হাতিগুলো বাঁচবে কি করে?
বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৯:৪২ এএম, ২৯ নভেম্বর ২০২১ সোমবার
বাংলাদেশে ২০২১ এর নভেম্বরে করা হয়েছে ৭টি হাতি
হাতি বন্যপ্রাণী। কিন্তু লোকালয়েও এর বিচরণ রয়েছে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এখানে মানব আর হস্তিতে যে সংঘাত তা এখন হাতিকেই বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে এই ২৩ মাসে দেশে অন্তত তিন ডজন হাতিকে হত্যা করা হয়েছে। কেবল নভেম্বর মাসেই হত্যা করা হয়েছে সাতটি হাতি।
এই হত্যাকাণ্ডগুলোর পর দেশের বন-বাঁদার, পাহাড়, জঙ্গল ঘেঁটে গুনে দেখলে মোট হাতির সংখ্যা ৩০০টিতেও দাঁড়াবে না। এতে করে বাংলাদেশে হাতির অস্তিত্ব এখন পুরোপুরি বিলুপ্তির পথে।
আইইউসিএন রেড এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হুমকির মুখে থাকা প্রজাতিগুলোর মধ্যে হাতি অন্যতম। যার মধ্যে বাংলাদেশে এই জন্তুটির টিকে থাকা এখন চরম সঙ্কটে।
মোটেই এক শতাব্দী আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গলে প্রচুর হাতির বাস ছিলো। আর জংলি প্রাণিটিকে বশ করে মানুষ তার নিজের কাজেই ব্যবহার করতো। রাজা-রাজারার সৈন্যদলে যুক্ত হয়েছিলো হস্তিবাহিনী, মানুষের জন্য ভারী কাঠ বহনকারী হয়ে উঠেছিলো, সার্কাসে খেলা দেখাতো- এমন কত কীই না করতো হাতি। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই হাতিকেই মানুষ হত্যা করে করে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে নিজস্ব আবাস নিয়ে রয়েছে অনেক হাতি, কোনো কোনোটি সীমান্ত পাড়ি দিয়েও এসেছে। দেশের শেরপুর, নেত্রকোণা, কুড়িগ্রাম, সিলেট ও মৌলভীবাজার অঞ্চলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত বনাঞ্চলে ঢাকা। সুতরাং এক দেশের হাতি আরেক দেশে অনায়াসে গতায়ত করে। একই রকম জঙ্গলে ঢাকা সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমারের সাথেও কক্সবাজার ও বান্দরবান অংশে। সেখানেও অভিবাসি হয়ে আসে হাতি।
কিন্তু ধীরে ধীরে বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে হাতির জন্য জঙ্গল আর নিরাপদ আবাস হয়ে থাকতে পারেনি। জঙ্গলে পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে হাতি কখনো কখনো লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এছাড়া কক্সবাজারে রোহিঙ্গারা এসে আশ্রয় নিলে তাদের জন্য যে ক্যাম্প করা হয়েছে যেখানে জংলি হাতির যাতায়তের অন্তত দুটি পথ এখন মানুষের পূর্ণাঙ্গ দখলে। আর তাতে মিয়ানমার সীমান্ত পথে যেসব হাতি যাতায়াত করতো সেগুলো পড়েছে চরম বিপদে।
হাতির প্রয়োজন খাবার। সেই খাবারে সন্ধানেই হাতি লোকালয়ে আসে। যখন পাল বেঁধে আসে তখন লোকালয়ের বসতবাড়ি, ফসলের ক্ষেত ধ্বংস করে। আর সেখান থেকেই শুরু হয় সংঘাত। মানুষ ফাঁদে ফেলে হাতিকে আটকে ফেলে এবং হত্যা করে। ওদিকে হাতির পায়ের তলা দলিত হয়ে মারা পড়ে মানুষ। প্রতিবছর এমন করে এক ডজনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।
মানুষ কখনো কখনো হাতিগুলো খেদিয়ে জঙ্গলে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু জংলি হাতি যখন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে তখন তাকে কোনোভাবেই আটকানো যায় না। ফলে বিদ্যুতের লাইনের ফাঁদ পাতা হয়, নয়তো গুলি করে মেরে ফেলা হয় হাতিগুলো।
গত ৬ নভেম্বর কক্সবাজারের মিঠাছড়িতে এমন ১৮টি হাতির একটি পাল নেমে আসে লোকালয়ে। হাতিগুলোকে বনে ফেরাতে গিয়ে একজন বন কর্মকর্তাসহ ৫ জন আহত হন। শেরপুরে বন্য হাতির আক্রমন একটি সাধারণ ঘটনা। বিশেষ করে মাঠ-ঘাটের পানি শুকিয়ে এলে এই অঞ্চলে হাতির পাল লোকালয়ে ঢুকে পড়তে প্রায় প্রতি বছরই দেখা যায়। এটা ধানের মওসুম। একবার ঢুকে পড়লে ধানক্ষেত বসত লণ্ডভণ্ড করে দেয় হাতির পাল। ফলে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য হাতির ভীতি চরমে। তাদের নির্ঘুম রাত কাটে পাহারা বসিয়ে। নিজেদের ফসল আর জীবন রক্ষার চেষ্টায়। এসব ক্ষেত্র তারা ড্রাম বাজিয়ে, আঁতশবাজি পুড়ে, মশাল জ্বালিয়ে হাতিদের খেদিয়ে দিতে চেষ্টা করে। তবে ক্ষুধার্ত হাতিগুলো এতে ভয় পায় না। গভীর রাতে পাল বেঁধে নেমে আসে। আর ধ্বংস করে লোকালয়। আর মানুষ বেছে নেয় হত্যার পখ।
নভেম্বরের গোড়ার দিকে দেশে মোট ছয়টি হাতি নিহত হয়েছে। যার মধ্যে ৫টিকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মারা হয়েছে। একটিকে হত্যা করা হয়েছে গুলি করে। পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদ ও কর্মীরা এইসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। দেশের বিভিন্ন অংশে তারা এর প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন, মিছিল করেছেন। পরিবেশবিদদের মত, পরিস্থিতি যেটাই হোক এক সপ্তাহে ছয়টি হাতিকে মেরে ফেলা নৃশংসতার সামিল।
বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আদালতে গড়ায়। আর গত ২১ নভেম্বর হাইকোর্ট হাতিহত্যা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মীদের রিট পিটিশনে সাড়া দিয়ে এই আদেশটি দেন আদালত। বাংলাদেশের আইনও হাতিগুলোকে রক্ষার পক্ষে। প্রচলিত আইনে হাতি হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া কোনো ব্যক্তির যদি হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়, তার পরিবারকে ৩ লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার বিধান রয়েছে।
এসব আইন ও বিধান দিয়েও যখন হাতিগুলোকে রক্ষা করা যাচ্ছে না, তখন পরিবেশবিদরা মানব সচেতনতার ওপর জোর দিচ্ছেন। কারণ মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাতে হাতিই বেশি প্রাণ হারায়। আর তাতে একটি প্রজাতি এখন পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে। পরিবেশ প্রতিবেশের জন্য যা অপুরণীয় ক্ষতির।