সমুদ্রস্তর বাড়ার আগেই চিংড়ি চাষে লবণপানির নিচে উপকুল, দায় কার?
বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ১১:৫৩ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার আপডেট: ১২:২২ এএম, ২৫ নভেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার
চিংড়িকে সাদা সোনা বলা হতো। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিভিন্ন পর্যায়ে ওঠানামার মধ্য দিয়ে চিংড়ি বাংলাদেশের অর্থনীতির আলোচনায় স্থান করেও নিয়েছিলো এই চিংড়ি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও রেখেছে ভূমিকা।
কিন্তু আজ চিংড়ি নিয়ে আলোচনা ভিন্ন পথে প্রবাহিত। কিভাবে? সে প্রশ্নের উত্তর পরে আসবে।
শুরুতেই বলে রাখা যেতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে এই চিংড়ি চাষের ব্যাপক প্রবনতা আমাদের পরিবেশের জন্য বড় ক্ষতিই ডেকে এনেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্লেষকদের মত সত্যি করে দিয়ে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্র স্তরের ৫০ সেন্টিমিটার বেড়ে যায় তাহলে এই বদ্বীপীয় দেশ বাংলাদেশের ওপর তার প্রভাবটাই সবচেয়ে বেশি পড়বে। যার সরাসরি আঘাত আসবে উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষগুলোর উপর।
বাংলাদেশের জন্য সমুদ্রের স্তর বেড়ে যাওয়া মানেই হচ্ছে বড় একটা স্থলভাগ পানির নিচে চলে যাওয়া। এতে বিনষ্ট হবে ফসলী জমি, গবাদি আর মনুষ্য জীবন। জীবন ও জীবিকা পড়বে চরম সঙ্কটে। তবে উপকুলীয় অঞ্চলে এরই মধ্যে যে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তার পেছনে এই ব্যাপকহারে চিংড়ি চাষের প্রবণতাও কম দায়ী নয়। কয়েক দশক ধরে নোনাজলকে কৃত্রিমভাবে ধরে রেখে তার মধ্যে চিংড়ি চাষের ব্যবস্থা পরিবেশের জন্য ক্ষতিই ডেকে এনেছে।
চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজারটা বাংলাদেশের কাছে ধরা দেয় সত্তুরের দশকের গোড়ার দিকেই। একটি হিসাব দেখাচ্ছে ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশ চিংড়ি রপ্তানি শুরু করে। আর সে বছর থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত চার দশকের এই চিংড়ি থেকে রপ্তানি আয় ২৯ লাখ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৫৯ কোটি ডলার পর্যন্ত বেড়ে যায়।
১৯৮০ সালে চিংড়ি চাষ বাণিজ্যিকভাবে চালু করতে সরকারি নীতিও গ্রহণ করা হয়। সে সময় সরকার মনে করেছিলো চিংড়ি চাষ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। আর পরে তা সত্যেও পরিণত হয়। ১৯৯০ সাল নাগাদ ১০০ মিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক বাজার ধরে বাংলাদেশ। যা ১৯৯৫ সাল নাগাদ বছরে ২০০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০০০ সাল নাগাদ ৩০০ মিলিয়ন ডলারে উঠে যায়। পরে কিছুটা ওঠা নামার মধ্য দিয়ে ২০০৫ সাল নাগাদ ৪০০ মিলিয়ন ডলার আর ২০১০ সাল নাগাদ ৫০০ মিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে এ পর্যন্ত চিংড়ি খাতে বাংলাদেশের বাৎসরিক আয় সর্বোচ্চ ছিলো। সেবছর দেশ এই মৎস্য পণ্য রপ্তানি করে ৫৯০ মিলিয়ন ডলার আয় করে।
তবে এর পর থেকে বাজারটি পড়তে শুরু করে। ব্যাপক হারে চাষের কারণে মান ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। অতিরিক্ত লোভের কারণে আরও বেশি করে চাষের প্রচেষ্টায় চিংড়িতে রোগ-বালাই ধরা পড়ে। আর তাতে আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম ক্ষুন্ন হতে থাকে আর বাজারটি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ২০২০ সাল নাগাদ এই বাজার ফের ৩৫০ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
ওদিকে চিংড়ি চাষের ব্যাপক প্রবনতায় ক্ষতির মুখে পড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রতিবেশ ও পরিবেশ। মানুষ কৃত্রিমভাবে জমিতে লবণাক্ত পানি টেনে এনে তা দিয়ে যখন চিংড়ি চাষে মেতে ওঠে তখন জমি, পুকুর, নদী, খাল, বিলসহ সে অঞ্চলের সকল জলাভূমি লবণপানিতে ভরে উঠতে শুরু করে। একসময় যেখানে ধান, পাটের চাষ হতো, দেশের পলিযুক্ত দোঁয়াশ মাটি ছিলো তা ধীরে ধীরে লবনাক্ত পানির দখলে চলে যায়।
বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্যদ্রব্য রপ্তানিকারক সমিতির একটি হিসাব মতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ৩ লাখ ৩৭ হাজার ১৬৪ হেক্টর জমির মধ্যে ২ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমি অর্থাৎ প্রায় ৮১ শতাংশই এক পর্যায় চিংড়ি চাষের অধীনে চলে যায়। এর মধ্যে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের জমিই ৭৬ শতাংশ।
লবণ পানি টেনে এনে আটকে রেখে মুনাফালোভীদের এই যে চাষ তার প্রভাবে ধান চাষের জমি তার উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এক পর্যায়ে সে সব জমির মালিকরাও উপায় না দেখে চিংড়ি চাষ শুরু করে। আর এভাবেই গোটা অঞ্চলের অধিকাংশ জমি লবণপানির নিচে চলে যায়।
চিংড়ি চাষীরা সীমাহীন লোভে পড়ে নদী থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি তুলে তা ছড়িয়ে দেয় ধানি জমিতে। এক পর্যায় ধান মরে যায়। আর তারা চাষ করে চিংড়ি। পরিবেশবিদরা মুনাফার প্রতি এই ব্যাপক লোভকে স্থানীয় মানুষের ক্ষেত্র স্রেফ অধিকার হরণ হিসেবেই দেখেছেন। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনের সুযোগটাও এতে হাতছাড়া হয়ে যায়। বিশেষ করে খাবার পানির তীব্র সঙ্কট পুরো উপকুলীয় অঞ্চল জুড়ে। যেখানেই চিংড়ি চাষ বেশি সেখানেই খাবার পানির সঙ্কট তীব্রতর।
ওয়াটার এইড বাংলাদেশের করা ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদন দেখাচ্ছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ৫৭টি পুকুর থেকে তারা পানি নিয়ে পরীক্ষা করিয়ে দেখেছন, এর মধ্যে ১৬টি পুকুরের পানি পান করার জন্য কিংবা রান্নার জন্য মোটেই উপযোগী নয়। ২৫টি পুকুরের পানি দিয়ে রান্না করা চললেও পান করা যায় না। আর বাকি ১৪টি পুকুর তো এখন আর মানুষের ব্যবহারের মধ্যেই নেই কারণ সেগুলোতে সরাসরি চাষ করা হচ্ছে চিংড়ি। খুলনা ও বাগেরহাট জেলার চিত্র এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়।
২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রের স্তর বেড়ে গেলে এই অঞ্চল লবনপানিতে ছেয় যাবে, সে আশঙ্কা জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্লেষকদের। তার জন্য দায়ী থাকবে বিশ্ব উষ্ণায়ন। যার দায় বাংলাদেশের নয়। কিন্তু দেশের উপকুলীয় অঞ্চলকে স্রেফ মুনাফার লোভে যে এরই মধ্যে কৃত্রিমভাবে লবনপানির নিচে পাঠিয়ে দেওয়া হলো তার দায় কে নেবে?