অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কসের বিবৃতি

কুয়েট শিক্ষকের অপমৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্তের দাবি

অপরাজেয় বাংলা ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৩:২২ পিএম, ৭ ডিসেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার  

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষক মো. সেলিম হোসেনের অপমৃত্যুর সুষ্ঠ তদন্তের দাবি জানিয়েছে বিশ্বাবিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কস। বিবৃতিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীনগরসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১ জন শিক্ষক স্বাক্ষর করেছেন। 

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এর শিক্ষকেরা গভীরভাবে শোকাহত। সেই সাথে এই মৃত্যু যেভাবে ঘটেছে তাতে আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। 

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলের খাদ্য ব্যবস্থাপক (ডাইনিং ম্যানেজার) নির্বাচন নিয়ে কয়েক দিন ধরে ছাত্রলীগ নেতারা প্রভোস্ট ড. সেলিম হোসেনকে চাপ সৃষ্টি করছিলেন। ডিসেম্বরের ১ তারিখ, মঙ্গলবার দুপুরে ছাত্রলীগ নেতারা ওই শিক্ষকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং হুমকি দেন। মঙ্গলবার বিকেলে অধ্যাপক সেলিম হোসেনের মৃত্যুর পর অভিযোগ আসে, ওই দিন সকালে কুয়েট ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের লাঞ্ছনা ও অপদস্থের শিকার হওয়ার পর তিনি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। 

সেলিম হোসেনের সম্বন্ধে জানা যায় যে শৈশব থেকেই তাকে জীবন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে হয়। কুয়েটেই পড়াশোনা শেষে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর প্রবাসে উচ্চ শিক্ষা শেষে আবার কুয়েটেই ফিরে আসেন। তিনি ছিলেন কুয়েটের একমাত্র ক্রিপ্টোগ্রাফিতে পিএইচডি করা অধ্যাপক। তার ওপর ভিত্তি করে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে একটি নতুন ল্যাব তৈরীর পরিকল্পনা ছিল।

প্রবাসের মাটিতে উন্নত জীবন আর পেশাগত সাফল্যের হাতছানি উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত হয়তো তার জন্য সহজ ছিলো না। কিন্তু তিনি সেটি করেছেন নিশ্চয়ই দেশের প্রতি ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থেকে। এইরকম একজন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসে বছরের পর বছর কত হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী নিজেদেরকে আরো শাণিত করতে পারতো, মূল্যবান দক্ষতা আর জ্ঞান অর্জন করতে পারতো। তাঁর এই অকাল প্রস্থান কুয়েট তথা পুরো দেশের জন্যই  একটা অপরিমেয় ক্ষতি হয়েই থাকবে। 

অন্যদিকে এই শিক্ষক আজ বেচে থাকলেও ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের এই ধরনের আচরণ অত্যন্ত গর্হিত একটি অন্যায় বলেই বিবেচিত হতো। একটা হলের ব্যবস্থাপনায় আছেন প্রভোস্ট। তিনি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বলে যাকে নিয়োগ যেখানে দেয়ার দরকার সেখানে দেবেন। এই খানে একটি ছাত্র সংগঠনের কি দায় থাকতে পারে? কি বলার অধিকার আছে? 

বিষয়টি অত্যন্ত অবাক হওয়ার মতো হলেও বছরের পর বছর প্রতিটি ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের দৌরাত্ম্য নতুন কিছু নয়। বেশীরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সমন্বয়ে গঠিত  হল প্রশাসন ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা পালন করেন। কোন ছাত্র হলে কোন রুমে থাকবে এইগুলো সবই ঠিক হয় ছাত্র সংগঠনের নেতা নেত্রীদের মর্জি মাফিক। এই প্রক্রিয়াতে চলে গণরুম আর গেস্টরুম নির্যাতন। হলের একটা সিটের বিনিময়ে কিনে নেয়া হয় শর্তহীন রাজনৈতিক আনুগত্য আর ক্যাডার নামক রাজনৈতিক গুন্ডা বানানোর লাইসেন্স। 

এই প্রক্রিয়াটি যুগের পর যুগ চলছে, কারণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো পেশী শক্তির মাধ্যমে দখলে রাখতে চেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং শাসক দলের কাছে এটি মূল্যবান পেশী শক্তির আধার হিসেবে, রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে রাখার মূল শক্তি হিসেবে। 

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমরা শিক্ষকরা বছরের পর বছর শাসক দলের এই নষ্ট পরিকল্পনার অংশ হয়েছি এর প্রতিবাদ না করে অথবা এই প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে। হল প্রশাসনে থাকা শিক্ষকরা এই ছাত্র সংগঠনগুলোর খবরদারী বিনা শর্তে মেনে নিয়েছেন ঝামেলা এড়ানোর জন্য। আর সাধারণ শিক্ষক শিক্ষিকারা সব জেনে বুঝেও নীরব রয়ে গেছেন সবসময়। 

প্রকান্তরে আমাদের শিক্ষকদের যুগ যুগ ধরে এই নীরবতা আর নির্লিপ্ততাই এই ধরনের ছাত্র সংগঠনগুলোর হাত শক্তিশালী করেছে। সেলিম হোসেনের এই অকাল মৃত্যুর পরোক্ষা কারণ হয়তো আসলে আমরা শিক্ষকরাই। 

আমাদের তাই স্বীকার করতে হবে যে অনেক হয়েছে। আর নয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনগুলোকে যে কোন মূল্যে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। হল প্রশাসনের দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। 

এই প্রক্রিয়াগুলো সময়সাপেক্ষ হলেও যথাসম্ভব দ্রুত করতে হবে এবং কুয়েটের ঘটনায় মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যুর পূর্বাপর ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত দোষীদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানাই।

কিন্তু কুয়েট কর্তৃপক্ষ এখনও পর্যন্ত কোন পথে হাঁটছেন তা আমরা নিশ্চিত নই। মৃত্যুর প্রতিবাদে যখন কুয়েট উত্তাল হয়ে ওঠে তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তড়িঘড়ি করে কুয়েট বন্ধ ঘোষণা করে এবং ছাত্র ছাত্রীদের হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। এটি করার একটা উদ্দেশ্য হয়তো ছাত্র আন্দোলন স্তিমিত করে ফেলা। 

আমরা চাই কুয়েট কর্তৃপক্ষ কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে এই অপমৃত্যুর একটি সুষ্ঠ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনবে। 

ড. সেলিমের মৃত্যুর সুস্ঠু ত বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষকরা অবস্থান নিয়ে তাদের দাবি জানাবেন আগামীকাল ৮ ডিসেম্বর সকাল ১২টায়।