জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে বাংলাদেশে অস্থিরতা বাড়াতে পারে
অপরাজেয় বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৪৩ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার আপডেট: ০৪:৩৪ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার
সিডরের পর পরিষ্কার পানি সংগ্রহে কাঁদা মাটিতে হাটছেন সাতক্ষীরার এক নারী। ছবি-নিউইয়র্ক টাইমস
আগস্ট মাসে পৃথিবীর জলবায়ু বিষয়ে নিজেদের ষষ্ঠ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি)। যেখানে বর্তমান বিশ্বের করুণ চিত্র উঠে এসেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, যদি সব দেশের সরকার কার্বন নিঃসরণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয় তাহলে পৃথিবী সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতাবৃদ্ধি, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও আরও বিরূপ আবহাওয়ার মতো জলবায়ু সংকটের মুখোমুখি হবে।
রিপোর্টে প্রাপ্ত ফলাফলগুলো বাংলাদেশের জন্যও সমান প্রাসঙ্গিক। যেখানে অধিক জনসংখ্যা এবং দুর্বল অবকাঠামো মানুষকে আরও বেশি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির মুখে ফেলছে। এ বিষয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে ইউনাইটেড স্টেট ইন্সটিটিউট অব পিস-এ।
গত দুই দশক ধরে গ্লোবল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বিরূপ আবহাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থের তালিকায় সপ্তম স্থানে রেখেছে। সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ার কারণে দেশের উপকূলীয় এলাকা থেকে দেড় থেকে তিন কোটি মানুষ শহরের দিকে ছুটবে।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রায় ৯ কোটি মানুষ ‘উচ্চ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ’ অঞ্চলে বাস করে আর তারমধ্যে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকি’র অঞ্চলে বাস করে ৫ কোটি ৩০ লাখ মানুষ।
দারিদ্র আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতোমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক মানুষ উঁচূ ভূ-খণ্ডের দিকে ছুটছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। একই সাথে দুর্বল স্থানীয় প্রশাসন ও শহর ব্যবস্থাপনা এবং বিদ্যমান নৃ-তাত্বিক ও ধর্মীয় অস্থিরতা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিও নষ্ট করতে পারে।
অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন
বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার বড় অংশ জুড়ে আছে নগরায়ন। যদিও নাগরিকদের অনেক বড় অংশ এখনও মফস্বলে বাস করে তবে স্বাধীনতার পর থেকে শহরে জনসংখ্যা বাড়ছে।
বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। কিন্তু এত মানুষের বসবাসের শহরটি যথাযথ অবকাঠামো উন্নয়ন ও পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে গড়ে ওঠেনি, যা মানুষের দৈনিক সংগ্রাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে দারিদ্র কমে আসলে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে শহরাঞ্চলে অতি দারিদ্রের হার বাড়ছে এবং তা করোনা মহামারির আগেই।
এক জরিপে যুক্তরাষ্ট্র অনুমান করে ঢাকার প্রায় ৫ হাজার বস্তিতে চার লাখ মানুষ বসবাস করে যারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভালো বাসস্থানের অভাবে এই শহরে এসেছে। বস্তিগুলোর পানি, বাতাস এবং অনিরাপদ অবকাঠামো তাদের জীবন আরও ঝুঁকিতে ফেলছে।
এছাড়া জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে ঢাকায় বারবার বন্যা দেখা যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এমন বন্যা প্রতিনিয়ত দেখা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেহেতু অনেক এলাকা বন্যায় ডুবে যায় তাই সংক্রামক অনেক রোগও এখানে বৃদ্ধি পাবে।
তারচেয়ে শঙ্কার বিষয়, ঢাকার জীবনযাপনের যে খরচ তা দারিদ্র পরিবারে শিশুশ্রম, নারী পাচার এবং বাল্যবিবাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। যা পুরো দেশে একটি বড় সমস্যা। এ ধারা চলতে থাকলে সেটা আরও সাধারণ হয়ে উঠবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব
গ্রামীণ বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যালঘু বিরোধী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দেখে আসছে। প্রায়ই রাজনীতির সাথে যুক্ত বা "ভূমি দখল" কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, হেফাজতে ইসলামের ক্রমবর্ধমান সামাজিক প্রভাব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মনোভাবের উত্থানের ফলে আন্তঃধর্মীয় উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভুয়া সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের মাধ্যমে হিন্দু বিরোধী দাঙ্গার সংখ্যা় ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। ২০০৭ সালের পর থেকে ৪ হাজারের বেশি সাম্প্রদায়িক হামলা নথিভুক্ত করেছে একটি মানবাধিকার সংস্থা।
ধারণা করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে হিন্দু জনসংখ্যা বেশি। যেহেতু এই সম্প্রদায়গুলো বাস্তুচ্যুত হয়ে শহরের দিকে আসছে তাই কর্মসংস্থান এবং জমির জন্য পারস্পরিক প্রতিযোগিতা উত্তেজনা এবং সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
চরমপন্থীর উত্থান ও জলবায়ু পরিবর্তন
২০০০ সালের গোড়ার দিকে জলবায়ু পরিবর্তন রাজশাহী বিভাগ এবং আশেপাশের অঞ্চলে খরা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে বাড়িয়ে তুলেছিল, যা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং দেশের সবচেয়ে কুখ্যাত সন্ত্রাসী নেতা "বাংলা ভাই" এর উত্থানে ভূমিকা রাখে।
রাজশাহী অঞ্চল সাধারণ খরা প্রবণ। তারউপর শতাব্দির শুরুতে ভারতীয় সীমান্তে বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তন এবং তিস্তা বাঁধ শুষ্ক মৌসুম বাড়িয়েছে যা স্থানীয়দের খাদ্য নিরাপত্তা নষ্ট করে।
জেএমবি এবং বাংলা ভাই এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সমর্থক তৈরি করেছে। বাংলা ভাই একটি ছোট খেলাফত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল এবং জেএমবি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিল।
এই ঘটনাটি দেখায় যে কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন শাসনের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এদিকে দুর্নীতির কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর মানুষের আস্থা অনেক কমে গেছে। তারমধ্যে চাকরির অভাব পণ্যের দাম বৃদ্ধি মানুষকে আরও দারিদ্র করবে। আর দরিদ্রতা মানুষকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে ফেলতে পারে।
ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি
কয়েক দশক ধরে কাজ, স্বাস্থ্যসেবা এবং পর্যটনের জন্য ভারতীয় সীমান্তে বাংলাদেশীদের চলাচল সাধারণ হলেও, ক্রমবর্ধমান হিন্দু জাতীয়তাবাদ ভারতে মুসলিম বিরোধী মনোভাবকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক ভারতীয় পদক্ষেপ যেমন সিএএ এবং এনআরসি মুসলিম বিরোধী হিসেবে ধরা হয়। এবং এ নিয়ে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অপমানজনক বক্তৃতা বাংলাদেশে ভারত বিরোধী উত্তেজনা বাড়ি দিচ্ছে।
আগামী দিনে এনআরসি বাস্তবায়ন হলে দুই দেশের মধ্যে এই উত্তেজনা বাড়বে, যার প্রভাব বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশেই পড়বে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী
যদিও বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দিতে আগ্রহী তবে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন যে শরণার্থীরা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকবে। শরণার্থীর উপস্থিতি বন ধ্বংস, ভূগর্ভস্থ পানির হ্রাস এবং দূষণ সহ পরিবেশগত অবক্ষয় সৃষ্টি করেছে। এই প্রভাব বাংলাদেশীদের মধ্যে শরণার্থীবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।
তীব্র আবহাওয়া এবং সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি কেবল এই সমস্যাগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এই গত মাসে বন্যা এবং ভূমি ধসে ২১ হাজারের বেশি শরণার্থীকে বাস্তুচ্যুত করেছে এবং ৬ হাজারের বেশি আশ্রয়স্থল ধ্বংস করেছে। বাংলাদেশ সরকার আস্তে আস্তে হাজার হাজার শরণার্থীকে বাংলাদেশের উপকূলের ভাসানচরে স্থানান্তরিত করছে, যা বিশেষজ্ঞদের মতে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ভয়াবহ বন্যার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় পদক্ষেপ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে বাংলাদেশ সরকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, কিন্তু সেটা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। বাইডেন প্রশাসন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে জোর দিচ্ছে। আইপিসিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনের সাথে জড়িত নীতি নির্ধারকরা স্বীকার করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা যা মানবাধিকার, শাসন এবং সংঘাতের উপর স্বল্পমেয়াদী প্রভাব ফেলে।
আন্তর্জাতিক দাতা, আন্তর্জাতিক এনজিও এবং বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ স্টেকহোল্ডার এবং অন্যান্য অনুরূপভাবে দুর্বল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের মানবিক খরচ মোকাবেলার জন্য কর্মসূচী শুরু করা উচিত । চারটি উপায়ে সেটি করা যেতে পারে:
১. দ্বন্দ্ব সমাধান এবং সংলাপ:
অনেক জায়গায়, জলবায়ুর কারণে স্থানান্তরিত হওয়া মানুষজন বিচ্ছিন্ন ধর্মীয়, জাতিগত বিভেদ বাড়িয়ে দিতে পারে এমনকি তা সহিংসতায় রূপ নিতে পারে।
পারস্পরিক বোঝাপড়া, সংলাপ, সহনশীলতা এবং দ্বন্দ্ব সমাধানের জন্য পরিকল্পিত কর্মসূচি এই সমস্যাটি প্রশমিত করতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সরাসরি এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করতে পারে এবং তাদের উচিত দেশীয় এনজিও এবং স্থানীয় সরকারের দ্বন্দ্ব নিরসন কর্মসূচি তৈরি ও বাস্তবায়নের সক্ষমতা গড়ে তুলতে সাহায্য করা।
২. অবৈধ উপার্জন বন্ধে চাকরির সুযোগ তৈরি:
যেহেতু মফস্বল থেকে অনেকে শহরে আসছে ফলে তাদের কৃষি দক্ষতা এখানে খুব একটা কাজে আসে না। ফলে অনেকে প্রত্যাশিত চাকরি পায় না বা বেকার থাকে। যা শিশুশ্রম, নারী পাচার ও অন্য অপরাধ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া পারিবারিক ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’ বিবেচনায় অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়ার প্রবণতাও বাড়ে। তাই মানুষ বৈধ উপার্জন করতে পারে এমন পন্থা বের হলে অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।
৩. আইনের শাসন নিশ্চিত করা:
অপরাধ প্রবণতা বাড়তে থাকলে প্রয়োজন উপযুক্ত আইনের শাসন। তা নিশ্চিত করতে পারলে অপরাধ তো কমবেই সাথে মানুষ সরকারের উপর আস্থা পাবে এবং সহিংসতা কমে আসবে।
আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি:
আসন্ন দিনগুলোতে সীমান্তে অভিবাসী প্রবাহ অনিবার্য, যা সম্ভবত প্রতিবেশীদের মধ্যে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে। আঞ্চলিক সংস্থা এবং স্বতন্ত্র সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক ফোরাম এবং অভিবাসনের প্রভাব নিয়ে নিয়মিত আলোচনার করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের চাহিদা মেটাতে পারস্পরিক নীতি ও চুক্তির নিয়ে কাজ করা।