আলী শাহপুর আর সোনামাসনা গ্রামের ইতিহাসের কান্না
কাইসার রহমানী
প্রকাশিত: ০৮:৫৫ পিএম, ১৬ জানুয়ারি ২০২২ রোববার আপডেট: ০৯:১৬ পিএম, ১৬ জানুয়ারি ২০২২ রোববার
আকাশ ছুঁতে চাওয়া সবুজ গাছপালা, পাখির মিষ্টি কিচিরমিচির শব্দ, আর জেলেদের চিরচেনা মাছ ধরার ছবিকে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল ইউনিয়নের সোনাইচন্ডির সোনামাসনা গ্রামের দিকে। আমাদের এই ছুটে চলাতে রাস্তার ধারের বুনোফুল যেন হেলে দুলে স্বাগত জানাচ্ছে তাদের পল্লী গ্রামে। পিচঢালা রাস্তার পাশেই সবুজ ধানের জমিতে বাতাসের হালকা দোলায় পুরো মাঠ যেন নড়েচড়ে উঠছে। এসব দেখতে দেখতে কখন যেন আমরা সোনামাসনা গ্রামের পৌছে গেছি তা খেয়ালই করিনি।
সোনামাসনা গ্রামে আসার কারণ হলো, অপরাজেয়বাংলা খবর পেয়েছে এই গ্রামে কিছু প্রাচীণ স্থাপনা অযত্ন আর অবহেলায় একেবারেই ধ্বংসের পথে। কোন এক রহস্যজনক কারণে, এইসব প্রাচীণ স্থাপনা গ্রামবাসীর কিছু মানুষ একেবারেই লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতে পছন্দ করেন। তারা চানও এসব ঐতিহাসিক প্রাচীন স্থাপনা ক্ষয়ে ক্ষয়ে তাড়াতাড়ি ধ্বংস হোক। কেন এরকম মানসিকতা সেসব প্রসঙ্গে অন্যদিন বলা যাবে। আজ শুধু কানে বাজছে, সোনামাসনা গ্রামের কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনার গুমোট কান্না।
ঐতিহাসিক কোন স্থাপনা গ্রামে আছে কিনা? এমন প্রশ্নে গ্রামবাসী অবাক হচ্ছেন। বেশিরভাগই জানেননা। কিছু প্রবীণ মানুষ আমাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে গেলেন স্থাপনার কাছে। সোনামাসনা গ্রামের মসজিদের পাশে কবরস্থান। সেই কবরস্থানের মাঝখান ঝোপ জঙ্গলে ভরা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘদিন এখানকার জঙ্গল পরিস্কার করা হয়নি। অথচ ঐ জঙ্গলের চারপাশ কতইনা পরিস্কর। অবাক হলাম, প্রাচীন এই স্থাপনাগুলো এতটাই গোপনীয়তার ঝরাপাতার নীচে জমা পড়েছে যে, খোদ সেই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই জানেননা তাদের গ্রামে রয়েছে ৫০০-৭০০ অথবা ১৩০০ বছরের প্রাচীন স্থাপনা।
ভিতরে গিয়ে দেখা মিললো কাঙ্খিত সেই স্থাপনার। প্রাচীন আমলের মঠ বলেই আমাদের কাছে মনে হলো। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের এরকম মঠের সোনাইচন্ডির পাশে ভাটখৈর ও দেওপুরা গ্রামেও দেখা মিলেছে। তবে এই মঠটি আকারে বেশ বড়। সাধারণত কোন বিশেষ ব্যক্তিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এ ধরণের মঠ নির্মাণ করা হতো।
যেহেতু এর কোন সুনির্দিষ্ট লিখিত ইতিহাস নেই তাই মঠটির আকৃতি ও কি দিয়ে তৈরি তা দেখে এর বয়স নির্ধারণ করতে হবে। মঠটি গৌড়ীয় ইট (ছোট আকারের পাতলা বিশেষ ইট) দিয়ে তৈরি, সেক্ষেত্রে এটি মুঘল আমলের বলা যায়, তাহলে এর বয়স দাঁড়ায় ৫০০ কিংবা তার থেকেও বেশি। আবার পাল আমলের তৈরি হয়ে থাকলে এটির বয়স বলা চলে ১৩০০ বছর। তবে এটির বয়স যে ৫০০ বছরের বেশি তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এটির একেবারেই ভগ্ন দশা। শরীর থেকে ইট খসে পড়ছে। পরজীবী স্থাপনার শরীরে বড় হয়ে তার শিকড়ের কারণে দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ছাদের একাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। একটি মাত্র দরজা। ভিতরে একটি মেহরাবও রয়েছে। দরজার পাশে সুন্দর নকশাও চোখে পড়লো। মঠটির উপরের অংশ থেকে প্রাচীন ইট বের হয়ে আসছে। জানাগেল এটির পাশে আরো দুটি মঠ ছিল একই আকৃতির। তবে সেগুলেঅ ভেঙ্গে পড়ে বিলীন হয়ে গেছে। ধ্বংসা বশেষ দেখা যাচ্ছে। আশে পাশে ছড়িয়ে রয়েছে পুরণো আমলের ইট। মাটি গর্ত করলেই উঠ আসছে ইট।
এই গ্রামের লোকদের কোনই ধারণা নেই এটি কেন, কারা, কবে নির্মাণ করেছিল। এরকম দৃষ্টিনন্দন ঐতিহাসিক স্থাপনা তাদের এই গ্রামেই বা কেন ? তবে এটির যে বিভিন্নমুখী ব্যবহার হয়েছে তা গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল।
প্রবীণ গ্রামবাসী আতাউর রহমান বলেন, তাদের বাপ-দাদারাও এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি ঠিক এরকমই দেখেছেন। তবে তারাও বলতে পারেননি এটি কি আর কারা, কখন তৈরি করেছিল। তবে গ্রামের বয়স্ক মানুষরা মনে করেন এগুলোর বয়স কম করে হলেও ৫০০ বছর হবে বলে জানান তিনি।
আরেক গ্রামবাসী আইজুর রহমান বলেন, এটির ইতিহাস তাদের জানা নেই। তবে অনেকেই আগে এখানে মানত করতে আসতেন বলে জানান তিনি।
সোনাইচন্ডীর সোনামাসনা গ্রাম থেকে এবার আমাদের যাত্রা একই জেলার নাচোল উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আলীশাহপুর গ্রামে। গ্রামটি নাচোল উপজেলার সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। আর এই গ্রামেই ৫০০ বছরের পুরণো একটি মসজিদ কালের সাক্ষী হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। কিন্ত এই ঐতিহাসিক মসজিদটির কথা নাচোলসহ জেলার অধিকাংশ মানুষই জানেননা।
প্রধান সড়কের পর, প্রায় আধা কিলোমিটাররের মতো কাঁচা রাস্তা পার হয়ে দেখা মিললো নাচোলের আলী শাহপুর মসজিদের। মসজিদটি বাইরে থেকে দেখলে, ভিতরের অনাবিল সৌন্দর্য ও ইতিহাসের বিন্দুমাত্র আঁচ পাওয়া যাবেনা। কারণ, মূল মসজিদটি ঠিক রেখে এটিকে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ভিতরে মূল মসজিদটি একেবারেরই আগের নকশাতেই রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র একসঙ্গে অনেক মানুষ নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে মসজিদটিকে বড় করা হয়েছে মূল মসজিদ ঠিক রেখে।
জানা গেল, আগের মূল মসজিদটিতে ৩০ জন মানুষ একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারতো, মসজিদটির অপরূপ নির্মাণশৈলীতে চোখের পলক যেন পড়তে চায়না। আকারে ছোট হলেও, নকশার মাধুর্যতা নান্দনিক করে তুলেছে স্থাপত্যটিকে। এটি একগম্বুজ বিশিষ্ট। এর দেয়ালের প্রস্থ ৩ ফুট। প্রশস্থতা ৪২ ইঞ্চি।
মসজিদের চারকোণায় রয়েছে চারটি বুরুজ। গম্বুজের চূড়ায় একটি মিনার আছে। উত্তর দক্ষিণে ২ টি জানালা। এটি গৌড়িয়া ইট দিয়ে তৈরি। দেয়ালে বিচিত্র নকশা। বাইরের দেয়ালেও বিচিত্র নকশা রয়েছে।
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ মসজিদটি প্রায় ৫০০ বছর আগে নির্মিত। আবার কেউ কেউ মনে করেন ছয় থেকে সাতশো বছর আগে এ এলাকায় আলীশাহ নামক ধর্মপরায়ন এক ব্যক্তি ধর্ম প্রচারের জন্য এসে মসজিদটি নির্মাণ করেন। আর এই কারণেই তার নামানুসারে গ্রামের নাম রাখা হয় আলী শাহপুর। মসজিদটির দুদাগে ৩৬ শতক জমি হযরত আলী শাহর নামে আরএস রেকর্ড রয়েছে বলে জানা গেছে। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে আরো জানাগেল, স্বাধীনতার আগে মসজিদটির আশে পাশে বল জঙ্গলে ভরা ছিল। তাই কেউ জানাতো না যে, এখানে একটি মসজিদ রয়েছে। স্বাধীনতার পর গ্রামেরই এক ব্যক্তি এটি দেখতে পান। পরে সেখানে নামাজ আদায় শুরু হয়।
মসজিদটির আধা কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে পীর পুকুর নামে একটি উঁচু ঢিবি ও পুকুর রয়েছে। পুরো ডিবিটিই ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। ঢিবিটির উপর ও আশে-পাশে প্রচুর টুকরো টুকরো পাথর ও ইটের দেখা মিললো। একটু গর্ত করলেই উঠে আসে গৌড়িয় ইট। ইটের গাঁথুনী দেখে সহজেই বুঝা যায় এখানে কোন প্রাচীন স্থাপনা ছিল।
জঙ্গলে ঘেরা উঁচু স্থানে যেতেই দেখা গেল গ্রামের কিশোর মনির কোদাল দিয়ে গর্ত করছে উচু ঢিবিতে। কেন সে এমন করছে জিজ্ঞেস করলে মনির জানান, এখানে গর্ত করলে পুরণো আমলের হরিণ, জিরাফ, বাঘ ইত্যাদির মাঠের পুতুল পাওয়া যায়। আমাকেও সে কয়েকটা পুতুল দিল। পুতুল গুলো হাতে নিয়ে দেখলাম এগুলো মাটির তৈরি। পুরণো অনেক। গ্রীক নকশার পুতুলের মতো অনেকটা।
গ্রামবাসী এই স্থানটিকে পবিত্র স্থান মনে করেন। আলী শাহপুর এলাকার নামকরণ ও নানান আলামত থেকে অনেকেই অনুমান করেন, এই স্থানটি আলী শাহ নামক কোন বুজুর্গ ব্যক্তির মাজার হতে পারে। কালের বিবর্তণে এই মাজার মাটিতে দেবে গেছে, আর এই ঘটনা ৫০০ বছরের আগের।
এবার ফেরার পালা। চারপাশে প্রকৃতি দেখে মনে আসলো, গৌড় অঞ্চল চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাল, সেন থেকে শুরু করে বখতিয়ার খলজি পর্যন্ত কতই না ইতিহাসের চরিত্রদের পায়ের ধূলি পড়েছে, কতই না ইতিহাস তৈরি হয়েছে আনাচে-কানাচে। যেগুলোর কিছু জানা আর কিছু অজানা। তবে সোনা মসজিদ, তাহখানা, নওদা বুরুজ, দারাসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসার মতো ঐতিহাসিক স্থাপত্য যেখানকার মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই মাটির এখানে সেখানে ইতিহাস থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর এই ইতিহাস শুধু প্রকাশের অপেক্ষায়।