অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

১৯৮৪॥ মূল: জর্জ অরওয়েল॥ অনুবাদ: মাহমুদ মেনন ২য় খণ্ড, পর্ব- ২

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

প্রকাশিত: ১২:৩২ পিএম, ২৬ নভেম্বর ২০২১ শুক্রবার   আপডেট: ১২:৩৫ পিএম, ২৬ নভেম্বর ২০২১ শুক্রবার

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

দ্বিতীয় খণ্ড ॥ পর্ব- দুই

পরের সপ্তাহটি জীবনের জন্য হয়ে থাকলো কেবলই সপ্নময়। ঘটনার ঠিক পরের দিন যতটা সময় তার ক্যান্টিনে কেটেছে সে সময়ের মধ্যে কালোকেশীর টিকিটিরও দেখা পায়নি। হুইসেল বেজে উঠলে ক্যান্টিন ছাড়লো সে। মনে মনে ভাবলো, হতে পারে মেয়েটি কাজের শিফট পাল্টে ফেলেছে।

সেদিন অবশ্য একবার তারা একে অন্যের সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে, কিন্তু কেউ কাউকে দেখতে পায়নি। ঘটনার তৃতীয় দিনে এসে নিয়ম মাফিক লাঞ্চে ক্যান্টিনে দেখা গেলো তাকে। তবে সঙ্গে আরও তিনটি মেয়ে ছিলো। আর বসেছিলো ঠিক টেলিস্ক্রিনের নিচে। 

পরের তিনটি দিন গেছে আরও অসহনীয়তায়। এই তিন দিনে একটি বারের জন্যও মেয়েটিকে সে দেখতে পায়নি। 


প্রথম খণ্ড ॥ [পর্ব-এক] [পর্ব-দুই] [পর্ব-তিন] [পর্ব- চার] [পর্ব- পাঁচ] [পর্ব-ছয়] [পর্ব- সাত] [পর্ব-আট] [পর্ব-নয়] [পর্ব-দশ] [পর্ব-এগারো] [পর্ব-বারো] [পর্ব-তেরো] [পর্ব- চৌদ্দ] [পর্ব-পনেরো]


দ্বিতীয় খণ্ড ॥ [পর্ব- এক]


গোটা দেহ আর মন যেনো এক ধরনের অহসহনীয় সংবেদনশীলতায় আক্রান্ত হয়ে থাকলো। সব কিছুই যেনো ফাঁকা ফাঁকা। প্রতিটি চলন, প্রতিটি বলন, প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি শব্দ যা তার কানে পসছে, সবই যেনো ব্যথা ধরিয়ে দিচ্ছে। ঘুমের মাঝেও মেয়েটির অবয়ব তার চোখ আর মন ছাড়া হয়নি। এই ক'দিনে ডায়রিটা ছুঁয়েও দেখেনি। স্বস্তি যদি কিছুটা পেয়ে থাকে তা ছিলো ঠিক কাজের টেবিলে। এখানেই সে কিছুটা সময় ধরে হলেও মেয়েটিকে ভুলে থাকতে পেরেছে, কাজের চাপে চাপে অন্তত দশ মিনিট মেয়েটির অবয়বমুক্ত থেকেছে তার মন। মেয়েটির যে কি হলো তা নিয়ে ভেবে কোনই কূল-কিনারা করতে পারলো না। খোঁজে নামা নিতান্তই অসম্ভব। হতে পারে, ওকে বাষ্প করে দেওয়া হয়েছে, হতে পারে ও আত্মহত্যা করেছে, হতে পারে ওকে ওশেনিয়ার সীমান্তে বদলি করা হয়েছে, আর সবচেয়ে বাজে ও সবচেয়ে সম্ভাব্য দিকটি হচ্ছে, সে মত পাল্টে ফেলেছে, আর তাকে এড়িয়ে চলছে।
 
পরের দিন অবশ্য তার চাঁদবদনের দেখা মিললো। বাহুখানি ততক্ষণে স্লিংমুক্ত। তবে এবার কব্জিতে প্ল্যাস্টার প্যাঁচানো। সে যাই হোক, দেখতে যে পেলো সেটাই বড় স্বস্তির। আর সেই দর্শণে সে এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়লো যে কয়েক সেকেন্ড তার দিকে দৃষ্টি ফেলে রেখে সেই অভিব্যক্তির প্রকাশ না ঘটিয়ে পারলো না। এর পরের দিন মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ প্রায় এসেই গিয়েছিলো।ক্যান্টিনে পৌঁছে দেখে মেয়েটি টেলিস্ক্রিন থেকে যথেষ্ট দূরেরই একটি টেবিলে বসা, আর পুরোই একা। দুপুরের খাবারে ভীর তখনও পুরোদমে শুরু হয়নি। ক্যান্টিনও ভরে ওঠেনি। কিউতে দাঁড়িয়ে এগুতে এগুতে উইনস্টন যখন প্রায় কাউন্টারের কাছাকাছি, ঠিক তখনই ঝামেলাটা বাঁধলো। তার সামনের জনের অভিযোগ তিনি তার ট্রেতে স্যাকরিনের বড়ি পাননি। সে নিয়ে চিৎকার জুড়ে দিলেন। তাতে কেটে গেলো কিছুটা সময়। মেয়েটি অবশ্য তখনও একাই বসে। যাই হোক ওদের বসচা মিটে গেলে উইনস্টন নিজের ট্রেতে খাবার নিয়ে কিছুটা খাপছাড়া ভঙ্গিতে মেয়েটির টেবিলের দিকেই এগুচ্ছিলো। চোখ ঠিক ওই টেবিলে নয়, দৃষ্টির গতিপথ বলছে- যেনো পেছনের টেবিলে স্থান খুুঁজছে সে। কালোকেশীর টেবিল তখন মোটে তিন মিটার দূরে। দুই সেকেন্ডেই সামনে পৌঁছে যাবে। আর ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে উঠলো, ‘স্মিথ!’। প্রথমে সে এমন একটা ভাব করলো যেনো শুনতে পায়নি। ‘স্মিথ!’ আরেকটু জোরে আরেকবার ডেকে উঠলো কণ্ঠটি। এবার নিরুপায়। সে ঘুরলো। এক ঝাঁকড়া-চুলের ফালতু চেহারায় এক যুবক। নাম উইলশার, ভালো করে চেনেও না উইনস্টন, মুখে হাসি ছড়িয়ে সে-ই তাকে আহ্বান জানালো তার টেবিলের ফাঁকা চেয়ারটিতে বসার জন্য। ওকে প্রত্যাখ্যান করা নিরাপদ হবে না। একজন ডাকার পরেও তাকে উপেক্ষা করে আরেকটি মেয়ের টেবিলে বসে পড়া রীতিমতো অসমিচীন, যেখানে মেয়েটি তাকে ডাকেও নি। এমন কিছু করে ফেললে সবারই চোখে পড়ে যাবে। অগত্যা বন্ধুসুলভ হাসি ছড়িয়ে সে বসে পড়লো যুবকটির টেবিলে। ফালতু চেহারার ঝাঁকড়াচুলো তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। উইনস্টনের মনে হচ্ছিলো একটা কুড়োল দিয়ে টেবিলটির মাঝ বরাবর কোপ মেরে দুখান করে দেয়। ভাবতে ভাবতে কয়েক মিনিটেই মেয়েটির টেবিলটাও ভরে গেলো অন্যরা বসে পড়ায়।

সে নিশ্চিত, মেয়েটি বুঝতে পেরেছে যে উইনস্টন তার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলো। আর হতে পারে এর থেকে সে কিছু একটা বুঝেও নিয়েছে। পরের দিন যাতে একটু আগে আগে যেতে পারে সে বিষয়টি মাথায় ছিলো। আর আগের দিনের ভাবনা সঠিক করে দিয়ে এদিনও মেয়েটি সেই একই টেবিলে আর স্রেফ একা বসে। কিউতে তার ঠিক সামনের লোকটি বেটেখাটো আর শুধুই নড়াচড়া করছে। সেই মধুমক্ষী চেহারার লোকটি। চ্যাপ্টা মুখমণ্ডলে ছোট-কুতকুতে দুটি চোখ। উইনস্টন যখন তার ট্রেটি হাতে নিয়ে কাউন্টার থেকে ঘুরলো, সে দেখলো বাটুল ব্যাটা সোজা মেয়েটির টেবিলের দিকেই যাচ্ছে। আশার তরী তবে ডুবলো এবারও। একটু দূরে আরেকটি টেবিলে চেয়ার ফাঁকা, কিন্তু বাটুলের চেহারা দেখে পড়ে নিলো- এই ব্যাটা অপেক্ষাকৃত বেশি ফাঁকা টেবিলটিতেই আরাম করে বসবে। বরফহীম হৃদয় নিয়ে উইনস্টন এগুচ্ছে। ওকে একা টেবিলে না পেলে কোনই ফায়দা নেই। ঠিক সেই মূহূর্তে সশব্দে  চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেলো বাটুল লোকটা। চার হাত পা চারদিকে ছড়িয়ে, আর তার ট্রে-খানা উল্টে স্যুপের ও কফির ধারা মেঝেতে গড়ালো। ঘৃণাভরা দৃষ্টি হেনে উইনস্টনের দিকে তাকাতে তাকাতে পরক্ষণেই উঠে দাঁড়ালো। তার সন্দেহমাখা দৃষ্টি বলছে যেনো উইনস্টন তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসে না। হৃদযন্ত্রের ধক ধক ধক ধক শব্দ নিয়ে উইনস্টন বসে পড়লো মেয়েটির টেবিলে।

মেয়েটির দিকে না তাকিয়েই ট্রের খাবারগুলো খোলায় মন দিলো সে। আর দ্রুতই খাওয়াও শুরু করলো। কেউ এসে পড়ার আগে এখুনি কথা সেরে ফেলা খুবই জরুরি, কিন্তু এক ভয়াবহ ভীতি  যেনো তাকেজাপ্টে ধরলো। মেয়েটি কথাগুলো বলার পর এক সপ্তাহ পার হয়েছে। এর মধ্যে সে অবশ্যই তার মনও পাল্টে ফেলেছে! এই সম্পর্ক সফলতায় শেষ হবে এমনটা অসম্ভব; এমন ঘটনা বাস্তব জীবনে ঘটেই না। কানভরা পশমওয়ালা সেই কবি অ্যাম্পলফোর্থকে ট্রে হাতে বসার জায়গা খুঁজতে না দেখলে, এখনই কিছু বলবে না এমন একটি সিদ্ধান্ত সে প্রায় নিয়েই ফেলেছিলো। নিজের মতো করেই উইনস্টনের সঙ্গে খাতির রেখে চলে এই অ্যাম্পলফোর্থ, আর নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তাকে দেখে ফেললে ছুটে এসে এই টেবিলেই বসবে। হাতে মোটে এক মিনিট সময়ও নেই। উইনস্টন ও মেয়েটি দুজনই ধীরে ধীরে খাবার মুখে তুলছে। যা খাচ্ছে তা ওই পাতলা স্ট্যু, মূলত শিম-বরবটির স্যুপ। অনেকটা বিরবির করার মতো করে উইনস্টন কথা পারলো। কেউই চোখ তুলে তাকালো না। ধীরে ধীরে চামচে তুলে তরল পদার্থ মুখে দিচ্ছে। আর এর মাঝেই কিছু প্রয়োজনীয় শব্দ বিনিময় হচ্ছে। খুব আস্তে অভিব্যক্তিমুক্ত সে কণ্ঠধ্বনি-
- ‘কাজ শেষ হয় কখন?’
- ‘সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায়।’
-‘কোথায় দেখা হতে পারে?’
- ‘ভিক্টরি স্কয়ার, স্মৃতিস্তম্বের কাছে।’
- ‘ওখানটা তো টেলিস্ক্রিনে ভরা।’
- ‘ভিড় থাকলে ওটা কোনও বিষয় না।’
- ‘কোনও সংকেত?’
- ‘না। আমার আশেপাশে অনেক মানুষের ভীড় না থাকলে কাছে ঘেঁষা যাবে না। আর আমার দিকে তাকানোও যাবে না। তবে আমার আশেপাশেই কোথাও থাকবে।’
- ‘কখন?’
- ‘সন্ধ্যা ৭টা’
- ‘ঠিক আছে’।

উইনস্টনকে দেখতেই পায়নি অ্যাম্পলফোর্থ। এগিয়ে গিয়ে অন্য একটি টেবিলে বসে পড়েছে সে। ওদের দুজনের মধ্যে আর কোনও কথা হলো না। আর যতক্ষণ টেবিলের দুদিকে দুজন বসে ছিলো কেউ কারো দিকে তাকালোও না। মেয়েটি একটু দ্রুত খাবার শেষ করে বেরিয়ে গেলো। উইনস্টন সিগারেট ফুঁকবে বলে আরেকটু বসলো।

নির্ধারিত সময়ের আগেই ভিক্টরি স্কয়ারে পৌঁছে গেলো উইনস্টন। খাঁজকাটা অতিকায় স্তম্ভটির চারিদিকটা একবার ঘুরে দেখলো। এই স্তম্ভের চূড়ায় দখিণমুখো করে বসানো বিগ ব্রাদারের অতিকায় মূর্তি। আকাশের পানে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন, ঠিক যেদিকটাতে এয়ারস্ট্রিপ ওয়ান যুদ্ধে তার হাতে পরাভূত হয়েছিলো ইউরেশীয় বিমানগুলো (বছর কয়েক আগে তা অবশ্য ছিলো পূর্ব এশীয় বিমান) সেদিকটাতে মুখ করে। সড়কের সম্মুখভাগে একটি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার এক মানবমূর্তি। বলা হয় ওটি ওলিভার কর্মওয়েলের প্রতিরূপ। নির্ধারিত সময়ের পরেও পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেছে। ভয়াবহ সেই ভীতি আবার তাকে পেয়ে বসলো। সে আর আসছে না! মন পাল্টে ফেলেছে! ধীরে হাঁটতে হাঁটতে স্কয়ারের উত্তর দিকটাতে এগিয়ে গেলো সে। ঠিক তখনই সেন্ট মার্টিন’স চার্চটি চোখে পড়ায় একটা ফ্যাকাশে রঙের আনন্দানুভূতি বয়ে গেলো। এই সেই গির্জা, যার ঘণ্টা, যখন ঘণ্টা বলতে কিছু ছিলো, ধ্বনি তুলতো ‘ইউ ও মি থ্রি ফারদিংস।’ এরপর সে মেয়েটিকে দেখতে পেলো স্মৃতিস্তম্ভের বেদীতে দাঁড়িয়ে, স্তম্ভের সাথে ঘূর্ণায়মান একটি পোস্টার হয় পড়ছে, নয়তো পড়ার ভান করছে। কাছে ধারে আরও কিছু মানুষ জড়ো না হলে এখনই মেয়েটির কাছাকাছি যাওয়া অনিরাপদ। চারিদিকে ঝুল ছাদে বসানো রয়েছে বেশ কয়েকটি টেলিস্ক্রিন। ঠিক সেই মুহূর্তে ব্যাপক চিৎকার-চ্যাচামেচি শুরু হলো আর বাম দিক থেকে ভারি ভারি যানবাহন ছুটে আসতে লাগলো একের পর এক। 

হঠাৎ সবাই স্কয়ারের চারিদিকে ছোটাছুটি শুরু করলো। মেয়েটি ক্ষীপ্রতার সাথে বেদীর সিংহমূর্তিগুলোর মাঝ থেকে ঘুরে ছুটন্ত মানুষগুলোর সঙ্গে যোগ দিলো। উইনস্টন তাকে অনুসরণ করলো। আর যখন দৌড়াচ্ছিলো তখনই অন্যদের কথা থেকে জানতে পারলো ইউরেশীয় কারাবন্দিদের একটি বহর যাবে এখান দিয়ে। ততক্ষণে স্কয়ারের দক্ষিণ দিকটা লোকে লোকারণ্য। এমন পরিস্থিতে উইনস্টন সাধারণত ভীড়ের বাইরের দিকটাতে থাকে, কিন্তু এখন সে ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি করে, শরীরখানা আকিয়ে-বাঁকিয়ে তবেই ভীড়ের ঠিক মাঝের দিকে ছুটছে। যখন মেয়েটির বাহুর নাগালে পৌঁছালো তখনই বাধা হয়ে দাঁড়ালো অতিকায় বপুর এক পুরুষ প্রোল, আর একই মাপের আরেক নারী প্রোল। মনে হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীই হবে। থলথলে মাংসের একটি দেয়াল হয়ে সামনে সামনে হাঁটছে এই প্রোল যুগল। একবার তার ইচ্ছা হলো দু'জনের পশ্চাৎদেশের নিচে পায়ের ফাঁক গলিয়ে সামনে চলে যায়, কিন্তু তার প্রয়োজন হলো না, দেয়াল ভেঙ্গে ঘাম ছুটিয়ে তবেই আবিষ্কার করলো তার পাশে এখন আর কেউ নয়, স্রেফ কালোকেশী। দুজনেই পাশাপাশি হাঁটছে, আর দুজনেরই দৃষ্টি সম্মুখে স্থির।

কাঠমুখো প্রহরীরা সাবমেশিনগান হাতে কোনায় কোনায় দাঁড়িয়ে। ট্রাকের একটি দীর্ঘ লাইন ধীরে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। ট্রাকগুলোতে ছোট ছোট হলদেটে চেহারার মানুষগুলো সবুজাভ ইউনিফর্মে উবু হয়ে ঠাসাঠাসি করে বসা। তাদের বিষাদময় মঙ্গোলীয় চোখগুলো আশেপাশে পড়ে আছে তাতে কৌতুহলের চিহ্নও নেই। 

মাঝে মাঝে ট্রাকগুলো যখন ঝাঁকি খাচ্ছে তখন কয়েদীদের ধাতব ডান্ডাবেরিগুলো ঝন-ঝন শব্দ তুলছে। করুণ চেহারার কতগুলো মানুষে ঠাসা ট্রাকের পর ট্রাক পার হয়ে যাচ্ছে। উইনস্টন অবশ্য ওদিকটায় খুব একটা তাকালোও না। মেয়েটির কাঁধ ও কনুই কখনো কখনো তার কাঁধে ও হাতে এসে লাগছে। তার গাল এতটাই কাছে যে উষ্ণতা অনুভব করা যায়। তবে খুব দ্রুতই মেয়েটিই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিলো, ঠিক যেমনটি সে নিয়েছিলো ক্যান্টিনেও। একই অভিব্যক্তিশূন্য কণ্ঠে সে কথা শুরু করলো। ঠোঁটদুটি সামান্যই নড়ছে, বিরবির অনুচ্চ কণ্ঠ, শোরগোল আর ট্রাকের শব্দে যা সহজেই হারিয়ে যাচ্ছে। 
- ‘তুমি কি আমায় শুনতে পাচ্ছো?’
- ‘হ্যাঁ।’
- ‘রোববারের বিকেলটা ছুটি নিতে পারবে?’
- ‘পারবো।’
- ‘তাহলে মন দিয়ে শোনো। মনে রেখো। আমরা প্যাডিংটন স্টেশনের দিকে যাচ্ছি...’

সামরিক এলানের মতো বলে গেলো মেয়েটি। এতে হতবিহ্বল উইনস্টন। মেয়েটিই পথ বাতলে দিচ্ছে, তাকে স্রেফ অনুসরণ করে যেতে হবে। 

-‘রেলে আধাঘণ্টা, স্টেশনের বাইরে বায়ে ঘুরলে উঠে যাওয়া একটি সুঁড়িখানার লাগোয়া দরজা, সেখানে ঢুকলেই মাঠের ভেতর দিয়ে একটি পথ বয়ে গেছে, ঘাস গজিয়ে উঠেছে সে পথে, এগুলেই জঙ্গলের মাঝ দিয়ে একটি আরেকটি হাঁটাপথ, সেখানে শ্যাওলা ধরা একটি মরা গাছ।’ বলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছিলো পুরো মানচিত্র তার মস্তিষ্কে আাঁকা। 

‘পুরোটা মনে থাকবে তো?’ জানতে চাইলো মেয়েটি। 
- ‘হ্যাঁ।’ 
- ‘প্রথমে বায়ে ঘুরবে, এরপর ডানে, এরপর ফের বায়ে। আর মনে রাখবে এখানে উপরের সুঁড়িখানাটি এখন আর নেই।’
- ‘ঠিক আছে। কখন?’
- ‘তিনটার দিকে। তোমাকে একটু অপেক্ষা করতে হতে পারে। আমি ভিন্ন পথে যাবো। তুমি কি নিশ্চিত যে সবকিছু ঠিকঠাক মনে থাকবে?’
- ‘হ্যাঁ।’
- ‘তাহলে যত দ্রুত পারো আমার কাছ থেকে সটকে পড়ো।’ 

তাকে বলতে হতো না। কিন্তু তখনই ভীড়ের মধ্যে আলাদা হয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিলো না। ট্রাকগুলো তখনও পার হচ্ছে, মানুষগুলো তখনও হা করে তা দেখছে। গোড়ার দিকে কিছুটা হিস-হাস শব্দ ছিলো, সেগুলো ভীড়ের মধ্যে যারা পার্টির সদস্য তাদের মুখ থেকেই বের হচ্ছিলো, সেটাও দ্রুতই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন যা টিকে আছে তা স্রেফ কৌতুহল। ইউরেশিয়া থেকে হোক কিংবা পূর্ব এশিয়া থেকে, বিদেশি মানেই যেনো অদ্ভুত কোনো জন্তু। এই কয়েদীর সাজ ছাড়া আর কোনো রূপে এদের কেউ কখনো দেখেনি। এমনকি কয়েদীদের দিকে একবারের বেশি দুইবার তাকায়নি। আর, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে তাদের বাইরে অন্যদের কপালে কি ঘটছে তা তারা জানেও না। অন্যরা শুধুই উবে যাচ্ছে। নয়তো স্থান হচ্ছে জবরদস্তিমূলক শ্রমের ক্যাম্পে। গোলাকার চেহারাগুলো ময়লা, শশ্রুমণ্ডিত আর বিপর্যস্ত ইউরোপীয় রূপ নিয়েছে। ভাঙ্গা গালের ওপর গোলগোল বিষ্ফোরিত চোখগুলোর কোনো কোনোটির সাথে উইনস্টনের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত গভীরতার সে চোখগুলো আবার নিমিষেই সরে যাচ্ছে। বহরটি শেষ হলো। শেষ ট্রাকটিতে তার চোখে পড়লো এক বৃদ্ধের ওপর। ধূসর চুলে তার মুখ ঢাকা, দুই কব্জি সামনের দিকে বাঁধা, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। মনে হলো লোকটি যেনো এমন হাতবাঁধা অবস্থাতেই অভ্যস্ত। মেয়েটির কাছ থেকে উইনস্টনকে এখনই সরে যেতে হবে। কিন্তু শেষ মূহূর্তে, ভীড় তখনও তাদের ভেতরেই ঠেলছিলো আর সে বুঝতে পারলো তার হাতের ভেতর তখন মেয়েটির হাত। আস্তে আস্তে চাপ দিচ্ছে। 

দশ সেকেন্ডের বেশি হবে না, কিন্তু তার মনে হলো কতনা দীর্ঘ সময় ধরেই যেনো তারা দুজন হাত ধরাধরি করে আছে। এরই মধ্যে তার হাতের প্রতিটি বিষয়ই যেনো সে জেনে নিয়েছে। লম্বা আঙুল, লম্বাটে নোখ, কাজের চাপে কিছুটা শক্ত তালু, কিণাঙ্ক, কব্জির নিচে পেলব মাংস। 

অনুভূতি থেকে যতটা জেনে নিলো তা যেনো চোখে দেখে জানারই সমান। ঠিক তখনই তার মধ্যে একটা ভাবনা এলো, মেয়েটির চোখের রঙ কেমন তা তার জানা হয়নি। সম্ভবত ওগুলো বাদামী; তবে কালো চুলওয়ালাদের চোখ সাধারণত নীল হয়। মাথা ঘুরিয়ে মেয়েটির চোখ দুটি দেখে নেওয়া হবে ভীষণ বোকামি। এত মানুষের চাপাচাপিতে হাতে হাত ধরার দৃশ্য চোখে পড়বে না, কিন্তু তাকাতে গেলে ধরা পড়বে নিশ্চিত। তখনও তারা দুজনই স্থিরভাবে সামনে তাকিয়ে। তবে ততক্ষণে আর মেয়েটির চোখ নয়, উইনস্টনের মনের গভীরে ভেসে উঠলো সেই কয়েদীর মুখমণ্ডল ঢেকে থাকা চুলের ফাঁকগলিয়ে চোখে পড়া বিষাদময় দুটি চোখ।................. চলবে।