অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

কোনো বয়সেই আমি নিরাপদ নই

কাজী সারাহ সাদীয়া নূর

প্রকাশিত: ০২:৪০ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০২১ শুক্রবার   আপডেট: ০৬:৫১ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০২১ শুক্রবার

মধ্যবিত্ত পরিবারের বেশিরভাগ মানুষ বছরখানেক ধরে চিন্তাভাবনা করে এক পা এগিয়ে, চার পা পিছিয়ে তবেই কোনো কাজ করে। আর সেটি যদি হয় গাট্টিবোচকা বেঁধে কোথাও বেড়াতে যাওয়া তাহলেতো কথাই নেই। এই মেয়েটিও হয়তো তাই করেছিল। টাকা পয়সার টানাটানি, স্বামীর চাকরির দোদুল্যমানতা, সংসারের নিত্য খ্যাঁচাখেঁচির মধ্যেও নিশ্চই রাতের পর রাত স্বামীর সঙ্গে বসে কক্সবাজার যাবার প্ল্যান করেছেন। হিসাবের খাতায় কাটাকুটি পড়েছে, মাত্র আট মাসের সন্তান নিয়ে ‘যাবো কি যাবো না’ প্রশ্নে এগিয়েছেন পিছিয়েছেন। শ্বশুরবাড়ি-বাপের বাড়ি থেকে ‘না’ শুনেছেন। কিন্তু জীবনের ক্লান্তি থেকে বাঁচার তাগিদ এই দম্পতিকে শেষমেশ টেনে এনেছে সমুদ্র নামক বিশ্বালত্বের সামনে। 

পরবর্তী ঘটনা হলো-বালুচর দিয়ে হেঁটে পানির দিকে নামার সময় এক যুবকের সঙ্গে ধাক্কা লাগে মেয়েটির। হয় কথা-কাটাকাটি। এর জের ধরে তাকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

একটি ঝুপড়ি চায়ের দোকানে নিয়ে তিনজন মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। এখানেই শেষ নয়, তারপর একটি রিসোর্টে নিয়ে তাকে আটকে রাখা হয়। পরে দুর্বৃত্তরা কক্ষের দরজা বাইরে থেকে লক করে চলে যায়। এসব ঘটনা যেন কাউকে জানানো না হয়, সে নিয়ে ভয়ভীতিও দেখানো হয়। ভয়াবহ এই ঘটনাটি ঘটেছে ২২ ডিসেম্বর।

'আমার ঝট করে মনে পড়লো, সেদিন সন্ধ্যার পর ইস্টার্ন প্লাজা থেকে বের হওয়ার সময় একজন আমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দেয়। আমিও তুমুল কথা কাটাকাটিতে জড়াই। কপালগুণে জায়গাটি ঢাকা শহরের জনাকীর্ণ হাতিরপুল, তাই বসে এসব লিখতে পারছি।'

দুই
মহামারির বিষময় বছর গেছে ২০২০। ওই বছরে দমবন্ধ দিনগুলো একটু একটু করে স্বাভাবিক হয় সেপ্টেম্বর থেকে। সে মাসে বাসাবন্দী থেকে হাঁপিয়ে যাওয়া তরুণী স্ত্রীকে নিয়ে স্বামী ঘুরতে যান বাড়ির কাছেই, সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজে। তাদের অপরাধ হলো বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। ওই দম্পতি যখন বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, নয় জনের একটি দলবল তাদের পথ আটকে মোবাইল, টাকা-পয়সা, ঘড়ি ও গাড়ির চাবি কেড়েকুড়ে নেয়। এরপর কলেজের ছাত্রবাসে আলাদা আলাদা কক্ষে স্বামী-স্ত্রীকে আটকে রাখা হয়। এবং তরুণী স্ত্রী গণধর্ষণের শিকার হন।
‘মেয়েদের একা কোথাও যেতে হয় না’-এখানে থিওরিটি মাঠেমারা গেছে। 

তিন
রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন স্বামী-স্ত্রী। হঠাৎ করে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুরের দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা ফিল্মি কায়দায় ঘরে ঢোকে। মুহুর্তেই স্বামীকে বেঁধে ফেলে ওই নারীকে বিবস্ত্র করে বিভৎস নির্যাতনের ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয়। এরপরে নারীকে হামলাকারীরা কুপ্রস্তাব দিলে তিনি তাতে রাজি না হওয়ায় ওই ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়, যা মুহূর্তের মধ্যে হয় ভাইরাল। মনুষ্য চেহারাধারী ওই দুপেয়ে জানোয়ারদের বারংবার বাবারে ভাইরে ডেকে, হাতে পায়ে ধরেও রেহাই মেলেনি হতভাগ্য নারীর।

‘হাতে হাতে স্মার্টফোন, সেই ভিডিও দেখে কেউ স্তম্ভিত হয়েছেন, কেউ পেয়েছেন বিকৃত আনন্দ। কারোর চোখ ভিজেছে অসহায়ত্বের গ্লানি-লজ্জায়।’ 

বাসায় ফিরতে আমারও মাঝেমধ্যে রাত হয়। রাত ৮টা পেরুলেই কাজী সাহেব টেনশনে দরজা খুলে রাখেন হাট করে। আম্মা জানালা দিয়ে একশোবার উঁকি দেন সামনের রাস্তায়, টেনশন তুঙ্গে উঠলে লিফটের সামনে এসে দাঁড়ান বারবার। দুজনের ফোনের জ্বালায় আমি হাত থেকে মোবাইলটা ব্যাগে পর্যন্ত রাখতে পারিনা। এসব নিয়ে রেগেমেগে কিছু বললেই তারা বলেন, ‘তোরা বুঝবি না, মেয়েরা কোনো বয়সেই কোনো জায়গায় নিরাপদ না, চারপাশে কি ঘটে দেখো না?’।

ছোট বোন দেবযানীকে সিডনিতে তার কাজের জায়গা থেকে বাসায় ফিরতে হয় ট্রেনে চেপে। মহামারিতে লোকসমাগম কম। আমার মাথায় ঘোরে ফাঁকা স্টেশন আর কম্পার্টমেন্টে দেবযানীর একা বসে থাকার একটা অদ্ভুত ছবি। চিন্তায় মন ছটফট করে। 

সিলেট মেডিকেলে ফুপাতো বোন ডাক্তার বুশরাকে নাইট ডিউটি করতেই হয়। মামণি (বুশরার মা) ওই রাতগুলোয় ভালোভাবে ঘুমাতে পারেন না। তাই সপ্তাহের তিন রাত তার হাইপ্রেশার মগডালে চড়ে থাকে। 

মামাতো বোন নেভি অফিসার দীশা যখন জাহাজে চড়ে বন্দরে বন্দরে নোঙর ফেলে, আমার মামীর দুঃশ্চিন্তার নোঙর জমি পায়না, ভাসে অথৈ জলে। 

মামাতো বোন উষা তার জামাইকে সঙ্গে নিয়ে গভীর রাতে ঢাকার কোনো ফ্লাইওভারে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে পোস্ট দিলেও, আম্মা উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলেন ‘ছেলেমেয়েদের বুদ্ধি আর হবে না, জামাই নিয়েও এতো রাতে বের হওয়া যে ঠিক না, সেটা ওরা বুঝবে কবে!’

সেদিন রাত দশটায় ধানমন্ডির আনাম র‌্যাংগস প্লাজা থেকে ভাইবৌ তিশা একা বাসায় ফিরতে চাইলে, আমরা সমস্বরে না না করে উঠলাম। যদিও বাসা মাত্র ১৫ মিনিটের দূরত্বে। কারণ ওই একটাই ‘নিরাপত্তা’।
আমার সাড়ে চার বছরের ভাতিজি কাজী অনিন্দিতা খেলেতে খেলতে বাসার লবিতে যাচ্ছে বা সাইকেল চালানোর জন্য নিচে নামছে-ভাবলেই বুকটা আমার ধুকপুক করে ভয়ে। মনে পড়ে আম্মার কথা ‘মেয়েরা কোনো বয়সেই কোনো জায়গায় নিরাপদ না’।

এসব ঘটনার কি বিচার হয় না! হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তরিৎগতিতে ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন। অনেক সময় তাড়াহুড়ায় এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অভিযোগপত্রে আসল অপরাধীদের নামই ওঠে না। আবার, বিচাররিক আদালতে একদম সঠিক রায়ও হয় এবং পরের ধাপ অর্থাৎ সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দণ্ডিতরা ফাঁকফোকর গলে বহাল তবিয়তে বেরিয়েও আসে।

কিন্তু যারা ঘটনার শিকার, তারা আসলে কেমন থাকেন। প্রথমবারের পর, থানায়, মেডিকেল টেস্টে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার ধাক্কায় আদালতে উকিলি জেরায় অসংখ্যবার বিস্মৃত হতে চেষ্টা করা সেই দুঃসহ স্মৃতিকে তরতাজা করা হয়। এই স্থায়ী ক্ষতের প্রলেপ কোথায়!

ধর্ষণের অসংখ্য 'কেইস হিস্ট্রি' মাথার ভেতরে তোলপাড় করছে। লেখার শক্তি নেই, ধৈর্য শেষ। রাগে ক্ষোভে চুপ করে বসে থাকছি বা ঘনঘন চা খাচ্ছি। আহা, প্রতিবাদের কি অসাধারণ ধরণ আমার! সারাদিন ধরে শুধু মনে হচ্ছে, আমরা যেমন কেউ ভীতু নই, তেমনি সত্যিই নিরাপদও নই কোনো বয়সেই, কোনো জায়গাতেই।