পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু: সংবাদের সমন্বয়ে গুরুত্ব বাড়বে সমস্যার
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশিত: ০৪:২৫ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০২২ বুধবার আপডেট: ০৪:৪৫ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০২২ বুধবার
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুরোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আলোচনায় বক্তারা
বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। বেসরকারি সংস্থা গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই)-এর তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু ডুবে মারা যায়। কিন্তু এ সমস্যাটি অপ্রতিরোধযোগ্য নয়, বরং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব। এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে গণমাধ্যমগুলো।
বুধবার (৫ জানুয়ারি) রাজধানীর কারওয়ান বাজারের দ্য ডেইলি স্টার সেন্টার-এ অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে গণমাধ্যের ভূমিকা’ শীর্ষক এক জাতীয় পরামর্শসভায় এসব কথা বলেন বক্তারা। সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. গোলাম রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান সমষ্টি’র আয়োজনে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মেহের আফরোজ, জিএইচএআই-এর বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস সহ অন্যরা। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও প্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে নিজের ছেলেবেলার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, তিনি পানির সাথেই বেড়ে উঠেছেন। সাঁতরে ও নৌকা দিয়ে স্কুলে গিয়েছিলেন। সে সময় পানিতে ডুবে মরার ব্যাপারটি সবাই স্বাভাবিক ও অনিবার্য হিসেবে নিলেও এখন সবার মাঝে সচেতনতা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জিএইচএআই-এর আঞ্চলিক পরিচালক বন্দনা সাহা’র আগে থেকে ধারণকৃত ভিডিওবার্তা প্রচার করা হয়। এ সময় তিনি সংস্থাটির বাংলাদেশে শিশুমৃত্যু নিয়ে তার সংস্থার করা কাজ নিয়ে ধারণা দেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের উদ্ভাবিত ডে-কেয়ারসহ অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ সমস্যা রোধে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে ভিয়েতনাম।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরামর্শক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ এ সমস্যাটির বিষয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। শিশুদের পক্ষে বলার কেউ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের জন্য আমাদেরকেই কাজ করতে হবে। তিনি পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর মতো সমস্যা নিয়ে কম্যিউনিটি রেডিওতে আরও বেশি সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের ওপর গুরুত্ব দেন। এছাড়া শিশু একাডেমির মতো সংস্থাগুলোক তিনি এ সমস্যা নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথি মেহের আফরোজ মন্তব্য করেন, শিশুক লালন-পালনের মূল দায়িত্ব মা সম্পাদন করেন, কিন্তু মায়ের প্রতি আমরা যত্নবান থাকি না। তিনি জানান, দেশে ডে-কেয়ার সেন্টার আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি শিশু অ্যাকাডেমি, তথ্য আপা ইত্যাদি বিষয়গুলোকেও এ সমস্যা সমাধানে কাজ করার ব্যাপরে সংযুক্ত করার কথা জানান। কেবল খবরে নয়, নাটক-টেলিফিল্ম ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেও এ ব্যাপারে সচেতনতা চালানোর জন্য উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের আহ্বান জানান মেহের আফরোজ।
অধ্যাপক গোলাম রহমান তার বক্তব্যে বলেন, সবকিছু সংবাদ হয়না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হলে তা কেবল তথ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি শিশুর ওপর নজরদারি করার ব্যাপারে বেশি গুরুত্বারোপ করেন। প্রয়োজনে শিশুকে দেখাশোনার ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া গণমাধ্যমে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর খবরকে বিক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ না করে সমন্বিতভাবে প্রকাশ করলে তা-তে সমস্যাটি বেশি গুরুত্ব পাবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের শিশুমৃত্যুরোধে গৃহীত এ সম্মিলিত উদ্যোগকে ফলপ্রসূ করার ক্ষেত্রে কাজ করার আহ্বান জানান।
জিএইচএআই-এর তথ্য ব্যাবস্থাপক সারওয়ার ই আলম বলেন, আমাদেরকে পানিতে ডোবা নিয়ে বিভিন্ন স্টেরিওটাইপ ও অতিসাধারণীকরণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে প্রতিদিন পানিতে ডুবে মৃত শিশুর সংখ্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি ক্লাসে থাকা মোট শিশুসংখ্যার সমান বলে তিনি জানান।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি পানিতে ডুবে মারা যায়। এরপর বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ সংখ্যা কমতে থাকে। কারণ একটু বয়স হলে শিশুদের পানি’র বিপদ নিয়ে ধারণা বাড়ে। এছাড়া ওই বয়সে তারা স্কুলে যাওয়ার কারণে একটি প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তার মধ্যে থাকে।
সমষ্টি-এর গবেষণা ও যোগাযোগ বিষয়ক পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল হক বলেন, স্কুলে যাওয়া শিশুদের ডুবে মরার হার গত দুই বছরে বেড়ে গিয়েছে। কারণ করোনার কারণে এ সময় স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় শিশুরা প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারির বাইরে ছিল।
জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালের এক জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট দুই হাজার ১৫৫ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা গেছেন যার মধ্যে এক হাজার ৭৯৯ জন শিশু ছিল। দেশের গণমাধ্যমগুলোতে কেবল থানা ও হাসপাতালে রিপোর্ট হওয়া ঘটনাগুলো প্রকাশ পায়, এর বাইরে আরও অনেক ডুবে মরার ঘটনা নিয়মিত ঘটছে যা আমাদের অগোচরে রয়ে যাচ্ছে।
জিএইচএআই-এর কান্ট্রি লিড রুহুল কুদ্দুস বলেন, শিশুমৃত্যু অপ্রতিরোধযোগ্য নয়। এর জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় ও যথাযথ বাজেট।
অনুষ্ঠানে বক্তারা জানান, বাংলাদেশের ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধ’ বিষয়ক রেজুলেশন জাতিসংঘে গৃহীত হয়েছে। দেশের গ্রামাঞ্চলে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ডে-কেয়ার সেন্টার ‘আঁচল’ তৈরি করা হয়েছে যেখানে পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের দেখাশোনা করা হয়। এসব কেন্দ্রে একজন আঁচল মা ও তার একজন সহকারী থাকেন যারা এ শিশুদের দেখাশোনা করেন। প্রাথমিকভাবে মোট আট হাজার আঁচল কেন্দ্র তৈরি করার চিন্তা করা হয়েছে যেখানে ১৬ হাজার নারীর কর্মসংস্থান হবে। এ প্রকল্প থেকে দেশে দুই লাখ শিশু ডুবে মরার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে আলোচনা করেন বক্তারা। এ সময় সাংবাদিকেরা তাদের মতামত, প্রশ্ন ও পরামর্শ তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে তিনজন সাংবাদিককে ফেলোশিপ প্রদান করা হয়।