অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

করোনায় ঘরে বসে সাংবাদিকতা, কীভাবে?

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

প্রকাশিত: ০৪:৩২ পিএম, ৪ আগস্ট ২০২০ মঙ্গলবার   আপডেট: ০২:৫১ পিএম, ৩০ অক্টোবর ২০২০ শুক্রবার

স্পট কাভারেজ কথাটা সাংবাদিকতার সাথে ওতপ্রোত সম্পর্কিত। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সংবাদকর্মী তথ্য সংগ্রহ করবে সাংবাদিকতায় এটাই চর্চা। খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে এর বিকল্প কিছুই চিন্তা করা হয়নি। বরং স্পট কাভারেজের জন্য সংবাদকর্মীদের অনেক ঝুকি নিতে হয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে- যুদ্ধের ময়দানের খবর সংগ্রহে এমবেডেড সাংবাদিকতাও করতে হয়েছে। একটাই কথা সরেজমিনে না দেখে রিপোর্টিং করা না হলে, সে রিপোর্ট ততটা জোরালো হয় না। কিন্তু নোভেল করোনা ভাইরাসের মহামারিকালে সংবাদকর্মীকে এমনটা বলতে পারছেনা কেউই। বস্তুত কাউকে বাধ্যবাধকতায় আটকানো যাচ্ছে না। এমনকি কেউ যদি স্বেচ্ছায় যেতেও চান তাকে আটকানো সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। কারণ কর্মীর কাজের চেয়ে তার নিরপত্তাই সবার আগে। এ অবস্থায় কথা উঠেছে- সংবাদকর্মীরা বাসা থেকে কাজ করবেন। এরই মধ্যে শুরু করছেনও অনেকে। বিশ্বের অনেক বড় বড় সংবাদমাধ্যম তাদের কর্মীদের ঘরে থেকে কাজ করার জন্য বলেছ। দেশেও অনেক সংবাদমাধ্যমকে এমন ঘোষণা দিতে দেখা গেছে। কিন্তু কিভাবে?

মেডিক্যাল ইমার্জেন্সির খবর সংগ্রহে আমরা হাসপাতালগুলো ঘুরে ঘুরে রিপোর্ট করতে বলি রিপোর্টারদের। ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিলে প্রতিবেদক হাসপাতাল থেকে বাস্তব চিত্র দেখে এসে, তথ্য সংগ্রহ করে খবর দেয়। সর্বসাম্প্রতিক ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপেও সংবাদকর্মীরা কিছুটা ঝুঁকির হলেও হাসপাতাল থেকেই খবর সংগ্রহ করেছে। তবে কোভিড-১৯ ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর পরিস্থিতি মোটেই সে ধরনের সাংবাদিকতার জন্য অনুকূলে নেই।

এটি সত্য সংবাদকর্মী ঝুঁকি নেয়। তবে পাশাপাশি এও সত্য- সংবাদকর্মী তার জীবনের ঝুঁকি কখনোই নেবে না। করোনা ভাইরাস গোটা বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর, একটি কথাই বলা হচ্ছে- খবর সংগ্রহের জন্য কেউ কোনো রিস্ক ইনভলব করবে না। বলা হচ্ছে, ঝুঁকি তো নেবেই না বরং ঘরে থেকে কাজ করবে।
খবরের সাথে সাংবাদিকের সম্পর্কটাই এমন যে, খবর নিজে থেকে এসে ধরা দেয় না। সে কারণেই সংবাদকর্মীর গুন হিসেবে নোজ ফর নিউজ, আইজ ফর নিউজ, ডিগিং ফর নিউজ কথাগুলো এসেছে। তবে এও সত্য সংবাদকর্মীর হাতের কাছে খবর পৌঁছে যাওয়া, সেও শুরু হয়েছে অনেক আগে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, সেতো সাংবাদিকতারই প্রায় সমান বয়সী। আর ডিজিটাল প্রলিফারেশনের যুগে এখন খবরের উতস নিজেই খবর পরিবেশন করছে।

কয়েকটি উদাহরণ দেই- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রায় সবগুলো বক্তৃতাই এখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ বা ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। জঙ্গিবিরোধী অভিযান র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন-র্যাবকে সরাসরি সম্প্রচার করতে দেখা গেছে। সুতরাং সংবাদকর্মী চাইলে সেখান থেকে খবর সংগ্রহ করতে পারে। খবরের উতস নিজেই যদি খবর প্রচার করে তাহলে সংবাদকর্মীর কাজ কি? সে প্রশ্ন রয়েছে। বিতর্কও আছে। তবে এই করোনা মহামারির সময়ে বোধহয় উতসের দেওয়া তথ্যকেই আঁকড়ে ধরে এগুতে হবে সংবাদকর্মীকে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, জাতীয় রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইউনিট বেশ কয়েকদিন ধরে তাদের করোনা ভাইরাস বিস্তারের আপডেট ব্রিফিং ফেসবুক পেজে লাইভ করছে। সংবাদকর্মীরা সেখান থেকে তথ্য নিয়েই যে যার মতো খবর পরিবেশন করছে।

এই ব্যবস্থায় ঘর থেকে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে বৈকি। আর করোনা ভাইরাসের খবর পরিবেশনায় এটুকু করেই ক্ষান্ত থাকতে হবে সংবাদকর্মীকে। একটাই প্রত্যাশা থাকবে জাতীয় রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইউনিট যেনো যতটুকু তথ্য দেয় সেটুকু সঠিক দেয়। পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়া হলে তো কথাই নেই।

এই যে বাসা থেকে কাজ চালিয়ে যাওয়া বিষয়টি ঠিক কতদিন ধরে চালিয়ে যেতে হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। করোনা ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে কোনও কোনো দেশ। কিন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এর বিস্তার ক্রমশঃ বাড়ছে। ফলে সরেজমিনে প্রতিবেদন তৈরির পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত কোথাও তৈরি হয়নি। আর এটি এমন এক সংকট যে কেউই বলতে পারছে না এর শেষ কোথায়। অতএব প্রস্তুতিটা ভালো করেই নিতে হবে।
   
বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) সকালে অন্তত চারটি সংবাদ মাধ্যমের চারজন সিনিয়র পর্যায়ের সংবাদকর্মীর সঙ্গে কথা হলো। তারা জানিয়েছেন, বাসা থেকেই কাজ করছেন। অভিজ্ঞতা কেমন জানতে চাইলে দু’জন বলেছেন সম্ভব নয়। এক-দুই দিন দেখে বার্তাকক্ষেই ফিরে যাবেন। আর অন্য দু’জন বললেন কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। তবে অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে, বিষয়টি প্রস্তুতিটা ভালো করেই নিতে হবে। বাসা থেকে কাজ করতেও কিছু প্রস্তুতি লাগে। একজন জানালেন, ফোনে ফোনে কাজ সেরেছেন। বাসা থেকে কাজ করতে হলে ওয়ার্ক স্টেশন লাগবে। যার প্রস্তুতি ছিলো না।

তাহলে কেমন হতে হবে সে প্রস্তুতি?
যেহেতু, সংকটটি গোটা বিশ্বেই একরকম, সেহেতু আলোচনাটাও বৈশ্বিক। প্রশ্ন উঠেছে- এই বাড়ি থেকে কাজ করা- তাকি দুই সপ্তাহের জন্য, চার সপ্তাহের নাকি আরও বেশি- এমনকি চিরস্থায়ী কোনও ব্যবস্থা। কেউ কেউ এই মত দিতেও ছাড়েন নি- কোভিড-১৯ বাড়ি থেকে কাজ করার একটি স্থায়ী ব্যবস্থার দিকেও বিশ্বকে ঠেলে দিতে পারে।
সে আলোচনা এখন নয়। এখন বাস্তবতা হচ্ছে ঘর থেকে কাজ করতে হবে সংবাদকর্মীকে। বিশ্বের বাঘা বাঘা মিডিয়া হাউজগুলো এরই মধ্যে এর বাস্তবায়ন শুরু করেছে। নিজের কর্মীদের নিরাপদে রেখে কিভাবে পাঠক-দর্শক-শ্রোতার কাছে নোভেল করোনা ভাইরাসের বিস্তার ও তার ভয়াবহতার সঠিক চিত্র তুলে ধরা যায় সে জন্য নিজস্ব কনটিনজেন্সি প্ল্যান হাতে নিচ্ছে। সকল সংবাদমাধ্যমই তাদের কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করতে বলেছে।

একা একা ঘরে বসে তথ্যনির্ভর ভিডিও কনটেন্ট বানাতে জোর দিয়েছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। তবে যেসব ক্ষেত্রে যাওয়া জরুরি সেখানে চূড়ান্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই ভিডিও ইউনিট পাঠাচ্ছে মিডিয়া হাউজগুলো।

পডকাস্টের ইন্টারভিউগুলো ফোন রেকর্ডিংয়ে সেরে ফেলতে বলা হচ্ছে। ফলে রিমোট ইন্টারভিউ, ভার্চুয়াল মিটিং এই শব্দগুলোই এখন বেশি উচ্চারিত হচ্ছে।
টেলিভিশন টকশোগুলোর মধ্যে যেগুলোয় দর্শকের সরাসরি উপস্থিতি ছিলো সেগুলো এখন রেকর্ডেড করা হচ্ছে। দর্শক রাখা হচ্ছে না।  

সংবাদপত্র প্রকাশ, ভিডিওগ্রাফিসহ যে কাজগুলোয় কর্মীর শারীরিক উপস্থিতি জরুরি তাদের ক্ষেত্রেও সংবাদ পণ্য ও সম্পাদকীয় পদ্ধতিতে পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের উইকলি ম্যাগাজিন চলতি সপ্তাহে পরীক্ষামূলকভাবে  তার কর্মীদের ঘরে রেখেই পত্রিকাটি প্রকাশ করার ব্যবস্থা নিয়েছে।

এত কিছুর পরেও কিছু কিছু কাজ থাকেই, যেখানে সংবাদকর্মীর উপস্থিতি জরুরি। কোনওভাবেই তা অনলাইনে করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ন্যুনতম এক মিটার দূরত্বে থাকুন। কারো সঙ্গে করমর্দন নয়, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। আর সর্বোপরি কাজ শেষ হলেই দ্রুত বাসায় ফিরে যান।  

এসব কিছুতে মিডিয়াগুলোর ব্যবসা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা নিয়ে এখন কেউ ভাবছে না। সকলেরই একটাই চিন্তা নোভেল করোনা ভাইরাসের যতটা সম্ভব আপডেট যার যার পাঠক দর্শক শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেওয়া, তাদের সতর্ক থাকতে বলা, তাদেরও প্রত্যেককে ঘরে থাকতে বলা, নিরাপদে থাকতে বলা।

খবর আমরা পৌঁছে দেবো, আপনি নিরাপদে থাকুন এই স্লোগান সামনে এনে সংবাদমাধ্যমগুলো কাজ করছে। যারা ঘর থেকে কাজ করতে শুরু করেছেন তাদের জন্য কয়েকটি টিপস-
এক. ফেসবুক মেসেঞ্জার বা হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ খুলে নিন, যোগাযোগ সহজ হবে।

দুই. যতটুকু সময় অফিসের কাজ করবেন, তার সময় নির্দিষ্ট করে নিন। তাতে আপনাকে কখন কোন কাজ দেওয়া যাবে, তা জানা থাকবে।

তিন. কী কী কাজ আপনি করছেন তার একটি তালিকা গ্রুপে শেয়ার করে রাখুন। কাছাকাছি না থাকায় একই কাজ দুজন করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। এতে সময় ও কর্মশক্তি দুইই নষ্ট হয়।

চার. ঘরে কাজ করলেও অফিসিয়াল পোশাক পরে কাজে বসুন। ঘরের পোশাকে বসলেন, আর মাঝে আপনার কারো সঙ্গে ভিডিও কল করা প্রয়োজন হলো, তখন বিপাকে পড়বেন। পোশাক পাল্টে নিতে গেলে সময় নষ্ট হবে। পারলে জুতোও পরে নিন, ঠিক যেমনটা অফিসে পরেন। শুনতে ফালতু শোনালেও বিশেষজ্ঞদের মত, এটা কাজে দেয়।

পাঁচ. দুপুরের খাবারের ব্রেক নিন। যখন তখন খাবার নিয়ে টেবিলে বসবেন না। অফিস করলে খাবারের বিষয়ে যেমনটা আচরণ করতেন, ঘরে থেকে কাজ করার সময়ও ঠিক তেমনটাই করার চেষ্টা করুন।

ছয়. ঘরে বসে যদি অল্প সময়ের জন্য কাজ করতে হয়, তাহলে হয়তো অনেক ইক্যুপমেন্ট দরকার হবে না, নিজের ল্যাপটপ থাকলে একটি এক্সটার্নাল ইউএসবি কি-বোর্ড ও মাউস লাগিয়ে নিন, কাজে সুবিধা হবে।

সাত. বিছানায় বা ঘরের সোফায় নয়, সম্ভব হলে একটি টেবিলে বসে কাজ করুন। তবে টেবিলটি কম্পিটার টেবিল না হলে, রিডিং টেবিল হলে, কি-বোর্ডে কাজ করতে গিয়ে হাতে ব্যথা ধরে যেতে পারে, বিষয়টি লক্ষ রাখুন।

আট. এই যে ঘরে বসে কাজ করছেন, আপনার কম্পিউটারটি ইউপিএস সাপোর্টেড নাও থাকতে পারে। ফলে বিদ্যুত চলে গেলে যা কাজ করেছেন তা হারিয়ে ফেলতে পারেন। সুতরাং কি-বোর্ডে কন্ট্রোল-এস চেপে ডকুমেন্ট সেফ করার বিষয়টিতে অভ্যস্ত হয়ে নিন।

নয়. কাজের ফাইলগুলো লোকাল হার্ডড্রাইভের পাশাপাশি কোনো একটি অনলাইন ড্রাইভেও সেভ করে রাখুন।  
 
দশ. ঘরে থেকে কাজ করা বা অনলাইনে কাজ করা- এর প্রাণশক্তি হচ্ছে ইন্টারনেট। দেখে নিন ঘরের ওয়াইফাইয়ের কাভারেজ কেমন। কাজের টেবিলটি এমন জায়গায় পাতুন যাতে সিগন্যাল যথাযথ থাকে। এক্ষেত্রে ব্রডব্যান্ড কানেকশনই সবচেয়ে ভালো। তবে ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে একাধিক বিকল্প রাখা উচিত। মোবাইল ফোনে পর্যাপ্ত ড্যাটা থাকলে হটস্পট করে যে কোনো জরুরি অবস্থা সামাল দিতে পারবেন।

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক