পাল বংশের রাজা দেবপালের সমাধির খোঁজে নওগাঁর পত্নীতলায়!
কাইসার রহমানী, বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১১:৪৭ এএম, ২১ জানুয়ারি ২০২২ শুক্রবার আপডেট: ১২:৪১ পিএম, ২১ জানুয়ারি ২০২২ শুক্রবার
প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতির লীলাভূমি বরেন্দ্র জনপদের প্রাণকেন্দ্র নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার আমাইড় ইউনিয়নে অবস্থিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যোগীর ঘোপা দেখতে অপরাজেয়বাংলার এই ছুটে চলা। চলতে চলতে চোখে পড়লো মাঠের পর মাঠ, ধান নিয়ে গৃহস্থ নারীদের ব্যস্ততা আর খোলা মাঠে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ। এককালের প্রমত্তা আত্রাই নদীর আদি খাত বর্তমানে মৃতপ্রায় ঘুকসী নদীর বুড়িদহ নামের উপনদী বা সরুখাল দেখতে পেলাম। আর এই বুড়িদহের তীরেই গড়ে উঠেছিল অতীত উজ্জ্বল ঐতিহ্যের নীরব সাক্ষী যোগীর ঘোপা।
প্রত্যন্ত গ্রামের মধ্যে যোগীর ঘোপা। সরু সরু রাস্তা পার হয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। গ্রামের ভিতরের রাস্তায় একটি বিষয় বারবার চোখে পড়ছে। গবাদিপশু যেমন- গরু, ছাগল ইত্যাদি বাঁধা রয়েছে রাস্তার একেবারেই পাশে। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে গরু অথবা ছাগল রয়েছে। গৃহস্থরা ব্যস্ত তাদের যত্নে। মোড়ে মোড়ে অল্প কয়েকটি দোকান ঘিরে গ্রামের মানুষদের আড্ডা। মোড়ের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল আমাদের গন্তব্য যোগীর ঘোপার রাস্তা।
হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত শিবের উপাসক নাথ ধর্মাবলম্বী একদল সংসার ত্যাগী উপাসক, সন্ন্যাসী, তপস্বী, যোগী গুহার মতো ঘোপ-খোপ বা নির্জন কুঠুরীতে ধ্যান, তপস্যায় লিপ্ত থাকায় আমাইড় ইউনিয়নের এই স্থানটি যোগীর ঘোপা নামে পরিচিতি লাভ করেছিলো। যোগীর ঘোপার প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়না। তবে এই স্থানটি পাল পূর্ব যুগের বলে ধারণা করা হয়। কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর বর্ণনামতে, বরেন্দ্রভূমিতে পাল রাজাদের আদি নিবাস ছিল।
কথিত আছে যোগীর ঘোপায় পাল তৃতীয় রাজা দেবপালের একটি রাজভবনের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। পাল রাজাদের রাজত্বকালে ৮২১ থেকে ৮৬১ খ্রিস্টাব্দে যোগীর ঘোপা প্রসিদ্ধ স্থানের মর্যাদা লাভ করেছিল। পাল সাম্রাজ্যের তৃতীয় রাজা গোপাল পৌত্র দেবপাল তার রাজত্বকালের শেষভাগে অধিকাংশ সময় যোগীর ঘোপার রাজভবনে অবস্থান করতেন। বলা হয়ে থাকে এই স্থানেই পাল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা দেবপাল মৃত্যুবরণ করার পর তাকে সমাহিত অথবা দাহ করা হয়। এছাড়া প্রায় ১ হাজার বছর আগেকার নাথ ধর্মের প্রধান প্রচারক গোরক্ষনাথের সমাধি যোগীর ঘোপায় রয়েছে বলে কথিত রয়েছে।
বর্তমানে যোগীর ঘোপায় দেখতে পেলাম, এক একর জায়গা জুড়ে ক্ষয়ে যাওয়া চারটি মন্দির রয়েছে। একটি মন্দির প্রবেশ পথের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। নির্মাণশৈলীই বলে দিচ্ছিল এর প্রাচীন নিদর্শনের কথা। মন্দিরটির ভিতরে রয়েছে শিবলিঙ্গ। কম্পাউন্ডের ভিতরে রয়েছে তিনটি মন্দির। প্রাচীন ইট দিয়ে তৈরি দুইটি স্থাপনা পাশাপশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এদের শরীরে নকশার কারুকাজ দেখে এখনো মুগ্ধ হতে হয়। তবে নকশাগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। মন্দিরের ভিতরে পাথরের তৈরি অনেক পুরনো শিবলিঙ্গ। চারকোনা আকৃতির মন্দিরের নির্মাণশৈলি দৃষ্টিনন্দন। দরজার পাশেই অংকন করা আছে নকশা।
মূল কম্পাউন্ডের ভিতরে দুটি স্থাপনা একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে। কয়েকটা দেয়াল কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রসাদের ধ্বংসাবশেষ। পুরাতন আরেকটি মন্দিরের অল্প কিছু স্থাপত্য দেখতে পেলাম। এই মন্দিরে সংস্কার কাজ করা হয়েছে। এর ভিতরেই দেখতে পেলাম একটি সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গটি মন্দিরের ভিতর থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে তার উল্টা পাশে। সুড়ঙ্গ যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে গিয়ে দেখতে পাওয়া গেল, এটির আশে পাশেও প্রাসাদের ধ্বংস্তস্তূপ পড়ে রয়েছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে এসব স্থানেও কোন ঘর বা প্রাসাদ ছিল, যা কালের আবর্তে ধ্বংস হয়ে গেছে। সীমানা প্রাচীরের অস্তিত্ত্ব এখনো রয়েছে। পুরো ক্যম্পাসটি যে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল যা দেখে সহজেই বুঝা যাচ্ছে।
যোগীর ঘোপার পুরোহীত শ্রী মন্টু রাজভর জানান, সুড়ঙ্গতে যোগীরা ধ্যান করতেন। এখানে পালবংশের রাজা দেবপাল এসেছিলেন, তারপর যোগীদের তিনি পছন্দ করেন, আর এখানে থেকে যান দীর্ঘদিন। এখানে তাকে সমাহিত কিংবা দাহ করা হয়েছিল বলে জানান তিনি।
যোগী সন্ন্যাসীদের ব্যবহারের জন্য ইট দিয়ে নির্মাণ করা অত্যন্ত সংকীর্ণ ও অপ্রশস্থ দ্বিতল ভবন রয়েছে। এখানেই যোগীরা রাতযাপন করতেন বলে ধারণা করা হয়। চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ধ্বংসস্তূপ। ধারণা করা হয়, এসব স্থানে যোগীদের সমাহিত করা হয়েছিল অথবা যোগীরা এসব স্থানে রাত্রি যাপন করতেন।
যোগীর ঘোপা থেকে ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে একই ইউনিয়নের বকুলতলার মোড়ে রয়েছে একটি মঠ। এখানে বিশাল ও উৎকৃষ্ট শিল্পমানের মঠ দেখে কিছুটা অবাকই হলাম। দীর্ঘদিনের অযত্ন আর অবহেলায় মঠের চারপাশে জঙ্গল তৈরি হয়েছে। এটিকে কাছ থেকে ছুয়ে দেখতে বেশ বেগ পেতে হলো আমাদের। স্থাপত্যটির গায়ে চমৎকার কারুকর্যময় নকশা এখনো রয়েছে। মাথায় ইটের কারুকাজও প্রশংনীয়। গঠনরীতি অনুযায়ী এটি শিখর দেউল রীতিতে নির্মিত মঠ। ষোড়শ বা সপ্তদশ শতকের স্থাপনা হতে পারে। কোন যোগী বা সম্মানীত ব্যক্তির স্মৃতির স্মরণে এধরণের মঠ নির্মাণ করার প্রচলণ ছিলো বাংলায়।
এ মঠের খুব কাছেই নাথ সম্প্রদায়ের ধর্মস্থান যোগীর ঘোপা। তাহলে এ মঠটি কোন মহান সাধকেরও হতে পারে। স্থাপনাটির সামনেই বেড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। অবাক করা বিষয় হলো, মঠটির প্রবেশমূখে টিন দিয়ে ঘিরে টয়লেট বানানো হয়েছে। মঠের কাছে যেতে হলে সেই টয়লেট পার হয়ে যেতে হবে। সেখানথেকে দুর্গন্ধও নাকে আসছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মঠটির চারপাশের বাড়িঘর দেখে মনে হলো এখানে অবস্থাসম্পন্ন মানুষরা বসবাস করেন। তাহলে এরকম কাঁচা টয়লেট মঠটির খুব কাছে বানানোর উদ্দেশ্যটাই বা কি? এছাড়া গরুর গোবর-ময়লা ফেলা হচ্ছে স্থাপনাটির আশেপাশে। সবমিলিয়ে মনে হয়েছে কেউ কেউ হয়তো চাচ্ছেননা মঠের কাছে কোন দর্শনার্থী আসুক বা এটির কথা কেউ মনে রাখুক। আরেকটি দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো সরকারী ওয়েবসাইডে ষোড়শ বা সপ্তদশ শতকে নির্মিত ঐতিহাসিক এই মঠটির কথা উল্লেখ নেই।
মঠ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে খোয়াজ খিজিরের মাজার। যোগীর ঘোপা থেকে এটি ৩ কিলোমিটার দূরে। বুড়িদহের প্রান্তে ফুলবন গ্রামে এটি অবস্থিত। তবে মাজারের বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। একটা বিশাল পাথরও দেখতে পেলাম। এখানে খোয়াজ খিজিরের মাজারের উপস্থিতি নাথ যোগীদের উদার নৈতিক ধর্ম বিপ্লবের স্বাক্ষর বহন করছে। বলা বাহুল্য যে, চারশত বছরের রাজত্বকালে পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা দান করলেও ধর্মীয় ক্ষেত্রে উদারতার পরিচয় দিয়ে প্রজাদের আকুন্ঠ সমর্থণ লাভ করেছিলেন। মাজারের চারপাশে বেশ কয়েকটি উচু ঢিবি। ঢিবি দেখেই সহজেই বুঝা যায় এখানে অনেক প্রাচীণ স্থাপনা ছিল, যা ধ্বংস হয়ে গেছে।
১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক চর্চার প্রাণপুরুষ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম যোগীর ঘোপায় এসেছিলেন। পরে আলেকজান্ডার কানিংহাম তার লিখিত ইতিহাস বইয়ে যোগী ঘোপার নিকটবর্তী আমাইড়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছিলেন। তিনি তার বর্ণনায়, এখানে অনেক প্রাচীণ ভাস্কর্য নিদর্শণ দেখার কথা উল্লেখ করেছেন। বিষ্ণু মূর্তি, শিবলিঙ্গ, ব্রহ্মলিপি, অষ্টশক্তিমূর্তি থাকার কথা উল্লেখ করেছিলেন তিনি। কানিংহাম পরিষ্কার জানিয়েছেন পাল বংশের বিখ্যাত রাজা দেবপালের মৃত্যু এখানে হয়েছিল এবং এখানেই তাকে দাহ বা সমাহিত করা হয়েছিল। এখানকার একটা ঢিবির কথা উল্লেখ করে আলেকজান্ডার কানিংহাম বলেছিলেন, পাল বংশের রাজা দেবপালের বাড়ি ছিলো এখানে। অনেক ইতিহাসবিদই আবার মনে করেন এখানে দেবপালকে সমাহিত করা হোক বা না হোক যোগীর ঘোপায় যে পাল আমলের অট্টালিকা ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এবার ফেরার পালা। গ্রামে যেন একটু আগেই সন্ধ্যা নামে। রাস্তায় আমাদের গাড়ীর হেডলাইটের আলো ছাড়া কোন আলো নেই। লোকজন ঘরে ফিরছে। ফিরতে ফিরতে মনে হলো, হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের ধর্মীয় মূল্যবোধের সৃষ্টির আকাঙ্খার প্রেক্ষিতে নাথ যোগীদের একাংশ সত্যপীরের ও মাদারপীরের উপাসনার উদ্ভব ঘটায় বলে কথিত রয়েছে।
পাল বংশ নিয়ে ইতিহাস বইয়ে কতই না আলোচনা, আর ইতিহাসবিদদের পাল বংশ নিয়ে কতই না আগ্রহ আর কতই না পড়াশোনা। অথচ পাল বংশের সফল রাজা দেবপালের স্মৃতিবিজড়িত পত্নীতলার আমাইড় ইউনিয়নের যোগীর ঘোপা কতই না অবহেলিত। অনেকেই জানেইনা যে, এখানে রাজা দেবপালের সমাধি অথবা দাহ করা হয়েছিল। কত বড় একটা ইতিহাস, কত অযত্ন আর অবহেলাই পড়ে রয়েছে। যথাযথ উন্নয়ন ও সংস্কারের অভাবে পাল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা দেবপাল ও গোরক্ষনাথের স্মৃতি বিজড়িত পত্নীতলা উপজেলার আমাইড় ইউনিয়নের ঐতিহাসিক মূল্যবান স্থান ও স্থাপনাগুলো এখন ধ্বংসের পথে।