অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

খোজাদের খোঁজে শিবগঞ্জে

কাইসার রহমানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ০৫:১৭ পিএম, ৬ জানুয়ারি ২০২২ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ০৫:৩৫ পিএম, ৬ জানুয়ারি ২০২২ বৃহস্পতিবার

খোজার ডিহিতে পড়ে আছে এমন অনেক বিশাল বিশাল পিলার

খোজার ডিহিতে পড়ে আছে এমন অনেক বিশাল বিশাল পিলার

আমাদের গন্তব্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের সীমান্তঘেঁষা একেবারেই প্রত্যন্ত গ্রাম শিয়ালমারিতে। সেখানে যাবার কারণ হলো, শিয়ালমারি গ্রামের একটি অংশে ইতিহাসের অন্যতম ট্রাজিক চরিত্র “খোজা” গোত্রের মানুষদের একটি গ্রাম ছিল, যার নাম খোজার ডিহি। এ গ্রামে একসময়ে খোজাদের বসবাস নিয়ে ঐতিহাসিক সত্যতা না থাকলেও, ইতিহাসবোদ্ধাদের একটা অংশ দাবি করেন এখানে খোজাদের গ্রাম ছিল। 

গ্রামটি এখন ধ্বংস প্রাপ্ত, তবে, মাটির নীচ ও উপরে মধ্যযুগে খোজাদের নির্মিত মসজিদ ও ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তুপ এখনো তাদের অস্তিত্ত্বের কথা জানান দিচ্ছে। শেয়ালমারি গ্রামের খোজাদের এ গ্রাম নিয়ে আগে কোন কাজ হয়নি, লিখিত কোন ইতিহাস নেই, আর সম্ভবত কোন মিডিয়াও এ গ্রাম নিয়ে কোন সংবাদ করেনি। অপরাজেয়বাংলার এ গ্রামের উপস্থিতিতে তাই আশেপাশের লোকজন একটু অবাকই হয়েছেন। 

যেহেতু প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাজা-বাদশা-সুলতান-জমিদারদের হেরেমখানার সঙ্গে জড়িত খোজাদের ইতিহাস সেভাবে সামনে আসেনি তাই নির্মমতা-বর্বরতার শিকার খোজা গোত্রের জীবনাচরণ, আবাসস্থল কেমন ছিল তা জানার আগ্রহ ইতিহাস প্রেমীদের অনেক আগেই থেকেই। খুব কাছ থেকে দেখার জন্য তাই আমাদের এই ছুটে চলা। 

একটু জেনে নিই খোজা আসলে কি? খোজা গোত্রের মানুষকে বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে হেরেমখানাকে। হারেম একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ অন্দরমহল। হারেমে থাকতো রাজা বা রাজ পুত্রদের বিনোদনের জন্য শত শত- হাজার হাজার যুবতী মেয়ে এবং যুবতী নারী। হারেমে নারীদের কাজই ছিল রাজা বা তার পুত্রদের মনোরঞ্জন করা। মুঘল ও অটোমান আমলে হারেম প্রথা বিকশিত হয়।  আর এই হারেমখানা পাহারায় যারা নিযুক্ত থাকতো তারা ছিল খোজা। তাদের খোজা করে দেয়া হতো যাতে তারা যৌন ক্রিয়াই অংশ নিতে না পারে। খোজাদের হারেম পাহারায়  রাখা হতো, কারণ রাজা বাদশা নিশ্চিত হতে পারতেন যে হারেমে জন্ম নেয়া শিশুর পিতা অন্য কেউ নন, তিনি নিজেই। 

সুলতানী, মুঘল, নবাব আমলের ইতিহাস রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সুতরাং এখানেও যে হারেম খানায় খোজাদের অংশ গ্রহণ ছিল, তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। তাহলে মধ্যযুগে এখানকার খোজা গোত্রের মানুষদের বসবাস ছিল? তারা গেলই বা কোথায়?

ইতিহাস বোদ্ধাদের একটা অংশ বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দাবি করেন, মধ্যযুগে শিবগঞ্জ উপজেলার শিয়ালমারির খোজার ডিহিতে খোজা গোত্রের মানুষজন বসবাস করতেন। বিশাল আমবাগান আর রাস্তার পাশের চিরচেনা গ্রামীণ পরিবেশ পার হয়ে বিশাল আমের বাগানে। চারপাশে শুধু গাছ আর গাছ। জনবসতি একেবারেই কম। যাবার কোন বড় রাস্তাও নেই। ডোবা, নালা, খাড়ি আর নির্জন বাঁশঝাড়ে মাঝে  গা ছম ছম করে উঠে। এমন প্রত্যন্ত গ্রামে খোজার ডিহী। 

ভাবতে অবাক লাগে বর্তমানে এমন গহীন নির্জন আমবাগানের একটি অংশে পড়ে রয়েছে মধ্যযুগের বিশাল বিশাল পাথরের স্তম্ভ । আশেপাশে কোন জনবসতি নেই। অথচ বিশাল বিশাল পাথরের পিলার। দেখলই বোঝা যায় এখানে কোন স্থাপনা ছিল।  পাথর দেখলেই বুঝা যায় এগুলোর সময়কাল- মধ্যযুগ। নকশা করা সুন্দর পাথর স্তম্ভগুলো পিলার হিসেবে ব্যবহার হতো। চারপাশে দেখতে পেলাম বড় বড় পাথরের স্থম্ভ পড়ে রয়েছে। কোন কোনটা মাটির নিচে দেবে আছে। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নকশা করা পাথর খন্ড। পাথরের গাম্ভীর্যতা দেখেই বুঝা যাচ্ছে, এগুলো দিয়ে কোন স্থাপনা তৈরির সক্ষমতা কোন জমিদারের থাকার কথা না। এগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল রাজ শাসন।  

প্রবীণ গ্রামবাসী জমির আলী। বয়স ৬৩। বাগানের মধ্যে গরুকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য তার বেশ কয়েকটা গরু নিয়ে এসেছিলেন। তার সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলেন,  এই স্থানটিকে খোজার ডিহি বলা হয়। তার বাপদাদারা গল্প করতেন এখানে খোজাদের গ্রাম ছিল। আর যে সব পাথর পরে রয়েছে এখানে একটা খোজাদের মসজিদ ছিল। যা ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি জানান, স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ মাটির নীচ ও উপরে রয়েছে। মাটি গর্ত করলেই পুরণো আমলের ইট পাওয়া যায়। 

খোজার ডিহির চারপাশে রয়েছে পুরণো আমলের ইট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখলাম। মাটি একটু গর্ত করলেই পাথর ও ইটের টুকরো উঠে আসছে। এসব ইটের ব্যবহার দেখে সহজেই অনুমান করা যায় এখানে কোন স্থাপনা ছিল।  

এই খোজার ডিহির অবস্থান আগের বর্ধিত গৌড় থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার। অনেকেই বলেন, এই অঞ্চলে খোজাদের বসতি ছিল মধ্যযুগে। তাদের ঘর বাড়ি আর উপসনার স্থাপনা ছিল এখানে, খোজার ডিহির ধ্বংস স্তুপ সেকথায় প্রমাণ করে। সুলতানি আমলের বিখ্যাত ছোট সোনা মসজিদ, চামচিকা মসজিদ, দারাসবাড়ি মাদ্রাসা এই খোজার ডিহি থেকে মাত্র ২০ মিনিটের পথ। ভৌগলিক ভাবেও খোজার ডিহিতে যে খোজাদের বসবাস ছিল সেটাও প্রমাণ করার চেষ্টা করেন অনেকে। খোজার ডিহির আশে পাশে আরো অনেক স্থাপত্য বা স্মৃতিচিহ্ন আছে, তবে সীমান্ত এলাকা আর বিধি নিষেধের কারণে বেশি ভিতরের দিকে আর যাওয়া হলোনা।  

বর্তমানে অযত্ন আর অবহেলাই পড়ে রয়েছে খোজার ডিহি, দেখার যেন কেউ নেই। ধিরে ধিরে মাটিতে মিশে যাচ্ছে খোজাদের ইতিহাস। স্থানটি দেখলে মনে হয়, প্রাচীণ ও মধ্যযুগে মানবতাবাদী অপরাধ, নির্মমতা আর বর্বরতার শিকার জনমদুখী খোজা গোত্রের মানুষদের স্মৃতিচিহ্ন বর্তমানেও যেন অবহেলিত- বঞ্চিত ঠিক আগের সময়ের মতোই।

খোজা” গোত্রের মানুষদের গ্রাম খোজার ডিহি নিয়ে তথ্যচিত্র দেখুন এখানে