কেমন হতে পারে জো বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি
মো. হাসান তারেক
প্রকাশিত: ০১:৪৫ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার আপডেট: ০১:৫৯ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার
সবার জন্য যে লড়াইয়ের পথ মসৃণ হয় না, তা জানতেন বিনয়ী জো বাইডেন। তাই অনেক ব্যর্থতার মধ্যেও হতাশ না হয়ে খুঁজতেন সদা সর্বদা সাফল্যের পথ। সব সময় বিশ্বাস করতেন, সব প্রতিকূলতাকে পিছনে ফেলে একদিন হাসবেন বিজয়ের হাসি। তার এই অদম্য জেদ, প্রচেষ্টায় তাকে তার সাফল্যের দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছে। একদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন- এই স্বপ্ন তিনি কিন দশক আগে দেখেছিলেন। অবশেষে হয়েছেও তাই।
জোসেফ রবিনেট বাইডেন জুনিয়র এখন পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক ইলেক্টোরাল ভোটে নির্বাচিত প্রবীণতম প্রেসিডেন্ট। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর থেকে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে তা হচ্ছে, কেমন হবে জো বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি?
জো বাইডেন নির্বাচিত হবার পর কেউ হয়ত আশায় বুক বাঁধছেন, আবার কেউ হয়ত আশাহত হয়েছেন। কেননা, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিই যে বিশ্বরাজনীতির অণুঘটক হিসাবে কাজ করে। জো বাইডেনের শাসনকালে কি আবার ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী নীতির প্রসার ঘটবে? আপাতদৃষ্টিতে, কিন্তু এমনটা মনে হচ্ছে না।
পরিবর্তন হবে, মোটা দাগে কিছু পরিবর্তন হবে। জো বাইডেন নির্বাচিত হবার পরপরই এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন তার বক্তব্যে। জো সবুজ-লালে ভাগ করতে চাইছেন না আমেরিকাকে। তিনি চাইছেন ঐক্যবদ্ধ আমেরিকা গড়তে। তিনি চাইছেন বর্ণবাদমুক্ত,গণতান্ত্রিক আমেরিকা গড়তে। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ নীতিতে দৃশ্যমান হবে জো বাইডেনের এই নীতিগুলোর বিকাশ। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও আসবে গঠনমূলক পরিবর্তন।
প্রথমত, জো বাইডেনের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হবে দ্রুততার সাথে কার্যকর ও ফলপ্রসু কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন উদ্ভাবন ও বিতরণ। এই জন্য জো বাইডেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ফিরে যাবেন এবং সকল দেশকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। তিনি এক্ষেত্রে বিগত বুশ প্রশাসনের এইচআইভি প্রতিরোধে ফলপ্রসূ উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেছেন। এসময়, জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের প্রচারণা ও জরুরি পরিকল্পনার কারণে, এইচআইভি সংক্রমণ হার কিছুটা কমানো গিয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, জো বাইডেন দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে দিশেহারা মার্কিন অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ শুরু করবেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য নীতি প্রণয়ন করবেন তিনি। তিনি শিক্ষার্থীদের ঋণ মওকুফ, অবসর ভাতা ভোগীদের সামাজিক সুরক্ষা চেকবৃদ্ধি এবং এবং ছোট ব্যবসায়ের জন্য অর্থ সরবরাহের মত নানা উদ্যোগ নিবেন। পাশাপাশি, তিনি পরিবেশবান্ধব জ্বালানির প্রসারে উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলছেন। জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বির্তকিত বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে সরে আসার কথা বলছেন। চীনসহ অন্যান্যদের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার জন্য তিনি মার্কিনীদের উদ্ভাবনী শক্তি ও গবেষণায় আরো বেশি আগ্রহী করতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করবেন। তাছাড়া, জনগনকে মার্কিন পণ্য ক্রয়ে উৎসাহিত করবেন।
তৃতীয়ত, বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির আরেকটি বড় প্রাধান্যের বিষয় হবে, জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু। ডোনাল্ড ট্রাম্প এটিকে গুরুত্বহীন বিষয় মনে করে প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু, জো বাইডেনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। চীনসহ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কাজ করার কথা বলেছেন তিনি। দূষণ কমাতে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার।
চর্তুথত, জো বাইডেন তার মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে ভারসাম্যের নীতির কথা বলছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যেখানে সৌদি আরবকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন, সেখানে ব্যতিক্রম হবেন জো বাইডেন। জো চেষ্টা করবেন ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে সৌদি আরবকে সরাতে। তিনি সৌদি আরব এবং ইরানকে নিয়ে ভারসাম্যের নীতির চিন্তা করছেন। পরিবর্তন আসবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইসরায়েল তোষণনীতিতেও। এখানে জো বাইডেন ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলিদের মধ্য ভারসাম্যের নীতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ম্পক পুনঃস্থাপন করবেন তিনি। ফিলিস্তিনে মার্কিন সহায়তা বৃদ্ধিসহ জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করবে মার্কিন সরকার।
পঞ্চমত, পরিবর্তন আসবে অভিবাসন বিরোধী ট্রাম্পের নীতিতে। জো বাইডেন যৌক্তিক অভিবাসন নীতির জন্য কাজ করবেন। যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল দিয়ে অভিবাসী স্রোত থামানোর চেষ্টা করেছেন, সেখানে উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন মেধাবী তরুণদের জন্য উন্মোচিত হবে জো বাইডেনের আমেরিকার দুয়ার। পাশাপাশি, জো বাইডেন পাশ্ববর্তী যেসকল দেশ থেকে অভিবাসন প্রত্যাশির সংখ্যা বেশি সেসকল দেশের মানুষের অর্থনৈতিক ও জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করার পরিকল্পনাও নিয়েছেন।
যষ্ঠত, বাইডেন তার শাসনকালে সুসংহত করবেন গণতন্ত্রকে যেমন তার নিজ দেশে তেমনিভাবে ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোকে উৎসাহিত করবেন এ ব্যাপারে।
সপ্তমত, জো বাইডেন প্রশাসন দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই আমেরিকার মিত্ররাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সর্ম্পক পুনঃস্থাপন ও বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করবেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের ক্ষতিকর নীতিগুলো সংস্কার করে আমেরিকার গৌরব পুনরুদ্ধার এবং ঐক্যবদ্ধ আমেরিকা পুর্নগঠনে জো বাইডেন নিঃসন্দেহে কিছু কার্যকরী উদ্যোগ নিবেন।
তবে, এখন দেখার বিষয় থাকবে, পররাষ্ট্র নীতির লাভ-ক্ষতির এই খেলায় কে কতটুকু লাভবান হয়।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা।