শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
ড. ইসলাম শফিক
প্রকাশিত: ০৪:৩৩ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২১ রোববার আপডেট: ০৫:৪৬ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২১ রোববার
কালিগঙ্গা নদীর জল কাঁদামাটিতে লুটোপুটি করে শৈশব-কৈশোর পার করেছেন আফছার উদ্দীন নামক এক দুরন্ত বালক। মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার উত্তর জামশা গ্রামের ঘাস, লতাপাতা, আলো-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি, কুয়াশা, বৃক্ষরাজি, মেঠোপথ, নদীর পলিমাটি, পুকুরের শ্যাওলা, ডোবাজল, ক্ষেতের আলপথ এই আফছার উদ্দীনকে বেশ আপন করে চেনে। কালিগঙ্গা বিধৌত উত্তর জামশা গ্রামের জোসনার নরম আলো, নিকষ অন্ধকারে জোনাকি আর ঝিঁঝিঁর আলো-শব্দের স্বর্গীয় সঙ্গীত দৃশ্যকাব্যের মঞ্চভূমিতে বিচরণ করে রচিত হয়েছে এই বালকের জীবননাট্য। একজন মৃত্তিকালগ্ন বালক আফছার উদ্দীন দীর্ঘ পথপরিক্রমায় হয়ে উঠেছেন দেশবরেণ্য শিল্পমেধা।
বাংলাদেশের শিক্ষা, শিল্পসাহিত্য, টিভি নাটক, থিয়েটার, পত্র-পত্রিকা, রেডিও- টেলিভিশন, লেখালেখি, গবেষণা, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলসহ সর্বত্র তিনি অধ্যাপক ড. আফসার আহমদ নামে সুপরিচিত। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আলী মাস্টার এবং মাতার নাম বেগম নুরন্নাহার। মা বেগম নুরন্নাহার বিরাশি বছর বয়সে সকলের মধ্যমণি হয়ে স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত করে সবাইকে ছায়া দিয়ে রেখেছেন। আফসার আহমদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার উত্তর জামশা গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হন উত্তর জামশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও সৃজনশীল একজন ছাত্র। শাহাদত আলী মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আফসার আহমদ ১৯৭৫ সালে বিজ্ঞান শাখায় কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৭৭ সালে ঢাকার দোহার নবাবগঞ্জ কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় সেরা ফলাফল করে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি।
বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও স্কুল-কলেজ জীবনে তিনি কবিতা ও গান লেখায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কবিগান, পালাগান, নাটক, যাত্রাপালা౼ এসব বাল্যকাল থেকে দেখে শুনে তাঁর কাব্যমন তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার ভর্তির প্রক্রিয়া, বিভাগ নির্বাচন প্রত্যেক তরুণ বয়সীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। জীবনের বাঁকবদলের এই কালে আফসার আহমদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যয়ন করার জন্য মনস্থির করেন। ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্তম আবর্তনের হয়ে বাংলা বিভাগে। এই বিভাগের শিক্ষার্থী হয়ে এসে তিনি সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন౼ অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, অধ্যাপক ড. আব্দুল কাইউম, অধ্যাপক মুহাম্মদ ফারুক, অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক আ ফ ম দানীউল হক, অধ্যাপক ড. সেলিম আল দীন, অধ্যাপক হায়াত মাহমুদ প্রমূখ প্রথিতযশা বরেণ্য পণ্ডিতজনদের।
১৯৮০ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক এবং ১৯৮১ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৮৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্যদিয়ে। পরবর্তীকালে অধ্যাপক সেলিম আল দীনের সঙ্গে অন্যতম সহযোগী হিসেবে অধ্যাপক আফসার আহমদ ১৯৮৬-৮৭ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম এর গবেষণা তত্ত্বাবধানে ‘মধ্যযুগের বাংলা আখ্যান কাব্যের আলোকে বাংলাদেশের নৃ-গোষ্ঠী নাট্য’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
আফসার আহমদ ছিলেন বহুগুণের সমন্বয়ে একজন সফল মানুষ। তিনি একাধারে অধ্যাপক, গবেষক, সম্পাদক, কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, গীতিকার, সুরকার, টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক, দক্ষ সংগঠক ও সুবক্তা। এসব কিছু ছাপিয়ে, তিনি ছিলেন একজন কোমল হৃদয়ের সদাহাস্য মিষ্টিমনের মানুষ। বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করে একটি সুস্থ জনসংস্কৃতি বিনির্মাণে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। শিক্ষকতায় পাশাপাশি জীবনের নানা বাঁকে নানাসময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রসাশনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে দুই মেয়াদে তিনি বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন, প্রক্টর, সিনেট-সিন্ডিকেটের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাহিত্য, নাটক, থিয়েটার নিয়ে কাজ করলেও তিনি চাইতেন শিল্পকলার অন্যান্য শাখাগুলোও একাডেমিক শিক্ষায় অন্তর্ভূক্ত হোক। সঙ্গীত, নৃত্যকলা ও চারুকলার প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ লক্ষ করা গছে। অধ্যাপক আফসার আহমদ এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চারুকলা বিভাগ। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে যাত্রা শুরু করা চারুকলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি।
২০১৩ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একাডেমিক শিক্ষার উন্নয়নের পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক সিলেবাস প্রণয়নে তিনি যুক্ত ছিলেন, রচনা করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই। ঢাকা থিয়েটার ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের তিনি উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম একজন সদস্য। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জুরি বোর্ড ও বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ড এর অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
ড. আফসার আহমদ এর প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র౼ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাহিত্য ও সংস্কৃতি, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাটক, সঙ্গীত ও অভিনয়, নাট্যনির্দেশনা, গ্রিক ভাষা ও নাটক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে- অন্ধকারের সাতটি তারা, মঞ্চের ট্রিলোজি ও অন্যান্য প্রবন্ধ, গাজীর গান : শিল্পরীতি, মধ্যযুগের বাংলা আখ্যান কাব্যের আলোকে বাংলাদেশের নৃ-গোষ্ঠী নাট্য, নাট্যকলা (১ম পত্র), নাট্যকলা (২য় পত্র), ওরেস্তেস, মীর মশাররফ হোসেন ও অন্যান্য প্রবন্ধ, বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠী নাট্য, নাটক সংগ্রহ (১ম খ-),সান্দবীর বারমাসী, মীমাংচিনা এসবের মধ্যে অন্যতম। মৌলিক লেখার পাশাপাশি তিনি নাটক করেছেন౼ ইউরিপিদেস এর ওরেস্তেস, হেনরিক ইবসেন এর লাভ’স কমেডি ।
প্রায় অর্ধ শতাধিক মঞ্চনাটক তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। তন্মধ্যে গবেষণাগারে তাঁর নির্দেশিত উল্লেখযোগ্য নাট্য প্রয়োজনাগুলো হলো౼ শকুন্তলা (১৯৮৭), ট্রোজান ওম্যান (১৯৯০), কৃষ্ণকুমারী (১৯৯১), মারমা ‘জ্যা’ আলংনাবাহ (১৯৯৫), মারমা ‘জ্যা’ মা চ ক্যান (১৯৯৬), বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণর্কীতন (১৯৯৭), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর রাজা (১৯৯৭), মনসার কথা (১৯৯৮), ময়মনসিংহ গীতিকা পালা অবলম্বনে কাজলরেখা (২০০০), চাকমা আখ্যান অবলম্বনে আধুনিক নাট্যনির্মাণ ‘গেংখুলী স্বপ্ন’ (২০০২), গবেষণাগার নাট্যপ্রযোজনা মীমাংচিনা (২০০৩), মালঞ্চ (২০০৪), নৃ- গোষ্ঠী নাট্য শোয়েমালা ওয়াই থু (২০০৫), চাঁদ ও চন্দ্রাবতী (২০০৭), স্বপ্নরমণীগণ (২০১২), শ্রীকৃষ্ণর্কীতন অবলম্বন ‘তৃতীয় রাধা’ (২০১৩), ঊষা-উৎসব (২০১৬), স্বপ্নরমণীগণ (২০১৭), ইউরিপিদিসের ‘ওরেস্তেস’(২০১৮), ঘুমকুমারী (২০১৯), চাকমা দুহিতা উপন্যাস অবলম্বনে নাটক জুম্মবী (২০২০) এসব তাঁর উল্লেখযোগ্য নাট্যপ্রয়োজনা।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর ৬২ তম জয়ন্তী, সবাই আনন্দ মুখরিত হয়ে দিনটিকে উৎসবে রূপান্তর করেছিল। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের একজন আপাদমস্তক শিল্পব্যাক্তিত্ব আকস্মিকভাবে চলে গেলেন অচিন দেশে, যে দেশ থেকে কেউ কোনোদিন ফেরে না, ফেরা যায় না; যিনি যান তিনি পেছনে রেখে যান তাঁর যাপিত জীবনাদর্শ ও কর্মমশালের আলো। উত্তর প্রজন্ম তা থেকে আলো গ্রহণ করে পথ চলে, দিশা খুঁজে পায়। নাট্যদিশারী অধ্যাপক আফসার আহমদ শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা, গবেষণা ও নাট্যজগতের জ্বাজল্যমান এক আলোক মশাল। অধ্যাপক আফসার আহমদ রচিত নাটক মীমাংচিনা নাটকের সংলাপে রয়েছে- ‘মৃতের শোক থাকে জমা জীবিতের বুকের গহীনে’। অধ্যাপক আফসার আহমদ আপনি বেঁচে থাকবেন সকলের অন্তরের মণিকোঠায়। আপনি আমাদের শোকস্রোতের নীলমণি।
ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক ও নির্মাতা।