৬২ বছর পর দিয়াতলভ পাস দুর্ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, কী ঘটেছিল সেদিন?
সাতরং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:২৬ পিএম, ৯ নভেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার আপডেট: ০২:৩০ পিএম, ৯ নভেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার
১৯৫৯ সাল, রাশিয়া। জানুয়ারি মাসে ইগর দিয়াতলভ ও তার বন্ধুরা পরিকল্পনা করে হাইকিং-এ যাওয়ার। মোট নয়জনের দলটি বরফাচ্ছাদিত উরাল পর্বতের একটি চূড়ার উদ্দেশে রওনা দেয়। স্থানীয় মানসি আদিবাসীদের ভাষায় ওই চূড়ার নাম হচ্ছে 'খোলাত সিয়াখল', অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায় 'মৃত্যুগিরি'।
দিয়াতলভ ও তার বন্ধুরা ছিল পাকা হাইকার। ২৭ জানুয়ারি তারা ঘর ছেড়ে বের হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল পরবর্তী ১৬ দিনে ২০০ মাইল স্কি করা, অনেক পাহাড়ের চূড়া টপকানো। কিন্তু তুষারঝড় তাদের পরিকল্পনায় বাগড়া দেয়। প্রবল ঝড়ের মুখে পড়ে বাধ্য হয়ে ২ ফেব্রুয়ারি দুই নারী ও সাত পুরুষের অভিযাত্রিক দলটি তাঁবু ফেলে 'খোলাত সিয়াখল' পাহাড়ের পূর্ব ঢালে।
মৃত্যুগিরি পাহাড়টি তাদের মৃত্যুই উপহার দেয়। সেই পাহাড়ের আশেপাশেই পরে উদ্ধারকারী দল তাদের বিকৃত লাশ খুঁজে পায়। কীভাবে মৃত্যু হলো এই হাইকারদের তা নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
যথাসময়ে না ফিরে এলে তাদের খোঁজার জন্য উদ্ধারকারী দল পাঠানো হয়। প্রায় একমাস ধরে খোঁজাখুঁজি করে সবার লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। 'খোলাত সিয়াখল'-এর চারপাশে বরফ, গাছ, গিরিখাতের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাওয়া যায় লাশগুলোকে।
তাদের মৃত্যুর রহস্যকে আরও ঘনীভূত করে লাশগুলোর বিকৃত অবস্থা। অটোপসি রিপোর্টে জানা যায় ঠাণ্ডায় জমে মৃত্যু হয়েছে সবার। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় তাঁবুগুলো ভেতর থেকে কেটে বাইরে বেরোনোর জন্য পথ তৈরি করা হয়েছে। কারও শরীরের হাড়গোড় ভেঙে গেছে, কারও বা মাথার খুলিতে ফাটল দেখা যাচ্ছে। কয়েকজনের শরীর থেতলানো, চোখ উপড়ানো। একজন নারীর লাশের মুখের ভেতর জিহ্বা পাওয়া যায়নি, মনে হচ্ছিল কেউ বা কোনোকিছু তার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে।
এ রহস্যের কূলকিনারা করতে না পেরে অনেকে অনেক অনুমানতত্ত্বের জন্ম দেন। কেউ কেউ ধারণা করেন, ইয়েতির আক্রমণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ধারণা আরেকটু পাকাপোক্ত করে ওই নারীর জিভহীন মুখগহ্বর। কারও বিশ্বাস, রাশিয়ান সেনাবাহিনীর কোনো গোপন মিশনের মাঝখানে পড়ে গিয়েছিল দিয়াতলভ ও তার বন্ধুরা, তাই তাদেরকে মেরে এভাবে ফেলে রেখেছিল কর্তৃপক্ষ যাতে পুরো ব্যাপারটাকে রহস্যের মোড় দেওয়া যায়।
কেউ আবার মনে করেন কোনো উল্কাপিণ্ডের আঘাতে এ করুন পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয় দলটিকে। তবে ২০২১ সালের আগ পর্যন্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে ব্যাখ্যাটি পাওয়া যেত, তা হলো হিমবাহের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন অভিযাত্রীরা। কিন্তু অনেকে প্রশ্ন করতেন, তাহলে ওই নারীর মুখ থেকে জিভ খসে গেল কী করে।
অবশেষে ২০২১ সালে এসে দিয়াতলভ পাস দুর্ঘটনার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় জানুয়ারি মাসে 'ন্যাচার' জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী হিমবাহ তত্ত্বকেই দিয়াতলভ পাস দুর্ঘটনার আসল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। লাইভসাইন্স নামক এক সংবাদমাধ্যমে তা তুলে ধরা হয়।
দুর্ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
গবেষকেরা দাবি করেন বিশেষ পরিস্থিতিতে ছোট একটি হিমবাহ সৃষ্টি হয়, যার কারণে ভয় পেয়ে তাঁবু ছেড়ে রাতের অন্ধকারে তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেরিয়ে পড়েন দিয়াতলভেরা। এরপর বরফের বিশাল খণ্ড তাদের ওপর আঘাত করে। এ কারণেই লাশুলো বিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
তবে এ তত্ত্ব এখনো অনেকে মেনে নিতে পারেননি। কারণ দুর্ঘটনার ২৬ দিন পর উদ্ধারকারীরা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছান তখন সেখানে কোনো হিমবাহের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তবে যা-ই হোক, নিদেনপক্ষে এ কিংবদন্তীতুল্য রহস্যের একটা মোটামুটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তো শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। তবে যেহেতু এ ব্যাখ্যাটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তাই দিয়াতলভ পাস দুর্ঘটনা এখনো অনেক মানুষের কাছে অদ্ভুত শিহরণজাগানিয়া রহস্য হিসেবেই বেঁচে থাকবে।