অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩]

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

প্রকাশিত: ১১:৪১ পিএম, ২৪ অক্টোবর ২০২০ শনিবার   আপডেট: ১২:৫০ এএম, ১০ নভেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার

প্রথম খণ্ড, প্রথম অধ্যায়
[পর্ব-১] [পর্ব-২]

পর্ব-৩

রুম জুড়ে ঘৃণা ততক্ষণে চরমে রূপ নিয়েছে। গোল্ডস্টেইনের কণ্ঠকে তখন সত্যিকারেই ভেড়ার ভ্যা ভ্যা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিলো না। আর স্ক্রিনে তার মুখটি হঠাৎ ভেড়ার মুখ হয়েই ভেসে উঠলো। পরমূহূর্তেই সেই মুখ পাল্টে গেলো এক ইউরেশীয় সৈনিকের মুখাবয়বে। বিশালাকায় ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে সে অবয়ব সামনে এগিয়ে আসছে, আর তার হাতের সাব-মেশিনগান ভীষণ গর্জাচ্ছে। মনে হচ্ছিলো যেনো স্ক্রিন থেকেই লাফিয়ে বের হয়ে হামলে পড়বে সেই সৈনিক। দৃশ্যের চিত্রায়ন এতটাই ভয়াবহ ছিলো যে, সামনের সারির দিকে বসা কয়েকজন তাদের মাথা কিছুটা পেছনে হেলিয়েও দিলো। তবে মাথাগুলো ফের নিজের জায়গায় যেতে না যেতে ঠিক সেই মূহূর্তে  সকলের মুখে স্বস্তির এক গভীর রেখা এঁকে দিয়ে ভয়াবহ সৈনিক মূর্তিটি উবে গেলো, আর ভেসে উঠলো বিগ ব্রাদারের মুখাবয়ব। কালো চুল, কালো গোঁফ, ক্ষমতার আধার, রহস্যময় এক শান্তির প্রতীক। আর সে ছবি এতটাই বড় যে গোটা স্ক্রিন জুড়ে ছিলো তার উপস্থিতি।

তবে বিগ ব্রাদার যা বলছিলেন তা কারো কানে ঢুকছিলো না। কি আর হবে! উৎসাহব্যাঞ্জক কিছু বক্তব্য। যুদ্ধের ডামাডোলে এধরনের কথাবার্তা খুব শোনা যায়, নেই স্পষ্ট কোনো বার্তা, কিন্তু বলার ধরনে এক ধরনের আস্থার অভিব্যক্তি আছে। এরপর একসময় বিগ ব্রাদারের মুখমণ্ডলটিও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো। আর স্ক্রিন জুড়ে ভেসে উঠলো তিনটি স্লোগান- 

যুদ্ধই শান্তি
স্বাধীনতা দাসত্ব 
অজ্ঞতাই শক্তি  

তবে বিগ ব্রাদারের মুখটি এরপরেও কয়েক সেকেন্ড ধরে পর্দায় ভাসছে বলেই মনে হচ্ছিলো, কারণ প্রত্যেকের চোখের মনিতে এর যে প্রভাব তা এত দ্রুত মুছে যাবার নয়। ছোট ধূসরকেশী তার সামনের চেয়ারের ওপর ঝুঁকে পড়লো বির বির করে কি যেনো বলতে বলতে। শব্দটি উইনস্টনের কানে এলোও বটে- ‘আমার ত্রাতা!’। আর এ কথা বলে মেয়েটি তার দুবাহু ছুঁড়ে মারলো স্ক্রিনের দিকে। পরক্ষণেই দুই হাতের তালু দিয়ে চোখমুখ ঢেকে নিলো। দেখে মনে হলো- নিশ্চয়ই এখন কোনো প্রার্থনায় রত হয়েছে সে। 

এমনই একটা মূহূর্তে গোটা কক্ষে একধরনের গুঞ্জন শুরু হলো। চারিদিক থেকে ছন্দময় ধ্বনি আসতে লাগলো ‘বি-বি!....বি-বি!’ বার বার উচ্চারিত হতে লাগলো সে ধ্বনি। ধীরে ধীরে প্রথম ‘বি’ উচ্চারণের পর একটু থেমে দ্বিতীয় ‘বি’ উচ্চারণ। একটি ভারী গুঞ্জন। কিন্তু আপনি একটু কৌতুহলী হয়ে কান পেতে শুনলে বুঝতে পারবেন এ ধ্বনি আসলে অনেকগুলো খালি পায়ের দুমদুম শব্দ বৈ কিছু নয়। সম্ভবত টানা ত্রিশ সেকেন্ড চললো ওই ‘বি-বি!’। আপনি যখন কোনও আবেগ দ্বারা তাড়িত থাকবেন তখন এমন শব্দ আপনার কানে পৌঁছাবেই না। অংশত এটি বিগ ব্রাদারের প্রাজ্ঞতা আর রাজসিকতার স্তুতি গান, তবে তার চেয়েও বড় কথা এটি আসলে আত্মসংবেশন, ছন্দময় শোরগোলের মধ্যে থেকে সচেতনতার সলিল সমাধি। উইনস্টনের ভেতরটা যেনো আরও শীতল হয়ে আসছিলো। দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচি তার বিভ্রমগুলো কাটাতে পারেনি। তবে অমানবীয় ওই ‘বি-বি!...বি-বি!’ ধ্বনি তার ভেতরটা ভীতিতে ভরে দিলো। 

এটা নয় যে সে নিজে অন্যদের সঙ্গে এই গুঞ্জনে অংশ নেয়নি; সেটা না নেওয়া সম্ভবও ছিলো না। আপনার অনভূতিকে গোপণ করা, চেহারায় অভিব্যক্তিতে নিয়ন্ত্রণ, অন্যরা যা করছে তা নিজেও করা এসবই এক সহজাত প্রতিক্রিয়া। তবে এরই মধ্যে কয়েকটি সেকেন্ড পাওয়া গিয়েছিলো যখন তার চোখের অভিব্যক্তি কল্পনায় তাকে প্রতারণা করে যায়। এবং ঠিক সেই মূহূর্তেই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে- হলফ করে বলতে পারে- নিশ্চিতভাবেই সেটা ঘটেছে।

এক মূহূর্তের জন্য ও’ব্রায়েনের চোখ ধরা পরে উইনস্টনের চোখে। ও’ব্রায়েন তখন উঠে দাঁড়িয়ে। চশমা জোড়া খুলে ফের তা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় নাকের ডগায় বসাচ্ছিলেন। আর তখনই, ঠিক এক লহমার জন্য তাদের চোখাচোখি হয়। আর সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়টুকুতেই উইনস্টন বুঝে ফেলে- হ্যাঁ সে ঠিক বুঝে নেয়- ও‘ব্রায়েনও তাই ভাবছেন যা রয়েছে তার নিজেরও ভাবনা জুড়ে। এক অভ্রান্ত বার্তা দেওয়া-নেওয়া হয়ে যায়। যেনো তাদের দুজনেরও দুটি মন খুলে গেছে, এবং তাদের একজনের ভাবনা চোখের চাহুনির গতিপথে অন্যজনের ভেতর ঢুকে গেছে। ও’ব্রায়েন যেনো তাকে বলে দিলেন, ‘আমি তোমার সাথে আছি। আমি স্পষ্ট করেই জানি কি রয়েছে তোমার ভাবনা জুড়ে। আমি তোমার অপছন্দের কথা জানি, তোমার ঘৃণার কথা জানি, তোমার ক্ষোভের কথা জানি। কিন্তু ভয় পেয়ো না, আমিও তোমার দিকেই আছি!’ এর পরপরই বুদ্ধিমত্তার সেই দীপ্তি নিমেষে মিইয়ে গেলো। আর ও’ব্রায়েনের চেহারা ঠিক অন্যদের চেহারার মতোই হেঁয়ালিপূর্ণ হয়ে উঠলো। 

ব্যস এটুকুই। আর এরপর উইনস্টনের ভেতর আবারও অনিশ্চয়তা ভর করলো, আসলেই কি ঘটনাটি এমন ঘটেছে! এ ধরনের ঘটনা কখনোই কোনো পরিণতি পায় না। যা হয়, তা হচ্ছে- ভেতরে একটা বিশ্বাস অথবা প্রত্যাশা জাগ্রত হয় এই ভেবে যে, সে ছাড়া অন্যরা দলের শত্রু। ব্যাপক গোপণ ষড়যন্ত্রের যে গুজব, তা সত্যি হতেও পারে, হতে পারে ব্রাদারহুডেরও অস্তিত্ব রয়েছে! এত গ্রেপ্তার, এত স্বীকারোক্তি, এত মৃত্যুদণ্ডের পর ব্রাদারহুড যে কেবলই একটি জনশ্রুতি নয়, তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন। কোনো কোনো দিন এতে তার বিশ্বাস হয়, কোনো দিন হয় না। কোনো প্রমাণ ছিলো না, কেবলই একটি পলায়নপর চোখের চাহুনি, যার কিছু অর্থ থাকতেও পারে; নাও থাকতে পারে। শুনে ফেলা কোনো কথপোকথন, টয়লেটের দেয়ালে লেখা শব্দের অষ্পষ্ট আঁকিবুকি- একদা, এমনকি, যখন দুই আগন্তুকের দেখা হয়, তখনও হাতের ছোট্ট নড়াচড়াই এক ধরনের স্বীকৃতির ইঙ্গিত বহন করে। এসব কিছুই অনুমান। সবই তার কল্পনা। ও’ব্রায়েনের দিকে আর একটি বারের মতোও না তাকিয়ে সে নিজের কক্ষে চলে গেলো। সেই এক লহমার দৃষ্টি বিনিময়ের কোনো ফলোআপ হতে পারে এমনটি তার মনেও আসেনি। মনে যদি সে কথা আসতো তাহলে তা হতো অকল্পনীয় বিপদের কারণ। এক দণ্ড, দু-দণ্ডের জন্য তারা তাদের অস্পষ্ট দৃষ্টি বিনিময় করেছে, আর সে গল্পের সেখানেই সমাপ্তি। যদিও সেটি ছিলো স্মরণযোগ্য ঘটনা, তবে তা স্রেফ রূদ্ধঘরের একাকীত্বেই স্মরণ করা যেতে পারে, আর তার মধ্য দিয়েই মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। 

উইনস্টন মাথা তুললো আর আরও সোজা হয়ে বসলো। পেটের ভিতর থেকে উঠে আসা একটি ঢেঁকুর বের করে দিলো। পাকস্থলী থেকে জিন ততক্ষণে পাক দিয়ে উপরে ঠেলে উঠতে চাইছে।

আবারও চোখ ফেললো কাগজের দিকে। সে দেখলো অসহায় চিন্তুাগ্রস্ততা নিয়ে সে যখন বসেছিলো তখনও সে আসলে লিখেই চলছিলো, যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে সে কাজ। আর এই লেখা ঠিক আগের মতো ঘিঞ্জি, অসুন্দর হাতের লেখা নয়। তার কলম মনের সুখে মসৃণ পাতায় লিখে গেছে, বড় বড় অক্ষরে সে লেখা- 
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক...

এভাবেই বার বার, পুরো আধা পৃষ্ঠা জুড়ে একই লেখা।

আতঙ্কের বেদনায় মুষড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ রইলোনা উইনস্টনের। যদিও তা ছিলো অযৌক্তিক। কারণ ডায়রি লেখা শুরু করার যে বিপদ, এই কথাগুলো তার চেয়ে বড় বিপদের কারণ হবে; এমনটা নিশ্চয়ই নয়। তবে তারপরেও এক মূহূর্তের জন্য তার মনে হলো পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে আর পুরো উদ্যোগটিই বাতিল করে দেয়। 

কিন্তু সে তা করলো না, কারণ সে জানতো, অযথাই করা হবে সে কাজ। বিগ ব্রাদার নিপাত যাক লেখা কিংবা এই লেখা থেকে বিরত থাকা এসবের কোনো কিছুই কোনও ভিন্নতা বয়ে আনবে না। ধরা পড়লে থট পুলিশ তার সঙ্গে দুটো কাজের জন্য একই ব্যবহার করবে। আর যদি একটি বারের জন্যও সে কাগজে কলম না ছোঁয়ায়, তাতেও কিছু যায় আসে না। কারণ অপরাধ যা করার সে করে ফেলেছে। একটি বড় অপরাধের মধ্যেই লুক্কায়িত থাকে আর সব অপরাধ। ওরা একে বলে চিন্তাঅপরাধ (থটক্রাইম)। থটক্রাইম চিরদিন ঢেকে রাখা যায় না। আপনি হয়তো সফলভাবে সে অপরাধ কিছু সময়ের জন্য, এমনকি কিছু বছরের জন্য ঢেকে রাখতে পারবেন, কিন্তু আজ নয়তো কাল, এখনই নয়তো আরও পরে তা বেরিয়ে আসবেই। 

কাজটি রাতেই ঘটে। গ্রেপ্তার করার জন্য রাতকেই ওরা বেছে নেয়। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ একটি ঝাঁকুনি, একটি কর্কশ হাত আপনার কাঁধে, আপনার চোখের ওপর আলো জ্বলছে, বিছানার চারিদিকে ঘিরে রয়েছে কঠিন মুখগুলো। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো বিচার-আচারের বালাই নেই, গ্রেপ্তারের কোনো খবরও নেই। মানুষগুলো ঠিক গুম হয়ে যায়, আর সব সময়ই তা রাতের বেলায়। এরপর আপনার নামটি নিবন্ধনের খাতা থেকে কেটে দেওয়া হবে। আপনি কোথায় কখন কি করেছেন তা সব মুছে ফেলা হবে। আপনি যে কখনো কেউ ছিলেন তাই অস্বীকার করা হবে, এবং এরপর ধীরে ধীরে সবাই সব ভুলে যাবে। আপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবেন, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। সাধারনত যে শব্দটি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে- ‘উবে যাওয়া’।

এক মূহূর্তের জন্য স্নায়ুবৈকল্যে পেয়ে বসলো উইনস্টনকে। সে আবার লেখা শুরু করলো এলোমেলো এবং আরও দ্রুততায়-

ওরা আমাকে গুলি করবে, আমি পরোয়া করি না। ওরা আমার ঘাড়ের পেছনে গুলি করবে, আমি পরোয়া করি না। বিগ ব্রাদার নিপাত যাক। ওরা সবসময়ই যে কাউকে ঘাড়ের পেছনে গুলি করে। কিন্তু তাতে আমি পরোয়া করিনা। বিগ ব্রাদার নিপাত যাক। 

ফের চেয়ারে হেলান দিলো, আর কিছুটা লজ্জাবোধ করে আবার কলম নিয়ে ডায়রির ওপর ঝাপিয়ে পড়লো। এবার শুরু হলো আরও তীব্রতায়। ঘরের দরজায় ঠিক তখনই কড়া নাড়ার শব্দ। 

এরই মধ্যে! ইঁদুরের মতো চুপ হয়ে বসে থাকলো সে এক অকারণ প্রত্যাশায়, যাই হোক সাড়া না পেয়ে একবার চেষ্টা করে চলে যেতে পারে। কিন্তু না, কড়া নাড়ার শব্দ বেড়েই চলছে। দেরি করার ফল হবে সবচেয়ে খারাপ। তার হৃদযন্ত্র ততক্ষণে দ্রিম দ্রিম দামামা বাজিয়ে চলেছে, কিন্তু চেহারাটি দীর্ঘ অভ্যাসের কারণে সম্ভবত তখনও ভাবলেশহীন। উঠে দাঁড়ালো, আর দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।......... পরের অংশ পড়ুন এখানে