মাহবুবুল হক শাকিল ও তার রাতের এপিটাফের গল্প
কামরুল হাসান শায়ক
প্রকাশিত: ১১:৫৪ এএম, ২০ ডিসেম্বর ২০২১ সোমবার
“আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মতো দাঁড়াত বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ করে উঠতে পারত না।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাত যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিল, কিন্তু ছিল আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিল আমাদের শ্রেণির, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।”
‘সামদাদো’র মোহনীয় আলোয় মিড ভলিউমে ধ্বনিত হচ্ছে হুমায়ুন আজাদের কবিতা। আবৃত্তিশিল্পী শিমুল মুস্তাফার জলদগম্ভীর কণ্ঠে আচ্ছন্ন আমরা সবাই। শাকিল বুঁদ হয়ে শুনছে। তন্ময় হয়ে কণ্ঠ মেলাচ্ছে কবিতার সাথে।
“আমাদের মা ছিল অশ্রুবিন্দু দিনরাত টলমল করত,
আমাদের মা ছিল বনফুলের পাপড়ি, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়ত,
আমাদের মা ছিল ধানক্ষেত, সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকত।”
শাকিল কণ্ঠ মেলাচ্ছে, আর আমি অবাক হয়ে দেখছি ওকে। ওর কবিতা ও গল্পের পাঠ ওরই কণ্ঠে শুনেছি আগে। গান শোনার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। কিন্তু ভাব-যতি-স্বরপ্রয়োগের ব্যাকরণ মেনে আবৃত্তি এই প্রথম। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম ওর ঋজু, গম্ভীর, সাবলীল উচ্চারণ। কবিতাকে কতখানি আত্মস্থ করলে ওরকম ধ্যানীর মতো নিমগ্ন হওয়া যায়! ভাবছিলাম। আর মাথায় খেলা করছিল নতুন ভাবনা, ওর এই ভালোবাসাকে কীভাবে মূর্ত করে তোলা যায় সৃষ্টিশীল কোনো কাজের মধ্য দিয়ে
শাকিল কবিতা লেখে। আধুনিক কবিতার এক নিপুণ কারিগরের নাম মাহবুবুল হক শাকিল। অসাধারণ ওর কবিতার হাত। ইতোমধ্যেই দুটো বই বেরিয়েছে। ইতোমধ্যে অপ্রকাশিত বেশকিছু দরুণ কবিতা ওর হাতে। মনে মনে ভাবছি, ওর কবিতাগুলোকে যদি এভাবেই রেকর্ড করা যেত! পাশে বসা বন্ধু প্রকাশক মাজহারুল ইসলামের সাথে শেয়ার করলাম ব্যাপারটা। স্বাগত জানিয়ে বলল, শাকিলকে জিজ্ঞেস কর।
আবৃত্তি শেষ হতেই আমি ওকে বলি, দোস্ত, তোর কবিতা দিয়ে এরকম একটা আবৃত্তির সিডি বের করলে কেমন হয়? শাকিল বিস্ময়ের ঘোরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। তারপর বলল, কে করবে আমার কবিতার সিডি! তুই করবি? বললাম, করতে পারি। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের চেইন বুক শপ পিবিএসের ব্যানারে প্রকাশিত হবে শাকিলের একক কবিতার আবৃত্তি সংকলন।
কী নাম হবে সংকলনের? ওর কবিতার শিরোনামগুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলতে লাগল। বাছ-বাছাই করে শাকিলই নির্বাচন করল, ‘রাতের এপিটাফ’। গভীর এক ব্যঞ্জনা আছে নামটির মধ্যে, ওর কবিতার মতোই আধুনিক, শাশ্বত। আমাদের পছন্দ হলো।
আবৃত্তিকার হিসেবে শাকিলের পছন্দের শীর্ষে আসাদুজ্জামান নূর, আমাদের সবার প্রিয় নূর ভাই। এরপরেই আবৃত্তিশিল্পী-বন্ধু আহ্কাম উল্লাহ্। আর কাকে ভাবা যায়? আমার পছন্দ শিমুল মুস্তাফা, জানালাম ওকে। তাহলে এই তিনজন।
কাজের যে সময়সীমা নির্ধারিত হলো তখন আহ্কাম উল্লাহ দেশের বাইরে। সম্ভব হলো না ওনার পক্ষে। নূর ভাইও রেকর্ডিংয়ের সময় বের করতে পারবেন, সে ভরসা মেলে না। শাকিলের পরামর্শে আমরা দ্বারস্থ হলাম জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের।
অ্যালবামটি নিয়ে অনেক স্বপ্ন আমার। আন্তর্জাতিক মানের একটি সিডির প্রকাশনা করতে চাই, যা হবে প্রকৃত অর্থেই সংগ্রহে রাখার মতো। আমার কাছে দেশ-বিদেশের ভালো মানের সিডি-ডিভিডির কিছু নমুনা ছিল। সেগুলো থেকে ইম্প্রোভাইজ করে একটি প্রোডাক্ট ডিজাইন করলাম। কয়েকজন প্রচ্ছদশিল্পীকে যুক্ত করলাম মোড়ক ভাবনা উন্নয়নের কাজে। ঠিক হলো, একই মোড়কে দুটো সিডি থাকবে। দু-ঘণ্টা ব্যাপ্তিতে যতগুলো কবিতা রাখা যায় সেগুলো নির্বাচন করে নেব শাকিলের বইগুলো এবং নতুন লেখা কবিতাগুলো থেকে।
কবিতা নির্বাচনে শুধু নিজেদের ভাবনাকে গুরুত্ব না দিয়ে তরুণ প্রজন্মের নিয়মিত কবিতা-পাঠকদের নিয়ে একটি প্যানেল গঠন করলাম। তারা তাদের পছন্দের ক্রম উল্লেখ করে তালিকা দিল। দীর্ঘ সে তালিকা থেকে শাকিল নিজেই চূড়ান্ত বাছাইটি করে দিল। এক্ষেত্রে সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করলেন শাকিলের অত্যন্ত স্নেহভাজন মিলন পাঠান। আবৃত্তিশিল্পীরা সেখান থেকে নিজ নিজ পছন্দের কবিতা বেছে নিলেন।
ভয়েস রেকর্ডিং হলো তিনটে স্টুডিওতে। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ‘তারা স্টুডিও’তে কণ্ঠ দিলেন, শিমুল মুস্তাফা ‘ভয়েসে’। যখনই যা রেকর্ড করা হলো, শাকিলকে মেইল করে পাঠাতে থাকলাম। রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও শত ব্যস্ততার মাঝে শাকিল ওর ফিডব্যাক জানাতে দেরি করত না। কবিতাগুলো নিয়ে ওর চোখেমুখে কত স্বপ্ন ! ওর সে স্বপ্নকে অপূর্ণ রাখব না বলেই নূর ভাইয়ের পেছনেও নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকলাম আমি। অবশেষে একদিন নূর ভাই শিডিউল দিলেন। নিজেই ‘ধ্বনিচিত্র’ স্টুডিওতে ঢুকে রেকর্ড করে দিলেন তাঁর নির্ধারিত কবিতাগুলো।
আশৈশব আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথ কাঁপানো শাকিলের কঠোর ব্যক্তিত্বের আড়ালে বসবাস করত এক তীব্র সংবেদনশীল মন। তাই হয়তো ওকে ভীষণভাবে তাড়িত হতে দেখেছি কবিতাগুলোর মধ্যে ব্যক্ত অনুভূতিতে। কখনো সে উচ্ছ্বসিত হয়েছে, আবার কখনো বিষন্ন, বেদনার্ত। নূর ভাইর কণ্ঠে ‘দুঃখ কিশোরী বোন আমার’ শুনে কান্নাকে ধরে রাখতে পারেনি সে। কী অপার বেদনায় জারিত হয়ে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ রেহানাকে নিয়ে এ কবিতা রচনা করেছিল শাকিল, তা সহজেই অনুমেয়। আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠে ধারণকৃত সে কবিতা নিয়ে শাকিল এতটাই আবেগতাড়িত হয়েছিল যে অ্যালবামটি প্রকাশিত হবার আগেই আমার ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করার জন্য আবদার করে। আমি পোষ্ট করি আমার ওয়ালে। শাকিল সেটা শেয়ার করে। লাইক, কমেন্ট আর ভিউর ঝড় ওঠে।
২০১৬ সালের নভেম্বরের শেষ দিন অ্যালবামের কাজ শেষ হলো। ডিসেম্বরের ৪ তারিখে ঢাকা ক্লাবে বসা হলো মোড়ক উন্মোচনের পরিকল্পনা নিয়ে। নূর ভাই ছিলেন সে বৈঠকের মধ্যমণি। তাঁকে অ্যালবামের দুটো কপি উপহার দিল শাকিল। প্রতিজ্ঞা করল, মোড়ক উন্মোচনের আগে আর কাউকে কপি দেবে না সে।
পরিকল্পনা হলো, মোড়ক উন্মোচিত হবে ২০শে ডিসেম্বর, শাকিলের জন্মদিনে। আমি মনে মনে ভাবছি, এতদিনের স্বপ্ন, মেধা ও শ্রমের ফসলটিই হবে ওর এবারকার জন্মদিনের সেরা উপহার। আর এই উপহারটি ওর হাতে তুলে দিতে পেরে আমার চেয়ে আনন্দিত কেউ হবে না, আমি জানি। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের পিবিএস মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে আয়োজনটি। মোড়ক উন্মোচন করবেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আসাদুজ্জামান নূর; তিনি কথা দিলেন আমাদের। কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুলইসলাম থাকবেন বিশেষ অতিথি। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় থাকবেন প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। শাকিলের চোখেমুখে আলোর ঝিলিক। বলল, পিবিএসে মোড়ক উন্মোচন শেষে ৩০-৪০ জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ও আমন্ত্রণ জানাবে ঢাকা ক্লাবের সিনহা লাউঞ্জে। ওর প্রস্তাবকে সানন্দে গ্রহণ করে সে রাতে বিদায় নিলাম।
ডিসেম্বরের ৬ তারিখ। ক্যালেন্ডারের পাতায় এ দিনটি না এলেই সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু এলো। প্রকৃতির নিয়মেই এলো। এসে সবকিছু ওলোটপালোট করে দিয়ে গেল।
সেদিন আমাদের সকাল হলো সিংগাপুরে। আমাদের বলতে স্ত্রী মৌসুমী আক্তার আলো ও আমার। আগের দিন দুজনে ঢাকা থেকে এসেছি এখানে। ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে আমরা ঢুকলাম ‘তাকাশি মায়া’ মার্কেটে। এখানকার বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘কিনোকুনিয়া’ থেকে একটা মন্ট ব্লাঙ্ক (Mont Blanc) কলম আর রাইটিং প্যাড কিনলাম শাকিলের জন্য। ওর খুব পছন্দের ব্র্যান্ড মন্ট ব্লাঙ্ক। নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। ভাবতে ভাবতে মার্কেট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে চাপলাম। ট্যাক্সিতে বসেই ফোন পেলাম প্রথম আলোর স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট শরিফুজ্জামান পিন্টু ভাইয়ের। ফোনে জানাল, শাকিল আর নেই। একটু আগে সামদাদো রেস্তোরায় তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। অবিশ্বাস্য! যার জন্য একটু আগেই উপহার কিনে বেরুলাম সে চলে গেছে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে! মিনিট পাঁচেক পরেই প্রকাশক মাজহারের স্ত্রী, আমাদের স্বর্ণা ভাবি, ফোন দিয়ে পুনরাবৃত্তি করলেন একই দুঃসংবাদের। আমাদের কাছেদুঃসহ হয়ে উঠল বিদেশের মাটি।
ঢাকায় ফিরে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে আলোচনায় বসলাম। ক’দিন বাদেই শাকিলের জন্মদিন কত আনন্দ হবে, অ্যালবামের মোড়ক উন্মোচিত হবে, অথচ কী থেকে কী হয়ে গেল ! বন্ধুরা পরামর্শ দিল, নির্ধারিত অনুষ্ঠানটি নির্ধারিত দিনেই আয়োজন করতে হবে। কেকও কাটা হবে ওর জন্মদিনকে উপলক্ষ্য করে। মৃত্যুর ওপারে যদি কোনো জগৎ থেকে থাকে সেখান থেকে শাকিল দেখবে সবকিছু, যা সে দেখতে চেয়েছিল।
২০ তারিখের সন্ধ্যে বেলাটি লোকারণ্যে পরিণত হলো শান্তিনগরের পিবিএস মিলনায়তন। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কবি আসাদ চৌধুরীসহ দেশের প্রতিনিধিত্বশীল বিভিন্ন লেখক, শিল্পী, প্রকাশক, সাংবাদিক ও শাকিলের গুণগ্রাহীদের উপস্থিতিতে প্রাণের বন্যা নেমেছে যেন। তবু মাইক্রোফোনে কেউ কথা বলতে পারছেন না। ভাষা হারিয়েছে সবার। এ কেমন জন্মোৎসব! রবীন্দ্রনাথ একেই বুঝি বলেছিলেন ‘অনির্বাণ বেদনার দেয়ালি উৎসব’।
জন্মদিনের উৎসবের আগেই এপিটাফ লিখে গিয়েছিল শাকিল। ‘রাতের এপিটাফ’ নামটি এভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, কে জানত ! শাকিল নিজেও কি জেনেছিল?
যেখানেই থাকো খুব ভালো থেকো বন্ধু।
কামরুল হাসান শায়ক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিলের ঘনিষ্ট বন্ধু।