মুক্তিযুদ্ধ-সংগঠক, একা প্লাকার্ডবাহী সেই প্রতিবাদী
মানবিক চিকিৎসক হজরত আলী আর নেই
প্রকাশিত: ০৯:২৬ পিএম, ৪ আগস্ট ২০২০ মঙ্গলবার আপডেট: ০৯:৩৩ পিএম, ৪ আগস্ট ২০২০ মঙ্গলবার
সাতক্ষীরার চিকিৎসক সমাজের অন্যতম অভিভাবক, ’৭১ এর রণাঙ্গনের সম্মুখযোদ্ধা, ডা. হযরত আলি আর নেই। তিনি মঙ্গলবার (৪ আগস্ট ২০২০) বিকাল ৫.০৫ মিনিটে নিজস্ব বাস ভবনে বাধ্যক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাহি রাজিউন)।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সাতক্ষীরা জেলা ইউনিট কমান্ডের সর্বশেষ সাবেক কমান্ডার মোশারফ হোসেন মশু বলেন, তিনি ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রিত বাঙালি শরণার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কাছ থেকে কোনো ভাতা কিম্বা সম্মানি নিতেন না। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিতে আবেদন করার জন্য বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা অনুরোধ করেছেন। কিন্তু তিনি একজন সংগঠক। তার হাত ধরে বহু যুবক সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। তাই তিনি সংগঠক হিসেবেই থাকতে চেয়েছেন। এ কারণেই অন্যদের অনুরোধ স্বসম্মানে ফিরিয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সনদ তিনি নেননি। তিনি আর কেউ নন-তিনি ডা. হজরত আলী। সাবেক কমান্ডার মোশারফ হোসেন মশু বলেন, আমার বহু অনুরোধ করেছি কিন্তু তিনি শোনেন নি।
কালিগঞ্জে সবাই তাকে চেনেন একজন জনদরদী চিকিৎসক হিসেবে, একজন জনদনদী মানুষ হিসেবে। কিন্তু এই মহান ব্যক্তিটি দেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করার জন্য অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। বিনিময়ে তার চাওয়া পাওয়া ছিল না কিছুই। দেশের জন্য এই অকৃত্রিম ভালবাসার বিষয়টি হয়তো নতুন প্রজন্মের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। যিনি অন্যের অসুস্থতার খবর পেয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে ছুটে যেতেন তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি সকলকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
কালিগঞ্জ উপজেলার ভাড়াশিমলা ইউনিয়নের পূর্ব নারায়ণপুর গ্রামে (উত্তর কালিগঞ্জ) শহীদ সামাদ স্মৃতি ময়দান সংলগ্ন ডা. হজরত আলীর বাড়ি। প্যারালাইজড অবস্থায় ওই বাড়িতে শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। ১৯৩০ সালে জন্ম হয় হজরত আলীর। পিতার নাম শের আলী। ৪ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তার হজরত আলী ছিলেন সবার বড়। তাদের আদি নিবাস মথুরেশপুর ইউনিয়নের হাড়দ্দাহ গ্রামে। ১৯৮০ সালে নারায়ণপুরে বাসগৃহ নির্মাণ করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
হজরত আলী দেবহাটার টাউনশ্রীপুর শরৎচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫৫ সালে মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এলএমএফ পাশ করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে চলে যান চাকরিতে। ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে চাকরি ছেড়ে করাচি থেকে বাড়িতে চলে আসেন। স্থানীয়দের চিকিৎসাসেবা দিতে থাকেন তিনি। ১৯৬৬ সালে তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ থেকে ব্যাচেলর অফ মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারী (এমবিবিএস) ডিগ্রী অর্জন করেন।
১৯৬০ সালের ৮ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা লস্করপাড়ার বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম জান্নাতি বেগম। জান্নাতি বেগম ২০০৮ সালে ৬২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। সাত সন্তানের জনক ডা. হজরত আলী। এর মধ্যে ৩ ছেলে যথাক্রমে আকবর আহমদ, জাহিদ আহমদ ও জাকির আহমদ এবং ৪ কন্যা যথাক্রমে রিতা, মিতা, মিনু ও শেলী। সবাই বিবাহিত। তার বড় ছেলে আকবর আহমদ স্থানীয় জাফরপুর কাজী আলাউদ্দীন ডিগ্রী কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। মেজ ছেলে জাহিদ আহমদ বিপুল অর্থোপেডিক সার্জন হিসেবে রাজধানীর পিজি হাসপাতালে কর্মরত আছেন। ছোট ছেলে জাকির আহমদ ব্যবসায়ী।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয়দফা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার সাথে সাথে সাথে মাঠে নেমে পড়েন ডা. হজরত আলী। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে কিছু সময়ের জন্য বঙ্গবন্ধু কালিগঞ্জ আসেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয় ডা. হজরত আলীর। এসময় তিনি বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে মুগ্ধ হন। সাধারণ নির্বাচন ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্বের নানা কুটচাল ও সার্বিক পরিস্থিতির সম্পর্কে খবর রাখার চেষ্টা করতেন সর্বদা। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে স্থানীয় অনেক যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন। ডা. হজরত আলী তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং ট্রেনিংয়ের জন্য নাম তালিকাভুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে গঠন করেন সংগ্রাম পরিষদ। ১১ সদস্যবিশিষ্ট এই সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন ডা. হজরত আলী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাষ্টার জেহের আলী। ডা. হজরত আলীর নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ নাম তালিকাভুক্ত করা সকলকে ভারতে ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে ২৭ মার্চ ডা. হজরত আলী নিজে সীমান্ত নদী ইছামতি পার হয়ে শুন্যেরবাগান শরণার্থী ক্যাম্পের ব্যক্তিদের চিকিৎসা সেবা প্রদান শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি দেশে ফেরেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেননি তিনি।
১৯৭২ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি আবারও মানুষের চিকিৎসা প্রদান শুরু করেন। ২০০৭ সালে বসতবাড়ির পাশে পিতা শের আলীর নামে একটি ক্লিনিক স্থাপন করেন। ওই ক্লিনিকে চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। এর বাইরে সময় পেলে তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে অংশ নিতেন। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে তিনি তার মতামত প্লাকার্ডে লিখে একাই দাঁড়িয়ে যেতেন উপজেলা সদরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদমূখর। অসুস্থতাজনিত কারণে প্রায় দুই বছর যাবত বাইরে যাতায়াত একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে গত ৩ অক্টোবর ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এরপর নিজ বাড়িতে শয্যাশায়ী ছিলেন।
তিনটি বিষয়ে ছিল তার দৃঢ় বিশ্বাস। প্রথমটি হলো-সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মহান আল্লাহর উপর বিশ্বাস। তারপর প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ডা. হজরত আলী ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তার নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদে সদস্য ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে মাস্টার জেহের আলী (প্রয়াত), নাসির উদ্দীন (প্রয়াত), শেখ আতাউর রহমান (অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকতা), আব্দুল আফু প্রমুখ। সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হিসেবে ডা. হজরত আলী মহান মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন।