্যার অস্পষ্টতার কারণে লিখিত প্রতিবেদন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয় কিংবা বক্তব্যদাতা তার বক্তব্য পরবর্তী সময়ে অস্বীকার করতে পারেন—এমন আশঙ্কা থাকে, তখনই সংশ্লিষ্ট অডিও বা ভিডিও যোগ করা যেতে পারে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে তা হয় হাস্যকর। কারণ, যে পাঠক টেক্সট থেকে তার তথ্য নিতে চান, তিনি ভিডিও থেকে নেবেন না। এছাড়া, ভিডিও দেখতে চাইলে ওই পাঠক আর পাঠক থাকেন না। তিনি হয়ে যান দর্শক। যিনি দর্শক, তিনি টেক্সটের সঙ্গে ভিডিও দেখতে অভ্যস্ত নন, তিনি সরাসরি ভিডিও দেখেন সংশ্লিষ্ট স্ট্রিমিং সাইট ইউটিউবেই। নিজের ডিভাইসের ডেটা খরচ করে কোনো পোর্টালের টেক্সটভিত্তিক কনটেন্টের সঙ্গে ভিডিও দেখা তার জন্য রীতিমতো নির্যাতনের সামিল।
পাঠককে আকৃষ্ট করতে অনেক নিউজ পোর্টাল সংবাদের শিরোনামে তথ্য বিকৃত করে। কোনো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নেতা-নেত্রীর নামের সঙ্গে মিল থাকা গ্রামের দুই নর-নারীর প্রেম বা বিয়ের সংবাদ ছাপানোর সময় এই পোর্টালগুলো শিরোনামে বিকৃত তথ্য দেয়। যেমন, গ্রামের কোনো কনের নাম হয়তো বিদিশা খাতুন, আর বরের নাম হয়তো এরশাদ। তখন এই পোর্টালগুলো সংবাদ শিরোনাম দেবে, ‘বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন বিদিশা-এরশাদ’। শিরোনাম দেখে প্রথমেই লোকে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও তার সাবেক স্ত্রী বিদিশার (এরশাদের পরিবার ও বিদিশার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক) কথাই ভাববে। এই ভাবনার কারণে পত্রিকার কাটতি বাড়বে, পোর্টালের বাড়বে হিট। অথচ এই তথ্য শতভাগ বিকৃত-অরুচিকর।
এছাড়া, খণ্ডিত তথ্য, দ্বৈত-অর্থবোধক তথ্য দিয়ে শিরোনাম করাও কতিপয় পোর্টালের নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব পোর্টালে মৃত্যুসংবাদ নিয়েও বিদ্রূপাত্মক শিরোনাম করা হয়। কেউ করোনায় মারা গেলে তারা শিরোনাম দেয় ‘এবার করোনা ট্রিগার চাপলো অমুক জেলায়।’ যেন মৃত্যু কোনো রসিকতার বিষয়।
প্রকৃত গণমাধ্যমের কাজ রুচিগঠন করা। গণরুচির জোগান দেওয়া নয়। গণরুচির জোগান যারা দেয়, তারা হয়তো গণমানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে, কিন্তু জনমনে তাদের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগে। অশ্রদ্ধা জাগে। জনমন তাদের ধিক্কার দেয়। গণরুচির জোগানদাতা আর সংবাদকর্মী থাকে না, হয়ে ওঠেন ফড়িয়া-দালাল। এর বেশি কিছু নন।
গণমাধ্যমকে যদি জ্ঞান ও তথ্যের ভাণ্ডার ধরা হয়, তাহলে তাদের উচিত সুরুচি গঠনে সচেষ্ট হওয়া। নতুন নতুন তথ্য ভোক্তাশ্রেণীকে সরবরাহ করা। সেই তথ্য হতে পারে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক, হতে পারে আইন-শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত। হতে পারে ইতিহাস-ঐতিহ্য-প্রত্নতত্ত্ব-ব্যবসায়-বাণিজ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিনোদন-খেলাধুলারও। এসব তথ্য দিয়ে জনগণকে সহায়তা করা, সচেতন করা প্রকৃত-সৎ গণমাধ্যমের কাজ। কিন্তু অনেক গণমাধ্যমই স্ব-স্ব দায়-দায়িত্ব ভুলে নিম্নমানের গণরুচির জোগান দিচ্ছে। বখে যাওয়া অনতি তরুণ-বখাটের রুচিমাফিক সংবাদ পরিবেশন করছে। এই বখাটে তরুণদের মন জয় করার জন্য প্রচ্ছদজুড়ে সাজিয়ে রাখছে নিম্নমানের বিনোদনকর্মী ও ক্রীড়াজগতের তারকাদের অর্ধনগ্ন ছবি সংবলিত প্রতিবেদন। এসব প্রতিবেদনের ভাষা মাঝেমাঝে এতটাই রগড় হয় যে, বাবা-ছেলে, মা-মেয়ে একই আসনে বসে পাঠ করতে গেলে লজ্জায় তাদের মুখ লাল হয়ে ওঠে।
এদিকে, কোনো কোনো নিউজ পোর্টালকে দেখা গেছে, সংবাদের ইথিকস ভুলে জনপ্রিয়তার ইঁদুরদৌড়ে সামিল হতে। এজন্য তারা চটকদার শিরোনাম দেওয়া থেকে শুরু করে নারী-পুরুষের বেডরুমের পারফরমেন্স কেমন হবে, তা নিয়েও টিপস দিচ্ছে। এতে হয়তো হিট বাড়ে ওইসব রুচিহীন পোর্টালের। আর হিট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালেক্সা র্যাংকিংও বাড়তে থাকে। তাতে সংশ্লিষ্ট পোর্টালের কর্তাব্যক্তিরা এক ধরনের শ্লাঘা অনুভব করেন। অথচ ওই সময় লজ্জায় তাদের মাথা নত হয়ে আসার কথা। তারা এটা বুঝতে চান না, অ্যালেক্স কোনো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক র্যাংকিং সাইট নয়। যে কেউ চাইলেই এমন র্যাংকিং নির্ণায়ক সাইট তৈরি করতে পারেন। এরজন্য স্রেফ কয়েকটি সূচক নির্ধারণ করে সেগুলোর আলোকে মান নির্ণয় করতে হবে। এমন র্যাংকিং নির্ণয়কারী সাইট কেবল অ্যালেক্সাই নয়, ‘সিমিলার ওয়েব’, ‘সিমরাশ’, ‘উর্যাংক’সহ বহু সাইট আছে। তাই এমন সাইটের মানদণ্ড দিয়ে কোনো ওয়েবসাইট বা পোর্টালের র্যাংকিং নির্ণয় করা নিতান্তই হাস্যকর।
অ্যালেক্সা র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকার জন্য রুচিহীন চটকদার শিরোনাম কিংবা প্রতিবেদন প্রকাশের দরকার নেই। দরকার নেই অ্যালেক্সায় এগিয়ে থাকার অপ্রয়োজনীয় চেষ্টা করাও। যা দরকার, তা হলো, সুসম্পাদিত-সুলিখিত বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহ করা। তাহলে জনগণের আস্থা যেমন বাড়বে, তেমনি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে পাঠকসংখ্যাও।
এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের উক্তি স্মরণ করা যাক। তিনি নবীন লেখকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভালো হইবে না। লেখা ভালো হইলে যশ আপনি আসিবে।’ নিউজ পোর্টালগুলোর কর্তাব্যক্তিদেরও উচিত বঙ্কিম-বাণী মনে রাখা। জনপ্রিয়তার পেছনে দৌড়ালে জনপ্রিয়তা কখনোই ধরা দেবে না। কারণ, গণরুচি কখনোই স্টাইল হতে পারে না। এটি প্রতিমুহূর্তের ফ্যাশন মাত্র; উত্তরের বাতাস দক্ষিণমুখী হতে সময় লাগে, কিন্তু এই ফ্যাশন পরিবর্তনে মুহূর্তকালও লাগে না। সুতরাং গণরুচির পেছনে দৌড়ালে জনপ্রিয়তা তো ধরা দেবেই না, উল্টো যে দুই চার জন রুচিশীল পাঠক নিয়মিত সাইটে ঢুঁ মারতেন, তারাও বিরক্ত হয়ে বিমুখ হবেন। আর যদি রুচিশীল পদ্ধতিতে সংবাদ প্রকাশিত হয়, তাহলে আত্মমর্যাদবোধ-সম্পন্ন পাঠকরা তা তো পড়বেনই, পরন্তু বাকিরাও ধীরে ধীরে মনোযোগী হবেন। একসময় আত্মমর্যাদা তো থাকবে, সঙ্গে যুক্ত হবে জনপ্রিয়তার মুকুটও। তাই আসুন, আমরা গণরুচির গণবিকৃতিতে বিদায় জানাই, সুরুচি গড়ে তুলি। আজই শুরু হোক সুরুচির চর্চা।
লেখক: কবি-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক
[email protected]