এমএলএম প্রতারণা থেমে নেই, চলছে নতুন কৌশলে
রাজিব শর্মা
প্রকাশিত: ১২:০৭ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার আপডেট: ১২:১৬ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার
থেমে নেই এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) ব্যবসার নামে প্রতারণা। অ্যানালগ পদ্ধতি থেকে উঠে এখন চলছে ডিজিটাল ভার্সনে। সেই নব্বই দশকের জিজিএন থেকে হালের গ্রেট ওয়ান, স্পিক এশিয়া, ইউনিগেটওয়ে, গোল্ডেন ট্রি, নিউওয়ে পর্যন্ত- একটাই লক্ষ্য, টাকা হাতিয়ে নেয়া।
বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যমে পড়ছে ডেসটিনি, ইউনি পে টু, আইসিএল, রেভনেক্স বিডির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এমএলএম-প্রতারকরা। বিভিন্ন কৌশলে তারা মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা। তবে এখন আর কোনো পণ্য বা বৃক্ষরোপন পরিকল্পনা বা বিক্রি নয় বরং রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, কখনো বা ট্যুর ও আবাসিক হোটেল সার্ভিসে বিনিয়োগের মাধ্যমে ৩ মাসে দ্বিগুণ অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তারা।
গাছের চারা বিক্রির স্থলে এখন অনেকে বিক্রি করছেন কাল্পনিক ট্যুর এবং আবাসিক হোটেল সার্ভিস। আবার অনেকেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করছে। করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্টান বন্ধ থাকাতেই, অনলাইনে শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে গেমস, বিভিন্ন কোর্স ও ভর্তির নামে বিভিন্ন সুযোগ দিয়ে ডিসকাউন্ট ও পারসেন্টিজ সুবিধার নামে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
বর্তমান খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ভুয়া ওয়েবসাইটধারী মার্কেটিং কোম্পানির সংখ্যা। অনেকেই একটি নির্দিষ্ট অর্থ জমা রাখলে বিনিময়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট অর্থ দিচ্ছে। এভাবে লোভে পড়ে মানুষ সর্বহারা হয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং বাংলাদেশ টেলিকমিউটিকেশন অ্যান্ড রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)-এর চোখে ধুলো দিয়ে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে এই এমএলএম কোম্পানিগুলো।
মালয়েশিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র কখনো বা যুক্তরাজ্য থেকে ডোমেইন, হোস্টিং ভাড়া নিয়ে চলছে অনলাইন এমএলএম। ভয়ংকর ‘মানি গেম’র মাধ্যমে গত চার বছরে গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পুরনো এমএলএম প্রতারকরাই এখন ধরন এবং নাম পাল্টে প্রতারণা অব্যাহত রেখেছে। বছর দুই আগেও তারা সেগুনবাগিচা, রমনা পার্ক, বিজয়নগর হোটেল ৭১, চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ, মুরাদপুর সংলগ্ন স্থানে গোপনে সভা-সেমিনার করত। এখন বেরিয়ে এসেছেন তা প্রকাশ্যে। প্রসিদ্ধ এই এমএলএম প্রতারকরা প্রতিষ্ঠা করেছেন সমিতি। ‘ডিরেক্ট সেলিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ডিস্যাব) নামে এ সমিতি প্রতিষ্ঠা হয় গাজীপুরে গত বছর অক্টোবরে। তাদের নামে দেশের আনাচে কানাচে রীতিমতো সমিতি খুলে চালিয়ে যাচ্ছে এমএলএম প্রতারণা।
অনুসন্ধান মতে, কথিত সংগঠন ‘ডিস্যাব’র নেতৃত্বে রয়েছেন ‘এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড’ নামক এমএলএম কোম্পানির প্রধান নির্বাহী আনোয়ার এইচ রয়েল রানা। ‘ডিস্যাব’ সূত্র জানা যায়, উক্ত সমিতিভুক্ত প্রতিটি সদস্যেরই রয়েছে এক বা একাধিক এমএলএম মালিকানা প্রতিষ্ঠান। ওয়েবসাইট খুলে তারা নির্বিঘ্নে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ওয়েবসাইটের রয়েছে গোপন এডমিন নাম ও পাসওয়ার্ড। শুধুমাত্র কথিত কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত হলেই ঐ পাসওয়ার্ড দেয়া হয়। একজন সাধারণ ব্যক্তি ইচ্ছে করলে তাদের নির্দেশনা অনলাইনে জানার সুযোগ নেই। সব কাজ হয় অনলাইনে গোপনীয়তায়।
‘ই-কামর্স লিমিটেড’ নামক ওয়েবসাইট খুলে এমএলএম কোম্পানি পরিচালনা করছেন এম আরিফ হাসান। এছাড়া অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত আব্দুল মালেক স্বাধীনের মালিকানায় রয়েছে ‘ওয়ালমার্ক এমএলএম লিমিটেড’ নামক এমএলএম নেটওয়ার্ক। ‘উইনলাইফ গ্লোবাল লিমিটেড’ পরিচালনা করছেন মো. মনিরুল ইসলাম কাইয়ুম। ‘ডেইলি বাজার লিমিটেড’ নামের এমএলএম চালাচ্ছেন আমিনুল ইসলাম হৃদয়। ‘পাওয়ার লাইফ বিডি’-এর কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রেজাউল লতিফ রিপন,’মেমোরি গ্লোবাল লিমিটেড’ চালাচ্ছেন আব্দুল মোমিন মিয়াজী ও দেলোয়ার হোসেন। এরকম আরও অন্তত ২০টি এমএলএম কোম্পানির নাম পাওয়া গেছে।
রাজধানীর মোতালেব প্লাজাসহ হাতিরপুলেই রয়েছে ৩০টির মতো এমএলএম কোম্পানির ব্যবসা কার্যালয়। পুরানা পল্টন এলাকার একটি গলিতেই রয়েছে ৪২টি এমএলএম কোম্পানির প্রধান অফিস। প্রতিটি জেলা শহরে তাদের পাঁচ-সাতটি করে সাব-অফিস রয়েছে এবং সমাজের উঁচুস্তরের মানুষকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে কার্যক্রমকে আরো শক্তিশালী করে বলে জানা গেছে।
চটকদার সাইনবোর্ড, আইডি, অফিস সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেই প্রতারিত হয় মানুষ। বহু মানুষ প্রতারিত হলেও প্রশাসন এ বিষয়ে নীরবতা পালন করছে। কখনও বা সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। উত্তরাভিত্তিক এমএলএম কোম্পানি ’ব্রাইট ফিউচার’ মানুষকে স্বল্প মূল্যে প্লট দেয়ার প্রলোভনে ৬ বছরে হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্যোক্তা সোহেল রানা নাম পাল্টিয়ে, একেক সময় একেক নামে এসে, একের পর এক গড়ে তুলেছেন এমএলএম কোম্পানি। তার প্রধান সহযোগী আলাউদ্দিন আহমেদও এমএলএম প্রতারণায় সুবিখ্যাত। সোহেল-আলাউদ্দিন এমএলএম চক্রটি সুন্দরী নারীদেরকে কাজে লাগিয়ে সারাদেশে বিস্তার করেছে প্রতারণার জাল।
এদিকে সহজ সরল মানুষ এমএলএম দ্বারা প্রতারিত হলেও কোনো দফতর থেকেই এর প্রতিকার পাচ্ছেন না। কথিত এসব ব্যবসায় কোনো ধরনের ডিড-ডকুমেন্ট না থাকায় প্রতারিতরা আইনের আশ্রয় নিতেও পারেন না। অনেক গৃহবধূ স্বামী কিংবা পরিবারের অজ্ঞাতে অর্থ বিনিয়োগ করে প্রতারিত হচ্ছেন। তারা প্রতারণার কথা কাউকে জানাতেও পারেন না। এ নিয়ে পরিবারে শুরু হয় গৃহ বিবাদ ও অশান্তি।
অব্যাহত এমএলএম প্রতারণা বিষয়ে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’-এর প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জানান, এমএলএম দ্বারা প্রতারিত হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে মানুষের অসচেতনতা ও লোভ। এসব প্রতারকদের টার্গেটই থাকে সহজ-সরল মানুষ। তারা প্রলোভনে পড়ে অর্থলগ্নি করে। পরে নিজেরায় প্রতারিত হয়। তিনি বলেন, এমএলএম রোধে কার্যকর আইন হওয়া খুবই জরুরি।