অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

লিবিয়ায় মাফিয়াদের বন্দীদশা থেকে ছেলেকে উদ্ধার করলেন মা

রুবেল মজুমদার, কুমিল্লা

প্রকাশিত: ০১:০১ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০২২ মঙ্গলবার   আপডেট: ০১:০৩ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০২২ মঙ্গলবার

ছবি: অপরাজেয় বাংলা

ছবি: অপরাজেয় বাংলা

লিবিয়ার রাজধানী ত্রীপলি’র একটি দ্বীপে মাফিয়া চক্রের বন্দীদশা থেকে অপহৃত সন্তানকে মুক্ত করে আনলেন বাংলাদেশী এক মা। যে মা বাসে চড়ে কখনো ঢাকায় যাননি, সেই মা উড়োজাহাজে চড়ে সোয়া ৭ হাজার কিঃ মিঃ দূরে অপহরণকারীদের বন্দীশিবির থেকে উদ্ধার করে আনলেন একমাত্র পুত্র সন্তানকে। ঘটনাটি ঘটে কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উজেলার কালিকাপুর গ্রামের লিবিয়া প্রবাসী আবুল খায়েরের স্ত্রী শাহীনুর বেগম (৪৫) লিবিয়া থেকে অবৈধ পথে ইটালি যাওয়ার পথে লিবিয়ার মাফিয়া চক্রের হাতে ৬ মাস ধরে বন্দি থাকা ছেলেকে উদ্ধার করে দেশে ফিরেছেন।

সোমবার (১১ এপ্রিল)  সরোজমিনে উপজেলার কালিকাপুর শাহিনুরের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বাড়িতে অনেক লোকজনের ভীড়। সবাই মা ছেলেকে দেখতে ভিড় জমিয়েছেন। শাহীনূর বেগম ও তার পুত্র ইয়াকুব হোসাইন’র সাথে কথা বলে জানাগেল তাদের দুঃসাহসী অভিযানের কাহিনী।

কোষ্টগার্ড তাদের অন্য একটি দ্বীপে দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেখানে চলে অমানবিক জীবন। একেটি কক্ষে প্রায় ৬০/৭০জনের অবস্থান। খাদ্য সংকট, শারেরীক নির্যাতনসহ নানা কারনে প্রতিদিনই মরছে সাথীরা। লাশের পঁচা গন্ধ, পেটের ক্ষিদা, পানিসংকট আর টাকার জন্য চলে বন্দুকের বাটের আঘাত ও পানির পাইপের পেটানী। শরীরের ক্ষত চিহ্নে পচন ধরেছে ইয়াকুবসহ অন্যাদের। প্রতিদিন একটি রুটি, কোনদিন আধা রুটি খেয়ে শরীরের যন্ত্রনায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। এ সংবাদে তার বাবা আবুল খায়ের হার্ট এটাকে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। 

আবুল খায়ের তার স্ত্রী শাহীনূর বেগমকে খবর দেন। পাসপোর্ট এবং ভিসা লাগিয়ে লিবিয়া যাওয়ার ব্যবস্তা করেন। শাহিনূর চলতি বছরের ৯ জানুয়ারী লিবিয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। স্বামীর সাথে লিবিয়ায় ব্যাঙ্গাজী অবস্থান করে দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ এবং সেনাবাহিনী ও আইওএম’র কর্মকর্তা এবং সেনা সদস্যদের সহযোগীতায় ওখান থেকে অর্থের বিনিময়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। প্রায় ৬ মাস বন্দী জীবনে অনাহার, অর্ধাহার, নির্যাতনে ইয়াকুব সুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। 

আইওএম ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় শাহিনুর বেগম ৮ মার্চ বেনগাজি থেকে এবং ইয়াকুব ১৬ মার্চ ত্রিপলি থেকে ঢাকায় ফেরেন। লিবিয়া থেকে ফেরার পর তাদের রাখা হয় আশকোনার হজ ক্যাম্পে। ২১ মার্চ শাহিনুর ও ইয়াকুব ফেরেন নিজ বাড়িতে। ইয়াকুবের স্বপ্ন ছিল ইউরেরাপ গমন আর সেই থেকেই দালাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন,আর সেই স্বপ্নই একসময় হয়ে ওঠে দুঃস্বপ্ন।

লিবিয়ায় অবস্থানররত সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার বাংলাদেশী জাহাঙ্গীর নামের একজনের সাথে সখ্যতা এবং পরে তার পরামর্শে অবৈধভাবে সাগরপথে ইতালি যাওয়ার পরিকল্পনা করেন ইয়াকুব। ২০২১ সালের প্রথম দিকে ইতালি যাওয়ার জন্য রফিক নামের এক দালালকে ৪ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। ইয়াকুবকে প্রথমে গাড়িতে করে বেনগাজি থেকে ত্রিপলিতে নেওয়া হয়। ত্রিপলি থেকে ইয়াকুবসহ আরও কয়েকজনকে নেওয়া হয় প্রায় ১২০ কিলোমিটার পশ্চিমের জুয়ারা পোর্টে। সেখান থেকে রাতে নৌকাযোগে তাদের গন্তব্য হয় ইতালির ল্যাম্পিদুসা দ্বীপ। ল্যাম্পিদুসা দ্বীপ থেকে জলপথে ইয়াকুবকে ইতালি নেওয়ার কথা ছিল। সর্বমোট ৩০০ জন যাত্রী ছিল জাহাজে, তাদের মধ্যে ১৫০ জনই ছিল বাঙ্গালি। যাত্রার শুররুতেই আমাদের নৌকা লিবিয়ার কোস্টগার্ডের কাছে ধরা পড়ে। কিছু মানুষকে ঘাট থেকে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। যারা টাকা দিতে পাওে নাই আমিসহ অন্যদের জেলে পাঠানো হয়।

ইয়াকুব জানায়, জেলে আমাদের খুব অত্যাচার করা হতো। খাওয়ার জন্য একটা রুটি আর পানি দিত। ২২ দিন জেলে থাকার পর কোস্টগার্ডকে ৪ লাখ টাকা দিয়ে আমি ছাড়া পাই। এরপরেও প্রায় ৮ মাস পর আবারো ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেন ইয়াকুব। এবার তার বিপদ আরও বেড়ে যায়। এ সময় 'মাফিয়ারা' তাকে বন্দি করে নিয়ে যান।

আমাদের যেখানে রাখা হয় সেখানে ৭ জন বাংলাদেশি আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল। তাদের একজনের নাম সুজন। বাকিদের নাম মনে নেই। তারাও মাফিয়াদের হাতে অনেক আগে ধরা পড়েছিলেন। তবে তারা মাফিয়াদের কিছুটা বিশ্বস্ত। এই ৭ জন আমাদের নিয়মিত মারতেন। কোনো কথা ছাড়াই হাতের কাছে যা পেতেন তাই দিয়ে মারতেন। তাদের কোনো মায়া-দয়া ছিল না। তারাই আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছেন। আমাদের ৩০০ জনের জন্য প্রতিদিন ৩০০টি রুটি দেওয়া হতো। এই ৭ জন ৩০টি রুটি রেখে বাকি ২৭০টি আমাদের দিতেন। আমাদেও সেগুলি ভাগ কওে খেতে হত।

ছেলে নিখোঁজের খবরে লিবিয়ায় থাকা তার স্বামী আবুল খায়ের ২ বার স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারও অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। পাগলের মতো ছুটে বেড়াতাম। তখন নিজেই লিবিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

লিবিয়া যাওয়ার জন্য মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে ঢাকা যাই। ফকিরাপুল এলাকায় জোনাকি হোটেলে ওঠি এবং একজনের মাধ্যমে ভিসা ও প্লেনের টিকেটের ব্যবস্থা করি। সব মিলিয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ হয়।

প্রথমে সেখানে বাংলা ভাষা জানেন এমন কয়েকজনকে খুঁজে বের করে তাদের কাছে সব খুলে বলি। তারা আমাকে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। দূতাবাস ও আইওএম'র কর্মকর্তারা সব শুনে আমাকে সাহায্য করেন।

ইয়াকুব হাসান বলেন, 'আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা একজনকে অনেক অনুরোধ করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার ফোনটি নেই। আমি শুধু বাবাকে জায়গার নাম বলি এবং কাউকে আর কোনো টাকা না দেওয়ার জন্য বলি। কারণ সব টাকা দালালরা খেয়ে ফেলে। বাবার সঙ্গে আমার ১৭ সেকেন্ড কথা হয়েছিল।

শাহিনুর বলেন, 'আইওএম কর্মকর্তারা লিবিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইয়াকুবকে উদ্ধার করেন। তারা ফোনে আমার সঙ্গে ওর কথা বলিয়ে দেন। ফোনে যখন ছেলের কণ্ঠ শুনি তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। আমার ছেলেও ওপাশ থেকে কান্না করতে থাকে। ছেলেকে দেখার জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু লিবিয়ায় আমাদের দেখা হয়নি। ছেলে তখন ত্রিপলিতে ছিল, আর আমি বেনগাজিতে।

আইওএম ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় শাহিনুর বেগম ৮ মার্চ বেনগাজি থেকে এবং ইয়াকুব ১৬ মার্চ ত্রিপলি থেকে ঢাকায় ফেরেন। লিবিয়া থেকে ফেরার পর তাদের রাখা হয় আশকোনার হজ ক্যাম্পে। ২১ মার্চ শাহিনুর ও ইয়াকুব ফেরেন নিজ বাড়িতে।

শাহিনুর বেগম বলেন,আমাদের কাছে যারা টাকা নিয়েছে তাদের একজন এখন দেশে আছেন। তার বাড়ি সিলেটে। আমি যদি টাকাগুলো ফেরত পাই তাহলে খুব উপকার হবে। আমি তাদেও বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা নেব। সরকার যদি আমাদের টাকাগুলো দালালদের কাছ থেকে উদ্ধার করে দেয়, আমাদের খুব উপকার হবে। আমি আইওএম এর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তারা আমার ছেলেকে উদ্ধার করে দিয়েছে।

তবে তিনি যে সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে সন্তানকে মৃত্যুকূপ থেকে উদ্ধার করেছেন, তা স্মরনীয় হয়ে থাকবে সকলের কাছে।