অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

তারুণ্যে করোনাকাল ও তার ভবিষ্যত প্রভাব

মেহেরাজ জেবিন ইফতি

প্রকাশিত: ০৯:১৫ এএম, ৪ নভেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার  

একটি মহামারি! থমকে দাঁড়ালো পুরোটা গ্রহ৷ স্থবিরতাই যেন হয়ে উঠলো প্রত্যাহিক রুটিন।  প্রাণ আছে মন হারিয়ে, রাত আছে ঘুম হারিয়ে, কাম আছে প্রেম হারিয়ে, অভিমান জমে মান হারিয়ে। বাঁচতে হবে তাই বাঁচা। টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি মানুষ।

আগে সবাই বইতে মহামারি সংক্রান্ত কত কি পড়েছে। বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধ সবই জানা। কিন্তু এমন নীরব যুদ্ধ, হ্যাঁ, যুদ্ধই তো! এক অন্য ধরণের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ একটি না দেখা অস্পৃশ্য কারো সাথে। এ যুদ্ধের হাতিয়ারও অন্য ধরণের। আচ্ছা! কোন রাষ্ট্রপ্রধান যদি বলতো, ‘ যাও আজ থেকে তোমাদের অনির্দিষ্টকালের জন্য অবকাশ দেয়া হলো। শুয়ে-বসে দিন কাটাও। ’   ভাবতে পারেন তাহলে কি না কি হয়ে যেত! জল কত দিকেই না গড়াতে পারতো। কিন্তু হায়! এ তো প্রকৃতির দান। প্রকৃতির সাথে তো আর পাল্লা চলে না। সবাই তাই মেনে নিতে অথবা মানিয়ে নিতে বাধ্য। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাড়ালে, 
পিটুনি কতটুকু নিতে পারবে? —একটুও না।  
ধরে বেঁধে দিলে? —যত দিবেন তত...
   
আমাদেরও হচ্ছে সেই অবস্থা। এখন পড়াশোনা বিমুখ ছাত্রটিও চায় তার কিছু না কিছু গতি হোক। শিক্ষকরাও ছুটি কাটাতে কাটাতে আজ ক্লান্ত। বাবা মাও ছেলেমেয়েদের শুয়ে-বসে দেখতে দেখতে খানিকটা বিরক্ত।

তাছাড়া শুধু তো পড়াশোনা না। এইযে জোয়ান বয়সের চঞ্চলময় উজ্জ্বল দিনগুলো এভাবে এডভেঞ্চার ছাড়া ডালভাতের মতো কাটাতে হচ্ছে,  এ সময়, এই বয়স, এই দুরন্তপনার মুহূর্ত আর কি কখনো আসবে! বাড়িতে থেকে থেকে এখন ডিপ্রেশনে চলে যাওয়া কি খুব অস্বাভাবিক! ঠিক দু বছর আগেও এমন জীবন কেউ ভাবতে পারতো! অটোপ্রমোশন পেয়ে পাশ করা শিক্ষার্থীটাও আজ কম হতাশাগ্রস্ত না। একদিকে ভবিষ্যতের কথা ভাবলে তারা কুল-কিনারা পায় না আবার বর্তমানেও তাকে টিটকিরিমূলক কথা কম শুনতে হয় না।
         
একজন তরুণের জীবনে করোনার প্রভাব কোন অংশেই কম তো নয়ই বরং চোখে পড়ার মতো। এটি একেকটা জীবনকে তছনছ করে  দিতে যথেষ্ট। আসলে তরুণদের বিশেষ করে বেকার তরুণদের জীবনে করোনা মহামারী যে কত টা ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে তা কল্পনাতীত। তাছাড়া কোভিড পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে বলা যায়, এটা মানুষের জীবনে বিশেষ করে উদীয়মান তরুণ প্রজন্মের পথচলায় ক্ষতিসাধন করেছে অনেক বেশি। সে তুলনায় এর খুব একটা ইতিবাচক দিক নেই বললেই চলে ।

দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ ই তরুণ/যুবক শ্রেনির। জাতিসংঘের সংজ্ঞানুযায়ী ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের তরুন/যুবক বলা যায়। তবে ১৮-২৭ বছর বয়সী তরুনরা-ই এদের মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা যায়, এই বয়সী তরুণরা সাধারণত এইচএসসি পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে সদ্য গ্রাজুয়েট বেকার থাকে। এটাই তাদের জীবনের এক টার্ণিং পয়েন্ট। কিন্তু এই কোভিড পরিস্থিতির কারনে এই বয়সী যুবকেরা সবচেয়ে বেশি হতাশাগ্রস্ত হয়ে আছে। কারন, সবার ই পড়াশোনা আটকে আছে। সবার চিন্তা পড়াশোনা টা শেষ করে পরিবারের হাল ধরা। উপার্জনের পথ খুঁজে বের করা। এখন এই পরিস্থিতিতে না পারছে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে আর না পারছে কোনো ছোটখাটো জব বা বিজনেস স্টার্টআপ করতে। না পারছে উদ্দোক্তা হতে। না পারছে টিউশন করে খরচ চালাতে। উপরন্তু পরিবারের জন্য এরা নিজেদেরকে বোঝা মনে করছে। পরিবারের জন্য কিছু করতে তো পারছেই না বরং হাত পেতে হাতখরচ নেবার বিষয়টি দিন দিন তাকে হীনমন্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ক্যারিয়ারেরও খুব একটা ডেভেলপ হচ্ছে না। কিছু তরুন শিক্ষার্থীর হয়তো বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের স্বপ্ন ছিলো, কিন্তু গ্রাজুয়েশন শেষ না হওয়ায়, সেই স্বপ্নও নষ্ট হতে চলেছে। এসপার ওসপার কোন সিদ্ধান্তেই তারা পৌঁছাতে পারছে না।

গ্রামাঞ্চলের তরুণদরর  সমস্যা হয়তো আরো প্রকট। সেখানে উপার্জনমুখী কাজের ক্ষেত্র তুলনামূলক কম। সময় টা যাচ্ছে শুধুই শুয়ে বসে। কোনো প্রোডাক্টিভ কাজ হচ্ছে না। জীবন ঠিকই আটকে আছে কিন্তু সময়টা হুর হুর করে গড়িয়ে যাচ্ছে। আর এই যে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে সেই সাথে বাড়ছে হতাশা, উদ্বিগ্নতা, আক্ষেপ, বিষন্নতা। অনেক তরুণ আছে যারা খারাপ সঙ্গে মিশে জীবনকে তছনছ করে দিতে একটুখানি ভাবছেও না। মদ, গাঁজা, জুয়া, বিভিন্ন মাদক এখন তাদের নিত্যসঙ্গী। আবার যে সকল তরুণ প্রাইভেট সেক্টরে কর্মরত ছিল , হয়তো অনেকের চাকরি চলে গেছে। সে হয়ে পড়েছে  দিশেহারা। পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে  হচ্ছে। তরুণ শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে কোভিড এর এই দেড় বছরে হতাশ আর মানসিক চাপ নিতে না পেরে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বললে ভুল হবে, করোনা পরিস্থিতি সামগ্রিক ভাবেই আত্মহত্যার সংখ্যা বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে বটে।

তরুণীর জীবনেও এই মহামারী কম কিছু প্রভাব ফেলে নি। এই মহামারী বেশির ভাগ তরুণীর জীবনের মোড়ই উল্টেপাল্টে দিয়েছে। সাধারণ ভাবে বয়ে চলা জীবনটা আজ হতাশা, হীনমন্যতা দিয়ে ঘিরে রয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েগুলো পড়াশোনা থেকে অকালে ঝড়ে পড়েছে। কিছুদিন আগে জানা গেল, প্রত্যন্ত একটি গ্রামের মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলছেন, এসাইনমেন্ট নেবো কাদের! ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির কোন শিক্ষার্থীই তো অবশিষ্ট নেই। অর্থাৎ সবাই এখন শশুর বাড়ির সংসার সামলাচ্ছে। শুধু যে নিম্নমধ্যবিত্ত তা কিন্তু নয়, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত সব পরিবারের মেয়েদেরই কমবেশি ঝামেলা পোহাতেই হচ্ছে। কেউ প্রতক্ষ কেউ পরোক্ষভাবে সম্মুখীন হচ্ছে সমাজের আক্রমণের।  

একটা মেয়েরও তো স্বপ্ন থাকতে পারে, লক্ষ্য থাকতে পারে। কিন্তু এভাবে পরের ঘাড়ে চেপে কতদিন নিজেকে বহন করতে হবে কেউ জানে না। অথচ নারীর আত্মনির্ভরশীল হওয়া এখন স্বপ্ন নয় লক্ষ্য, বিলাসিতা নয় বাধ্যতামূলক। কিন্তু সব কিছুই আজ খাপছাড়া হয়ে অবেলায় সুপ্ত হয়ে গেল। না পারছে গিলতে না ফেলতে। পড়াশোনা শেষ করে সংসারের হাল ধরতে চাওয়া মেয়েটির আজ নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কোন সুরাহা নেই। সমবয়সী প্রেমের জুটির প্রণয়িনীর পড়াশোনা শেষ করে ছোট্ট সংসার পাতার কল্পনাও কল্পনাই রয়ে গেল। কবে পড়াশোনা শেষ হবে, কবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে আর কবেই বা স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে! এর কে জবাবই বা দেবে ! যে মেয়েটি আশায় আশায় ছিল, যে আর মাত্র কদিন পড়েই পরাধীনতার শিকল ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারবে মুক্তির পথে, সে আজ উদাস চোখে আকাশ পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখে। নিজস্ব সমাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দুচোখ জোড়া স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মেয়েটিকে আজ দু কাহন শোনানোর সুযোগ কেউ ছাড়ে না। অথচ প্রতিত্তোরে জবার দেওয়ার কিছুই নেই। যে সব বাবা মা মেয়ের পাশে থেকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে তাঁদেরও কম কথা শুনতে হয় না। ফলশ্রুতিতে তারা সমাজের চাপে পিষ্ট হয়ে মানসিক চাপে এবং সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। এই করোনাকালে তরুণদের মতোই কিছু তরুণীরও কোন সুরাহার পথ না পেয়ে নিজেরাই সমাধান হিসেবে আত্মবিসর্জনের পথ বেছে নেওয়ার নজির কম নেই। 

করোনা কি শুধু নিতেই জানে! এর কি কোন ইতিবাচক দিক নেই! একটি সমীক্ষায়  জানা গেছে যে, কোভিড পরিস্থিতি খুব একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। শিক্ষাক্ষেত্রে হয়তো অনলাইন কার্যক্রম টা আগের তুলনায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। যেমন, কোভিড পরিস্থিতির পূর্বে তো গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা দূরশিক্ষণ সম্পর্কে তেমন অবগত ই ছিলো না। শহরের তরুনেরা হয়তো কিছুটা জানতো। কিন্তু এই কোভিড পরিস্থিতির কারনে, সবাই দূরশিক্ষণ সম্পর্কে হাতেখড়ি পেয়েছে। যদিও এটা খুব একটা কার্যকরী হতে পারেনি। নেটওয়ার্ক সমস্যা, পর্যাপ্ত  ডিভাইস এর অভাব বিদ্যুৎ সমস্যা ইত্যাদি এর পিছনের প্রতিবন্ধকতা। তাছাড়া সরাসরি পাঠদান ও পাঠ গ্রহন যতটা কার্যকরী ও সহজবোধ্য, অনলাইন লার্নিং ততটা সহজবোধ্য নয়। তবে দেখা যায় কতিপয় শিক্ষার্থী এই ছুটি মনের মতো কাজে লাগিয়ে নিজেদের সুবিধামতো স্কিল বাড়ানোর পথ বেছে নিয়েছে। অনেকের বেশ উপকারও হয়েছে এতে। আবার কোভিড এর আরেকটা ইতিবাচক দিক হতে পারে,  ছোটখাটো উদ্যোক্তা হওয়া। যেমন কিছু কিছু তরুণতরুণী এই সময়টা কাজে লাগিয়ে অনলাইনে প্রোডাক্ট সেল করছে, কেউ ফ্রিল্যান্সিং শিখছে, স্কিল ডেভেলপ করছে। তবে এই ধরনের তরুণতরুণীর সংখ্যা খুবই নগন্য। তাই সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে বলা যায়, কোভিড পরিস্থিতি তরুণতরুণীদের খুব একটা ইতিবাচক কিছু না দিলেও দিয়েছে হাহাকার, হীনমন্যতা, হতাশা, ব্যর্থতা, স্বপ্নভঙ্গ, বিষন্নতা। একসাথে এতদিন বসবাস করে কারো কারো পারিবারিক বন্ধন পূর্বের থেকে দৃঢ় হয়েছে। সত্যিকারের পাশে থাকা বন্ধুদের চিনতে পেরেছে অনেকেই। যা পরবর্তী জীবনে চলার পথে খুব উপকারে আসবে। কর্মজীবী নারীদের সন্তানেরা তাদের মা'কে কাছে পেয়েছে যার জন্য তাদের তীর্থের কাকের মতো প্রতীক্ষা করতে হতো।

যদিও মহামারি একটিই, কিন্তু এই মহামারির গল্প একটি নয়। পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গঞ্জে, শহর নগরে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন গল্প দেখা যায়। কারণ বিশ্বের সব জায়গায় কোভিড-১৯ এর প্রভাব একই রকম নয়। কাজেই নিজস্ব লোকালয় বাইরের খবর রাখাটাই যেখানে মুশকিল সেখানে নিজ দেশের বাইরে অন্যান্য দেশের বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞতা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু একটা ব্যাপার এ গ্রহের সবার জন্য একই। সে আপনি আমাজনের জঙ্গলে থাকুন বা জার্মানির আকাশছোঁয়া ভবনে থাকুন, অথবা যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় থাকুন। মানুষ মানুষের সংস্পর্শে আসলেই আসলে এই মহামারীর রমরমা কারণ এর ভাইরাস বেঁচেই থাকে এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের দেহে বাসা বেঁধে। কাজেই মানুষ যত মানুষের কাছাকাছি আসবে, তত সহজে এটি ছড়াবে। প্রথম দিকে যখন চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছিল, তখন যেমন এটি সত্যি ছিল, এখনো এতদিন পরেও এর কোন নড়চড় হয় নি। তাই বলা যায়, বিশ্বে এখনো প্রধান আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে করোনাই প্রথম সারী দখল করে নিয়েছে। তাই আবেগ নয়, বিবেক দিয়ে ভাবলে এটা বলতেই হবে যে করোনাকালীন পরিস্থিতি সত্যিই সুনিপুণ ভাবে লক্ষাধিক প্রাণ তছনছ করতে পুরোপুরি সক্ষম হয়েছে । এ যেন সাক্ষাৎ একটি স্নায়ুযুদ্ধ। যে যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ, যুবক, যুবতী, নারী, পুরুষসহ বিশ্বের প্রতিটা স্তরের মানুষ। অথচ এর কোন স্থায়ী সমাধান এখনো হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায় না। মানুষ দিন দিন নতুন করে ভুগছে। জীবনটাকে জুয়ার সামগ্রী হিসেবে চালিয়ে যাচ্ছে। হয় এসপার নয় ওসপার।

লেখক: মেহেরাজ জেবিন ইফ্তি, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।