লুঙ্গি-বিদ্বেষ বনাম লুঙ্গি-অনুভূতির বিপ্লব
কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: ১০:৫৭ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২২ সোমবার আপডেট: ১০:৫৮ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২২ সোমবার
পোশাক হিসেবে লুঙ্গি দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ। লুঙ্গি পরি, পরছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সূত্রে অদ্য ‘লুঙ্গি পড়ছিও’। লুঙ্গি পোশাক হিসেবে ব্যবহার্য হলেও অদ্যকার এই ‘লুঙ্গি পড়া’ মূলত নারীবাদী ও নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে আলোচনা। তসলিমা যা লিখেন তা নিয়ে অধিকাংশ সময় আলোচনা হয়, সমালোচনা হয়। এই আলোচনা-সমালোচনায় প্রমাণ হয়, বারবার প্রমাণ হয়ে আসছে নির্বাসিত হলেও এখনও তিনি বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ এবং তুচ্ছ বিষয় নিয়েও অনলাইনে ‘লঙ্কাকাণ্ড’ ঘটিয়ে ফেলার সামর্থ্য রাখেন!
লুঙ্গি নিয়ে তার মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়েছে। এটা কেবল লুঙ্গিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, আলোচনা থেকে ব্যক্তি আক্রমণ পর্যন্ত ঠেকেছে। লুঙ্গি পরা কিছু মানুষের অযাচিত ‘চুলকানো’, ‘অঙ্গ-পরখের’ খাসলতের কথা এসেছে তসলিমা নাসরিনের কথায়। কথা কি সত্যি ‘বেঠিক’? এখানে ‘বেঠিক’ শব্দটা সচেতনভাবে ব্যবহার করছি মূলত আলোচনা-সমালোচনাকারীদের একটা বিশেষ শ্রেণি প্রসঙ্গে। ‘ঠিক না বেঠিক’—এমন প্রশ্ন অশ্রুত নয় মোটেও, যা একশ্রেণির বক্তাদের দ্বারাই প্রচারিত, যেখানে আলোচনার চাইতে সমালোচনা, যুক্তির চাইতে কুযুক্তি, শ্লীল-চর্চার নামে অশ্লীল চর্চার প্রচলন বেশি। সেই বক্তাদের স্বাভাবিক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুও তসলিমা নাসরিন; তসলিমা যা বলতে চান না কেন তাদের স্বব্যাখ্যেয় সে ব্যাখ্যা। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চিরায়ত প্রবণতা। এখানেও তাই, কারণ নাম ওই একই তসলিমা নাসরিন! তবে এই লুঙ্গি-চর্চায় কেবল ‘বেঠিক’ শ্রেণির লোকজনেরাই ব্যস্ত নয়, আছে অন্য শ্রেণিও। শ্রেণি এবং অথবা চিন্তা-স্তর নির্বিশেষে এ আলোচনাও এমন পর্যায়ে গেছে অথবা যাওয়ার অপেক্ষায়, যেখানে আলোচনা-সমালোচনা কেবল লুঙ্গিতেই সীমাবদ্ধ না রেখে লেখিকার চরিত্র ধরেও টান দেওয়ার প্রবণতা চলছে। কেন, কী কারণ? আলোচনা-সমালোচনা কেবল ওই পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখলে কী সমস্যা?
তসলিমা নাসরিনের আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক একটা স্ট্যাটাসে দেখলাম তিনি এই লুঙ্গি বিষয়ক আলোচনা ‘মজাচ্ছলে’ করেছেন বলে জানিয়েছেন। তার অনুযোগ, ‘কত সিরিয়াস বিষয় নিয়ে দিন রাত লিখছি। কারও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তেমন। যেইনা মজাচ্ছলে লুঙ্গি নিয়ে লিখলাম, অমনি পুরুষজাতি ক্ষেপে আগুন।’ যদিও এখানে তিনি ‘পুরুষজাতি’ নিয়ে একটা ইঙ্গিত করেছেন, তবু বলি এই পুরুষজাতি বিষয়ক ইঙ্গিতও যথাযথ নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজবাস্তবতার বিপক্ষে লড়তে পুরুষতান্ত্রিকতার অনেক কিছু নিয়ে সমালোচনা করা দরকার, কিন্তু সমালোচনার নামে লৈঙ্গিক অবস্থানের আপামর পুরুষকে আক্রমণও যৌক্তিক নয়। ‘পুরুষজাতি’ ‘নারীজাতি’—বিভক্তির এই সীমারেখা যদি টানা হয় তবে সমমর্যাদার সমাজ বিনির্মাণ কীভাবে সম্ভব? বিশেষত এনিয়ে আরও বেশি সচেতনতা দাবি রাখে যখন পুরুষতান্ত্রিকতা বা পৌরুষ নিয়ে গর্বিতজনের বিপক্ষে লড়াই হয়! তসলিমা নাসরিন এই যুদ্ধযাত্রার এক অগ্রসৈনিক নিঃসন্দেহে, তাই সরলীকরণের অনুশীলন যথাযথ বলে মনে হয় না। লৈঙ্গিক দিক থেকে আমিও পুরুষ—অস্বীকার করার উপায় নাই। কিন্তু মগজে পুরুষতান্ত্রিকতা ধারণ করি না বলে সম-অধিকার, সম-মর্যাদা নিয়ে আমার আগ্রহ। পুরুষ বলে সকল পুরুষকে একদলে আর নারী বলে নারীরা আরেকদলে—এমন কারও পূর্বানুমান এবং পূর্বানুমান থেকে উদ্ভূত মন্তব্য হলে এর থেকে প্রত্যাশিত ফল আসা সম্ভব না!
তসলিমা নাসরিন লিখেছেন—“পুরুষের লুঙ্গিটাকে আমার খুব অশ্লীল পোশাক বলে মনে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে যে পুরুষেরা লুঙ্গি পরে, তাদের বেশির ভাগই কোনও আন্ডারওয়্যার পরে না, লুঙ্গিটাকে অহেতুক খোলে আবার গিঁট দিয়ে বাঁধে। কখনও আবার গিঁট ঢিলে হয়ে হাঁটুর কাছে বা গোড়ালির কাছে চলে যায় লুঙ্গি। তাছাড়া লুঙ্গি পরার পরই শুরু হয় তাদের অঙ্গ চুলকানো। ডানে বামে পেছনে সামনে এত কেন চুলকোয় কে জানে। সামনে মানুষ থাকলেও তারা অঙ্গ অণ্ড কিছুই চুলকোনো বন্ধ করে না, না চুলকোলেও ওগুলো ধরে রাখার, বা ক্ষণে ক্ষণে ওগুলো আছে কি না পরখ করে দেখার অভ্যেস কিছুতেই ত্যাগ করতে পারে না। পরখ করার ফ্রিকোয়েন্সিটা অবশ্য মেয়েদের দেখলে বেশ বেড়ে যায়।” কথাগুলো তার ‘মজাচ্ছলে’—এমনটা বলেছেন তিনি পরে। তবে এই মজাচ্ছলে বলা কথাগুলোর মধ্যে যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কিছু লোকের খাসলত যে প্রকাশিত তা কি অস্বীকার করার উপায় আছে? তার ভাষায় এই যে, অঙ্গ-পরখ, চুলকানো, নারী দেখলে চুলকানোর ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যাওয়া—কি সর্বাংশে মিথ্যা? আমার ত মনে হয় না!
হ্যাঁ, শুরুতে তিনি লুঙ্গিকে ‘অশ্লীল পোশাক’ বলে চিত্রিত করেছেন সত্য। এখানেই অনেকের আপত্তি। এর প্রতিবাদে অনেককে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থার ছবি আপলোড করতে দেখছি। মনে হচ্ছে এটা যেন ‘লুঙ্গি-অনুভূতিতে’ আঘাতের প্রতিবাদে আরেক ‘লুঙ্গি বিপ্লব’! এর কি দরকার? অবশ্য এও সত্য প্রতিবাদের ভাষা থাকে, ব্যাকরণ থাকে না; প্রতিবাদ প্রতিবাদই। যারা প্রতিবাদ করছেন তারা প্রতিবাদ করতেই পারেন, তবে তা যেন ব্যক্তি আক্রমণ পর্যন্ত না গড়ায়।
তসলিমা নাসরিনের ভাষার ‘লুঙ্গি অশ্লীল পোশাক’—যদি মানি তবে কি এও মানতে হবে ‘পোশাকেও শ্লীল-অশ্লীল আছে’? অথচ এতদিন আমরা এই বলে আন্দোলন করে আসছি যে ‘শ্লীল-অশ্লীল পোশাকে নয়, মগজে’! পোশাকে শ্লীল-অশ্লীল কারা খুঁজে? উত্তর খুঁজতে চেয়েছি নিবন্ধের শুরুর দিকে উল্লেখ ওই ‘ঠিক না বেঠিক’ সমাবেশের বক্তা-শ্রোতার মাঝে! আমরা কি ওই দলভুক্ত? না, মনে ত হয় না! যদি ‘না’ হয় উত্তর তবে পোশাকে অশ্লীলতা খোঁজা কেন আমাদের?
পোশাক নয়, এর ব্যবহারকারীদের খাসলতই মুখ্য বিষয়। ‘চুলকানো’, ‘অঙ্গ পরখ’, ‘কাউকে দেখে আরও বেশি অঙ্গ-পরখ’, ‘প্রদর্শন’ কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কোন পোশাককে ‘অশ্লীল’ বলাটাও দরকারি নয় যেমন, তেমনি পোশাক-অনুভূতির বিপ্লবী প্রকাশটাও নয় জরুরি বিষয়!
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।