আনন্দময়ীর আগমনে
শারফিন শাহ
প্রকাশিত: ১২:১৫ এএম, ১৫ অক্টোবর ২০২১ শুক্রবার আপডেট: ১২:১৬ এএম, ১৫ অক্টোবর ২০২১ শুক্রবার
বর্ষাধৌত আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, ভোরে শিউলি ফুলের ম ম গন্ধ, কাশবনে অমল ধবল রূপের খেলা—প্রকৃতির এমন মোহনকালে পুজোর ঢাকে পড়ল কাঠি। শান্তির বার্তা নিয়ে বাঙালির দ্বারে উপস্থিত আনন্দময়ী দুর্গা মা। দিকে দিকে এখন দেবীর বন্দনা। দেবী দুর্গার আগমনে চারদিকে বাজছে আনন্দবীণা। মণ্ডপে মণ্ডপে এখন আনন্দময়ীর স্তুতি।
দুর্গার মাঙ্গলিক আগমনে সাধারণের সাথে কবিমনেও তরঙ্গ ওঠেছে। বাঙালির দুই শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় এসেছে দুর্গার মহিমা-কীর্তন। রবীন্দ্রনাথ দুর্গার আগমনে উদ্বেলিত হয়ে লিখেছিলেন :
"জননীর দ্বারে আজি ঐ শুন গো শঙ্খ বাজে।
থেকো না থেকো না, ওরে ভাই, মগন মিথ্যা কাজে॥
অর্ঘ্য ভরিয়া আনি ধরো গো পূজার থালি,
রতন প্রদীপখানি যতনে আনো গো জ্বালি,
ভরি লয়ে দুই পাণি বহি আনো ফুলডালি,
মার আহ্বানবাণী রটাও ভুবনমাঝে॥"
এদিকে আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, একজন মুসলমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম দুর্গা মায়ের আগমন নিয়ে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, নান্দনিক ও কালজয়ী সব গান ও কবিতা রচনা করেছেন। নজরুল একদিকে দুর্গাকে যেমন আনন্দময়ী ভেবেছেন অপরদিকে তাকে ভেবেছেন দুর্গতিনাশিনী হিসেবে। দুর্গা মায়ের আগমনে স্ফুর্ত হয়ে নজরুল লিখেছিলেন :
"মা এসেছে মা এসেছে উঠল কলরোল।
দিকে দিকে বেজে ওঠে সানাই কাঁসর ঢোল ॥
ওরা নদীর কূলে/শিউলি শালুক পদ্মফুলে,
মায়ের আসার আভাস দুলে/আনন্দ-হিল্লোল।"
নজরুল অপরদিকে দুর্গামায়ের বিদ্রোহী রূপটাকেও তার কবিতায় প্রতিভাত করেছেন । তার ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ বা ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতায় তাই পাওয়া যায়। 'রক্তাম্বরধারিণী মা' কবিতায় তিনি মায়ের স্তুগিগান করেছেন এভাবে:
"শ্বেত শতদলবাসিনী নয় আজ
রক্তাম্বরধারিণী মা
ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর
সৃষ্টির নব পূর্ণিমা।"
আবার আনন্দময়ীর আগমনে কবিতায় তার দেবীবন্দনা আরো বিদ্রোহীরূপে:
"আর কতকাল থাকবি বেটি
মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে
অত্যাচারী শক্তি চাড়াল?
দেবশিশুদের মারছে চাবুক
বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা
আসবি কখন সর্বনাশী?"
প্রকৃতপক্ষে নজরুলের দুর্গাবন্দনার এই বিদ্রোহীরূপটাই সত্য। চন্ডীগ্রন্থের বর্ণনা অনুয়ায়ী, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ হলো জীবনকে দুর্গতি প্রদান করা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গবিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্য প্রদান করেন এবং জীবন ও জগৎকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা মা। প্রাচ্য বিদ্যার্ণব আচার্য ড. মহানামব্রত ব্রক্ষ্ণচারী মহারাজ তার ‘চন্ডীচিন্তা ও মা দুর্গার রূপক কাঠামো’ নামক গ্রন্থে দুর্গা শব্দটির একটি রূপক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, যে দুর্গমাসুরকে দেবী দুর্গা বধ করেছিলেন তার দুই রূপ। সংসারপথে এই অসুরের নাম স্বার্থান্ধতা, আর আধ্যাত্মিক পথে এই অসুরের নাম অবিদ্যা। দুর্গম স্বার্থান্ধতায় মজে জীবন অশেষ দুর্গতি ভোগ করে। মা দুর্গা মানুষের মধ্যে কল্যাণবুদ্ধি জাগ্রত করে সকল বিনষ্টি হতে তাদেরকে রক্ষা করেন। দ্বিতীয়ত, অবিদ্যার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জীবন অনবরত কষ্ট ভোগ করতে থাকে। জ্ঞানরূপ অসি দিয়ে অবিদ্যারূপ বন্ধন ছিঁড়ে কল্যাণময়ী মা দুর্গা তার সন্তানদের বাঁচান। সুতরাং, দেবী দুর্গা সকল স্বার্থান্ধতা, অকল্যাণ, অবিদ্যার করাল গ্রাস থেকে মানবসমাজকে মুক্ত করতেই নেমে আসেন সবার মাঝে।
আমি বড় হয়েছি গ্রামে। আমার গ্রামের প্রায় অর্ধেক লোকই হিন্দু। সে হিসেবে ছোটবেলা থেকেই দেখেছি পুজোর দিনগুলোতে পুরোগ্রাম এক আনন্দ জলসায় রূপায়িত হতে। আমরা সকাল-বিকাল পড়ে থাকতাম ঠাকুরবাড়ি। পুজামণ্ডপে হতো নাচ,গান আর আড্ডাবাজি। হিন্দু-মুসলিম মিশে যেতাম সব ভেদাভেদ ভুলে। ঠাকুরবাড়ির আঁতুরঘর থেকে আসত জিলিপি,লাড্ডু,নারকেল ও ক্ষীরের ছাঁচে তৈরি সন্দেশ।আমরা মহানন্দে গোগ্রাসে সব গিলতাম। হিন্দুবাড়ির কোন লোক আমাদের অতিথি নারায়ণের মতোই আপ্যায়ণ করতেন। তারাও যখন আমাদের বাড়িতে যেতেন তখন আমরাও তাদের সাধ্যমত আপ্যায়ণ করতাম। আহা কি আনন্দময় দিন ছিল! এখন আমাদের গ্রামে আর পুজো তেমন হয়না। ঠাকুর বাড়ি ঢোল, কিংবা শঙ্খের নিনাদে নেচে উঠেনা। আমি শহরে বসে পুজোর দিন এলেই সেই স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা ভাবি। ভাবতে ভাবতে মনটা বিষণ্ন হয়ে উঠে। মনে বেজে উঠে—"দিনগুলি মোর সোনার খাচায় রইলো না, সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি!"