অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

জলবায়ু সম্মেলন কতটা সফল?

হীরেন পণ্ডিত

প্রকাশিত: ০৪:০০ পিএম, ২ ডিসেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ০৪:০৩ পিএম, ২ ডিসেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার

জলবায়ু সম্মেলন এবারও প্রাপ্তি শূন্য। অর্থায়নের নিশ্চয়তা পায়নি দরিদ্র দেশগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ঝুঁকি প্রশমন ও অভিযোজনের জরুরি অর্থায়নের নিশ্চয়তা এবারও পেল না। সম্মেলন অতিরিক্ত সময়ে গড়ালেও অর্থায়নের বিষয়ে কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তাদের জন্য এবারের সম্মেলনও কার্যত প্রাপ্তি শূন্য একটি আয়োজন। তবে 'মন্দের ভালো' কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি। কার্বন নিঃসরণ কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাসে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব দেশ একটি ঘোষণায় সম্মত হয়েছে। টানা ১৪ দিনের দরকষাকষি শেষে 'গ্লাসগো ক্লাইমেট প্যাক্ট' নামে এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে কপ২৬ জলবায়ু সম্মেলনে।

গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন বা কপ২৬ প্রথমবারের মতো এ সম্মেলনে কিছু বিষয় আলোচিত হয়। সম্মেলনে নিম্ন আয়ের দেশ বিশেষ করে যারা জলবায়ু সংকটে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের জন্য অধিক অর্থ দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। জলবায়ু কর্মীদের ক্রোধান্বিত ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে সমাবেশস্থলে। বিশ্ববাসীও তা শুনেছে।

এ সম্মেলন জলবায়ু সংকট উত্তরণে কতটা সফল? গ্লাসগো সম্মেলনে অগ্রগতি হয়েছে বটে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে কয়েকটি রাষ্ট্র যাদের আরও কিছু করার ছিল, তারা সে প্রত্যাশা পূরণ করেনি। এক কথায় সম্মেলন সম্পর্কে বলা যায়, সম্মেলনের ফল শুরুর আগে থেকেই নির্ধারিত। এত কনসার্ট, মানববন্ধন, লংমার্চ, সেমিনার, দরকষাকষির আলোচনা, বক্ততা, আলটিমেটাম, ঘোষণা ইত্যাদির কি কোনো প্রভাব নেই? আছে নিশ্চয়ই। 

জাতিসংঘের উদ্যোগে ও যুক্তরাজ্যের আয়োজনে ৩১ অক্টোবর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শুরু হওয়া এবারের জলবায়ু সম্মেলন শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অতিরিক্ত দিনে গড়ায়। এবারের সম্মেলনে অংশ নেন দুই শতাধিক দেশ ও অঞ্চল এবং তাদের পক্ষে কাজ করা মধ্যস্থতাকারী, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রায় ৫০ হাজার প্রতিনিধি। শুরু থেকে আশা করা হচ্ছিল, ধনী দেশগুলোর আরাম-আয়েশের আয়োজনের কারণে কার্বন নিঃসরণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো ঝড়, বন্যা, ক্ষরার প্রভাব কাটিয়ে ওঠা এবং উপকূলীয় জীবনে অভিযোজন ঘটানোর জন্য তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত অর্থ পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবে।

বাংলাদেশ, মালদ্বীপসহ বিশ্বের উপকূলীয় ও দ্বীপদেশগুলো প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ধনী দেশগুলোর তহবিল বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি রক্ষার জোর তাগিদ দেয় এই সম্মেলনে। তবে তাদের আহ্বানের কোনো প্রতিফলন নেই গ্লাসগো ক্লাইমেট প্যাক্টে। দরকষাকষি শেষে ঘোষণা করা গ্লাসগো ক্লাইমেট প্যাক্টে প্রতিশ্রæত জলবায়ু তহবিলের অর্থ পাওয়ার বিষয়টি কপ২৭ সম্মেলনে অধিকতর আলোচনার জন্য রেখে দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী ধনী দেশগুলো বছরে যে ১০০ বিলিয়ন অর্থায়ন করতে চেয়েছিল, তা ২০২৩ সালের আগে পাওয়া যাবে না বলে সম্মেলন থেকে পরিস্কার বার্তা পাওয়া যায়। এ অর্থ পেতে ২০২৫ সাল পর্যন্তও লেগে যেতে পারে। একই সঙ্গে তা কীভাবে, কী উপায়ে পাওয়া যাবে- সেটি নিয়েও এবারের সম্মেলনে বিতর্কের অবসান হয়নি।

বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর নেতা ও আদিবাসী প্রতিনিধিরা শ্লোগান দিয়ে সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন। সেইসঙ্গে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এরই মধ্যে কপ২৬ কে ব্যর্থ আখ্যা দিয়ে বিশ্বনেতাদের কঠোর সমালোচনা করেছে। গতকাল বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন শেষমুহূর্তেও বিশ্বকে বাঁচানোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করেছে।

বিশেষ করে বিভিন্ন দেশ থেকে প্লাসগোতে জড়ো হওয়া তরুণ পরিবেশকর্মীরা এবারই 'বিশ্বকে বাঁচানোর শেষ সুযোগ'টি কাজে লাগানোর দাবি নিয়ে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন। তবে পরিবেশকর্মীদের সতর্ক থাকার ও গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে এই সম্মেলনকে 'ভালো' অগ্রগতিমূলক, আশাবাদী, সঠিক পথে চালিত হওয়ার মতো বিশেষণে আবদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে।

উন্নত দেশের মধ্যস্থতাকারীরা জলবায়ু তহবিলের অর্থ সরাসরি সরকারগুলোর হাতে দিতে চায় না। তারা উন্নয়ন ঋণ হিসেবে বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই সহায়তা দিতে চায়। তবে দরিদ দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বিষয়টি নতুন ঋণের বোঝা চাপানোর কৌশল হিসেবে অভিহিত করে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের দাবি, বিনাশর্তে ধনীদের কাছ থেকে তাদের এই অর্থ প্রাপ্য। এক দশক আগেই ধনী দেশগুলো এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু সম্মেলনে দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণের আহ্বান জানিয়েছেন।

যৌথ ঘোষণায় যেসব বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি হলো- ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন কমাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানিয়ে প্রতিবছর সব দেশকে বিস্তারিত পরিকল্পনা জাতিসংঘকে জানাতে হবে। আগে যেখানে পাঁচ বছর অন্তর এই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হতো, সেখানে এটি এক বছর অন্তর করতে আহ্বান জানানো হয়েছে। এই পরিকল্পনা বান্তবায়নে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। সম্মেলনের আয়োজক দেশ যুক্তরাজ্য মনে করছে, সরকারগুলো তাদের কার্বন হ্রাসের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রির মধ্যে রাখার যে লক্ষ্য, তা বেঁচে থাকবে। তবে বেশিরভাগ দেশই একে শুধু 'আশা বাঁচিয়ে' রাখার ঘটনা বলে বর্ণনা করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশের মধ্যে একটি মালদ্বীপ। দেশটির প্রতিনিধি শেষ মহূর্তের আলোচনায় বলেন, তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি ও দুই ডিগ্রি বৃদ্ধির ব্যবধানটা আমাদের জন্য মৃত্যুর ফরমানের মতো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আমাদের সমতল দুই মিটারেরও কম উঁচু। এখানে যেসব সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তা মালদ্বীপের জন্য খুবই অপ্রতুল। অভিযোজনের জন্য আমরা অতটা সময় পাব না। লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ গ্লাসগো সম্মেলনে গতকাল জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে কয়লানির্ভর ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল ও ইরান। জ্বীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প শক্তিতে ভর্তুকি দেওয়া নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ঘোষণা থেকে ছেঁটে ফেলার দাবি জানান তারা।

গ্লাসগো ক্লাইমেট প্যাক্টের দুর্বলতা হলো- এসব শর্ত ভাঙলে কোনো দেশকে শাস্তি পেতে হবে না। এই চুক্তি পালন নির্ভর করবে সরকারগুলোর ইচ্ছার ওপর। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিশ্রæতি করায় সরকারগুলো এক ধরনের রাজনৈতিক চাপের মধ্যে থাকবে। সেই সঙ্গে জলবায়ু তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রতিশ্রুতিগুলো মেনে চলতে হবে। যে কারণে কিছু সাফল্য আসবে।

বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ও মধ্যস্থতাকারী এবং জাতিসংঘ ও সম্মেলনের সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করেছেন তারা। তাদের সঙ্গে আলোচনার পর সম্মেলনের সভাপতি অলোক শর্মা বলেছেন, পৃথিবী বাঁচাতে আমরা এখন সত্যের মুখোমুখি। বিশ্ববাসী চায়, আমরা সাহসী পদক্ষেপ নিই।

আরও যে বিষয়গুলোকে সম্মেলনে সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রির নিচে রাখতে আগামী দশকজুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যৌথ ঘোষণা, ২০৩০ সালের মধ্যে বন ধ্বংস বন্ধ করা নিয়ে ১০০টি দেশের নেতার ঘোষণা, ২০৩০ সালের মধ্যে মিথেন নিঃসরণ ৩০ শতাংশ কমাতে ১০০টি দেশের ঘোষণা এবং কয়লা ব্যবহার বন্ধে ৪০টি দেশের ঘোষণা। 

২০০৯ সালের জলবায়ু সম্মেলন বা কোপেনহেগেন সম্মেলন সেভাবে প্রভাব রাখতে পারেনি। কারণ, ওই সম্মেলন শুরুর আগে তেমন আন্দোলন হয়নি। প্যারিস সম্মেলনের আগে অনেক দেশেরই কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। তবে তারা একটি চুক্তি করতে সক্ষম হয় এবং তখন একটি কর্মপরিকল্পনাও তৈরি হয়। যদিও সত্যিকার দৃঢ়তা ছাড়া ওইসব লক্ষ্য বাস্তবায়ন সহজ নয়। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়- শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী যে তাপমাত্রা পৃথিবীর ছিল তার চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যাতে না বাড়তে পারে। প্যারিস চুক্তিতে অঙ্গীকার করা হয় ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। এবারের গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, ফ্রান্সের প্যারিসে তারা যে চুক্তি করেছে সে ব্যাপারে সবাই তৎপর হবে। এবারের সম্মেলনে যদিও তার কার্বন নিঃসরণের বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যে পৌঁছতে কারও কারও কর্মকাÐ যথার্থ ছিল না। 

সম্প্রতি চীন যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জলবায়ুর ব্যাপারে চুক্তির বিষয়ে জানিয়েছে। সেখানেও অস্পষ্টতা লক্ষণীয়। আমরা জানি, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দুই বৃহত্তম কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনকারী। তারা মিথেন নির্গমন হ্রাস, বন রক্ষা এবং কয়লার ব্যবহার বন্ধে চুক্তি করেছে। অথচ জলবায়ু কর্মী ও বিজ্ঞানীদের দাবি সত্ত্বেও তারা জলবায়ুর লক্ষ্য নির্ধারণে বার্ষিক হার ঘোষণা করেনি। কিন্তু তাদের বলবে কে? আগামী বছর মিসরে জলবায়ু সম্মেলন তথা কপ২৭ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ফলে আগামী বছর সেখানে কী হয় বলা মুশকিল।

হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি।