প্রয়াণ দিবস
চেনা-অচেনার আবছায়ায় জীবনানন্দ দাশ
সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:০৩ পিএম, ২২ অক্টোবর ২০২০ বৃহস্পতিবার আপডেট: ০৩:২৬ পিএম, ২২ অক্টোবর ২০২০ বৃহস্পতিবার
ছবি সংগৃহিত
কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম-অবিরাম ভার
সহিবে না আর
সব যদি বাদও দেই তবুও বলাই যায় জীবনানন্দ দাশ আজও এক বিপন্ন বিস্ময়ের নাম। তিনি বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি, তিমির হননের কবি, তিনি কবি জীবনানন্দ দাশ। পৃথিবীতে যার আসা বেশিদিনের জন্যে নয়। বাংলার রূপের মুগ্ধতায় পৃথিবীর রূপ আর খুঁজতে চাননি এই নির্জনতার কবি। নানান আঙ্গিকে প্রকৃতি এবং জীবনের সৌন্দর্য্য-বিষন্নতা-হাহাকারের ছবি তিনি এঁকে গেছেন পরম মমতায়। আজ জীবনানন্দের মৃত্যুদিন, কবিকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়।
পারিবারিক উপাধি দাশগুপ্ত হলেও ব্রাক্ষ্ম সমাজের আলোয় দীক্ষিত কবি নিজেই একসময় গুপ্তকে বিদায় করে দেন। মা কুসুমকুমারী দাশের কবিতা ‘আদর্শ ছেলে’ যখন বাঙালি সমাজের শিশুশ্রেণির অন্যতম পাঠ্য, তারই সন্তান কালের ডাকে হয়ে উঠলেন ‘জীবনানন্দ দাশ’।
বরিশালের সত্যানন্দ দাশগুপ্তের ঘরে জীবনানন্দ জন্মেছিলেন। বাবা ছিলেন বরিশাল ব্রাক্ষ্ম সমাজের একজন কর্ণধার। ছিলেন সুবক্তা, সুলেখকও। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে শিক্ষক ও সাহিত্যপিপাসু মা বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান তিনি। ডাক নাম মিলু। বিদুষী স্বভাবকবি মা কুসুমকুমারীকে তিনি আদর্শজ্ঞান করতেন। মায়ের হাত ধরেই লেখালেখির জগতের চৌকাঠ পেরোন। মা মনে করতেন পারিবারিক শিক্ষার বুনিয়াদই মূল কথা। তাই ছেলেকে স্কুলে পাঠানো হয়েছিল কিছুটা দেরিতে। তাই বলে বাড়িতে লেখাপড়া থেমে থাকেনি। কবির দিন শুরু হতো বাবার উপনিষদ পাঠ আর মায়ের মুখের মিষ্টি গান-কবিতা শুনে শুনে।
১৯০৮ সালে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন কবি। সেখান থেকে ১৯১৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯১৭ তে ইন্টারমিডিয়েট কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ১৯১৯ সালে প্রাণের শহর ছেড়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি নেন। এরপর তিনি আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও তা শেষ করেননি।
কবির ৫৬ বসন্তের ছোট্ট এক টুকরো জীবন কেটেছে চরম দারিদ্র্য ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। পেশা মূলত শিক্ষকতা হলেও কর্মজীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে কোথাও থিতু হতে পারেননি। তিনি অধ্যাপনা করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। জীবিকার প্রয়োজনে কবিকে জীবনভর যুঝতে হয়েছে। চাকরি খুঁজতে চটির সুখতলি ক্ষুইয়েছেন। স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে দারুণভাবে আর্থিক এবং মানসিক সহযোগিতা জুগিয়েছেন কবিকে।
বরিশালের অবারিত প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা কবিকে যে নির্মলতা দিয়েছিল, পরবর্তীতে পরিপক্ক কবি জীবনে সেটির ছাপ দেখা দেয় প্রগাঢ়ভাবে। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’। বয়স তখন আঠাশ। ঝরা পালক কাব্যগ্রন্থের পর নামীদামি পত্রিকা যেমন ‘কল্লোল’, ‘কালি ও কলম’, ‘প্রগতি’সহ অন্যান্য পত্রিকায় জীবনানন্দের লেখা ছাপা হতে থাকে। ১৯৩১ এ তার ‘ক্যাম্প’ কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন কবি। অনেকে কবিতাটি অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন।
১৯৩৪ সালে তিনি একগুচ্ছ গীতিকবিতা রচনা করেন, যা তার ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের প্রধান অংশ। এই কবিতাগুলো জীবনানন্দ বেঁচে থাকা অবস্থায় প্রকাশ করেননি। ১৯৩৫ সালে তার সেই অমর ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ১৮ লাইনের কবিতাটি বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার অন্যতম। বেশ কয়েক বছর পর এটি স্থান পায় কবিতাগ্রন্থে। পরের বছর জীবনানন্দের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশিত হয়। এর পরের বছর রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতা সংকলন সম্পাদনা করেন, যার নাম ছিল ‘বাংলা কাব্যপরিচয়’ এবং এতে জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি স্থান পায়।
১৯৩৯ সালে কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয় আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হিরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়, যাতে জীবনানন্দের চারটি কবিতা-পাখিরা, শকুন, বনলতা সেন এবং নগ্ন নির্জন হাত অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের নজর কেড়েছিলেন জীবনানন্দ। আর বুদ্ধদেব ছিলেন জীবনানন্দের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং তার সম্পাদিত ‘কবিতা পত্রিকা’য় জীবনানন্দের অনেক কবিতা ছাপা হয়।
১৯৪৪ সালে তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘মহাপৃথিবী’ প্রকাশিত হয়। আগের তিনটি কাব্যগ্রন্থ তাকে নিজের পয়সায় প্রকাশ করতে হলেও প্রথমবারের মতো তিনি তার কবিতার বইয়ের জন্য প্রকাশক পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন প্রকাশিত এ কবিতগুলোতে যুদ্ধের প্রভাব দেখা যায়।
তারিখটা ছিল ১৪ অক্টোবর, ১৯৫৪ সাল। সেদিন কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় কবি জীবনানন্দ আহত হন। ট্রামের ক্যাচারে আটকে শরীর দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল। ভেঙে গিয়েছিল কণ্ঠ, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়। অনেক জীবনানন্দ গবেষক মনে করেন জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে অস্থির করে তুলেছিল প্রায়ই ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন, যে কথা তার কিছু লেখাতেও পাওয়া গেছে।
শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি জীবনানন্দের অবস্থা ক্রমশ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। যমে-মানুষে আট দিনের টানাটানির পর ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর রাতে হাসপাতালেই তার মৃত্যু হয়। গত ১০০ বছরে ট্রাম দুর্ঘটনায় কলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। আর সেই দুর্ঘটনার শিকার, কবি জীবনানন্দ দাশ।
জীবদ্দশায় অসাধারণ কবি হিসেবে পরিচিতি থাকলেও তিনি খ্যাতি অর্জন করে উঠতে পারেননি। এর জন্য তার প্রচারবিমুখতাও দায়ী। তিনি ছিলেন নিভৃতে থাকা মানুষ। জীবদ্দশায় তার একমাত্র পরিচয় ছিল কবি। অর্থের প্রয়োজনে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। তবে মৃত্যুর পরেই তিনি বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতার পথিকৃতদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পান। জীবনানন্দ দাশের জীবন এবং কবিতার উপর প্রচুর গ্রন্থ এখনো লেখা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
দারিদ্র্য এবং অনটনে ঘিরে থাকা জীবনে লেখা ছাপিয়ে অর্থ উপার্জনের সাধারন পথটিকে বেছে নিতে পারেননি তিনি সহজে। জীবনকে গ্রহণ করতে চাইতেন সহজ পাল্লায়, তাই আলাদা একটি স্বকীয় জগতের বলয় গড়ে তুলেছিলেন। শুধুই লিখে গেছেন জীবনভর, লেখায় নিজে খুঁড়েছেন, ভেঙেছেন, গড়েছেন। হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে চলতে চলতে ডুবে থাকতে চেয়েছেন নিজস্ব লেখকসত্তায়।
‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;
অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা;’