মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের সূর্য
কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: ০৭:২২ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০২২ বুধবার
কবির য়াহমদ
নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশ। ঐতিহাসিক অর্জন এটা। অভাবনীয় নিঃসন্দেহে। এমনটা কি ভেবেছে কেউ আগে? ভাবেনি নিশ্চিত; আমিও না। কেন ভাবিনি, কেন ভাবেনি কেউ- তার স্বপক্ষে যুক্তি আছে ঢের। কারণ সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স, বিদেশের মাটিতে আমাদের খেলার ফল এবং সবচেয়ে জরুরি দেশের মাটিতে নিউ জিল্যান্ড দীর্ঘদিন ধরে অজেয় এক দল। তার ওপর তারা টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। আর আমাদের অবস্থান তালিকার নিচের দিকে, জিম্বাবুয়ের ঠিক উপরে মাত্র!
এর বাইরে আছে নিকট অতীতে, বলা যায় সবশেষ টেস্টে নিজেদের দেশে মাত্র আড়াই দিনে হেরে যাওয়ার করুণ ইতিহাস। পাকিস্তানের বিপক্ষে যে ভঙ্গিমায় ক্রিকেট খেলে হেরেছে তার কোন জবাব নেই। এমনই বাজেভাবে হেরেছিল মমিনুলরা যেখান থেকে আশাবাদী হওয়ার মত রসদ খোঁজা ছিল দুষ্কর। তবু বাংলাদেশ পেছনটা পেছনে ফেলে রেখে নব-উদ্যমে, নতুন বছরে, নতুন পরিবেশে, নতুন মানসিকতায় খেলেছে নিউ জিল্যান্ডে। স্বাগতিকদের বিপক্ষে পাঁচদিনের প্রতিটা সেশনে প্রতিপক্ষের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে জিতে নিয়েছে ম্যাচ। শেষ কবে কিংবা আদৌ এমন খেলেছিল কি-না বাংলাদেশ, এনিয়ে ক্রিকেট-পণ্ডিতরা বিতর্কে যাবেন; এমনই পারফরম্যান্স বাংলাদেশের।
মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের বে ওভালে টস জয় দিয়ে শুরু, ম্যাচ জয় দিয়ে তার পূর্ণতা। টস জিতে প্রতিপক্ষকে ব্যাট করতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত সাহসীই। যেকোনো উইকেটে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করতে যাওয়ার সাহস কম কথা না কিন্তু! প্রতিকূল পরিবেশ, স্বাগতিকদের শক্তিমত্তা, নিজেদের দুর্বলতা ও খর্বশক্তি সবকিছু সঙ্গে ছিল, কিন্তু কী অবলীলায় সেশনের পর সেশন ধরে পরিকল্পিত ও কার্যকর ক্রিকেট খেলে গেছে দল। অসাধারণ!
এটা সবার জানা যে, নিউ জিল্যান্ড নিজেদের মাটিতে কতখানি শক্তিশালী। ২০১৭ সালের মার্চের পর থেকে টানা ১৭ ম্যাচ অপরাজিত তারা। ১৩ জয়ের বিপরীতে ড্র মাত্র ৫টি। এই জয়গুলোর মধ্যে ৮টি জয়ের ব্যবধানে সঙ্গে জড়িয়ে ইনিংসের নাম, অর্থাৎ দ্বিতীয়বার ব্যাট করতে হয়নি তাদের। আর এদিকে, আমরা বিদেশের মাটিতে সবশেষ টেস্ট সিরিজ জিতেছিলাম সেই ২০০৯ সালে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। এরবাইরে আমাদের প্রিয় প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আর এশিয়া মহাদেশের বাইরে কিছু জেতা হয়নি আমাদের।
দুই দলের তুলনামূলক আলোচনায় যোজন-যোজন এগিয়ে নিউ জিল্যান্ড। সব আলোচনা সম্ভব নয়, সামর্থ্যও নেই আমার। শুধু নিজের ভালোলাগার অনুভূতিটুকুই লিখে রাখছি এখানে। আমি নিশ্চিত টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ৫ জানুয়ারির ভোরের মত কোন ভোর আগে আসেনি আর। এমন মহিমান্বিত ভোর আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে অনেকদিন, অনেক বছর।
না, বলছি না এখানেই বন্ধ আমাদের অর্জনের খাতা। আমরা আদতে আমাদের অর্জনের খাতায় স্থায়ী যতিচিহ্নের যোগ এঁকে দেওয়ার পক্ষপাতী নই। আমরা চাই নিয়ত সমৃদ্ধ হোক এ খাতা, যুক্ত হোক নতুন-নতুন অধ্যায়। তাই অর্জনের খাতায় এই অর্জনকে উৎসাহমূলক প্রপঞ্চ হিসেবে যুক্ত করতে আগ্রহী।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে টানা পারফর্ম করা পাঁচ সিনিয়রকে ভালোবেসে আমরা বলি ‘পঞ্চপাণ্ডব’। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে এই সিরিজে নেই পাঁচজনের চারজনই। মাশরাফী বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ নানা কারণে নেই দলে। আছেন কেবল মুশফিকুর রহিম। অর্থাৎ তারুণ্যনির্ভর দল পুরোটাই। টেস্ট অধিনায়কত্বের দায়িত্ব যার কাঁধে এই ফরমেটের ক্রিকেটে পারফরমার হলেও সেই মমিনুল তরুণই। একাদশে থাকা অন্যরা হলেন- মাহমুদুল হাসান জয়, সাদমান ইসলাম, নাজমুল হোসেন শান্ত, লিটন দাস, মুশফিকুর রহিম, ইয়াসির আলী রাব্বি, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদ, শরিফুল ইসলাম ও এবাদত হোসেন চৌধুরী। এই দলকে নিয়ে কেউ কি ভেবেছে এভাবে নিউ জিল্যান্ডকে গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব?
পূর্বতন ভাবনা যাই হোক মাঠের লড়াইয়ে শ্রেয়তর দল হিসেবে জিতেছে বাংলাদেশ। ব্যাট হাতে ব্যাটাররা দেখিয়েছেন দৃঢ়তা, বল হাতে বোলাররা পালন করে গেছেন তাদের দায়িত্ব। সম্ভবত এই প্রথম বাংলাদেশ দলের প্রথম আট ব্যাটার খেলেছেন কমপক্ষে পঞ্চাশ বল। এদের মধ্যে দুইজন করে খেলেছেন দুই শতাধিক বল আর একশ’র বেশি বল। চারজন খেলেছেন অন্তত পঞ্চাশের বেশি বল।
ম্যাচ জিততে প্রতিপক্ষের বিশ উইকেট নিতে হয়। এখানে সফল বাংলাদেশের বোলাররা। বিশেষত চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে বাংলাদেশ দলের পেসাররা বে ওভালে যে আগুন ঝরিয়েছেন তা মুগ্ধ করেছে ক্রিকেটবিশ্বকে। এবাদত হোসেনের কথা আলাদাভাবেই বলতে হয়- আগুন, রীতিমত আগুন এই পেসবোলার। দ্বিতীয় ইনিংসে একাই নিয়েছেন ছয়-ছয়টি উইকেট, দাঁড়াতেই দেননি টেস্ট চ্যাম্পিয়নদের। অথচ এই ম্যাচের আগে গোনার মধ্যেই ছিলেন না এবাদত-শরিফুল-তাসকিনরা। থাকবেনই বা কীভাবে যেখানে রেকর্ড কথা বলে না তাদের পক্ষে। বাংলাদেশের তিন পেসারের মোট উইকেট সংখ্যা ছিল ৪৫, সেখানে নিউ জিল্যান্ডের চার পেসারের টেস্টে সম্মিলিত উইকেটসংখ্যা ছিল ৯০৭। বোল্ট-সাউদি-ওয়াগনারের কথা বাদই দিলাম, সবচেয়ে কম টেস্ট খেলা জেমিসনের একার উইকেটসংখ্যাই ছিল বাংলাদেশের তিন পেসারের সম্মিলিত উইকেটসংখ্যার চেয়ে বেশি, সংখ্যার হিসাবে যা ৫৪!
আমি ক্রিকেট বিশ্লেষক নই, ক্রিকেট দর্শক। তাই খেলার চুলচেরা বিশ্লেষণ আমার কাজ না। শুধু অর্জনের কথাটুকু লিখে রাখছি, আগামীর অনুপ্রেরণার ক্ষণটুকু লিখে রাখছি যাতে আসছে দিনে এটাও আমাদের অর্জনের পাথেয় হয়।
প্রকৃতিবন্দনায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছেন নতুনের গানে। বঙ্গাব্দের নতুন বছর নয় এখন, এখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের খ্রিষ্টীয় নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহ। স্বাভাবিকভাবেই বৈশাখ নয়, পৌষের শেষাংশ। খ্রিষ্টীয় নতুন বছরে আমরা বঙ্গাব্দের নতুন বছরের মত কবির শব্দ ধার করে উচ্চারণ করেছিলাম- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।/রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,/আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।’ গেল বছরের এবং বিগত দিনের গ্লানি শেষে এবার সত্যি ক্রিকেটে আশার সূর্য উঠেছে নিউ জিল্যান্ডে।
এই ধারা আমরা ধরে রাখতে চাই; সাফল্যের এই ধারা ধরে রাখা প্রয়োজন আমাদের!
কবির য়াহমদ
৫ জানুয়ারি ২০২২