অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

অপরাহ্নের সামগীতি পর্ব-৫

ডিগজিয়ানির পুতুল, কার্বন ফুটপ্রিন্ট, সবুজ কুমড়ো আর দেয়ালে পেরেকের দাগগুলো

রিফাত ফাতিমা, সাউথবেন্ড, ইন্ডিয়ানা

প্রকাশিত: ০৯:৫২ এএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১ শুক্রবার   আপডেট: ০৬:০৪ পিএম, ২ অক্টোবর ২০২১ শনিবার

এবার একটু দেরি করে লিখছি। তাই অনেক কথা জমা পড়ে গেছে। গত ২০ জুলাই কোরবানীর ঈদ ছিল। আমার কেন যেনো মনে হচ্ছিল ২১ জুলাই ইদ হবে। ফলে আমি ছুটিও নেইনি, গ্রোসারিতেও যাওয়া হয়নি। আগের রাত বারোটায় নিশাত ফোনে জানাল আব্বুর ও রাফিফের করোনা হয়েছিল। সারারাত আমি ঘুমুতে পারিনি। আব্বু খুব ভয় পেয়ে গেছেন। সকালে কথা বললাম, অসম্ভব ম্রিয়মান গলা। আমার কিছুই ভালো লাগছিল না। সকালে হুড়মুড় করে স্কুলে গেলাম, দুপুরে স্কুলের পোশাকেই সাজ্জাদ ভাই ও সাবরিনা ভাবির বাসায় দাওয়াতে ছুটলাম। অনেক ক্লান্তি সত্ত্বেও ওনাদের আতিথেয়তায় সাময়িকভাবে সব মনখারাপ ভুলে গিয়েছিলাম। আর রাতের পটলাক ডিনার ছিল তানিয়া ভাবী ও শাকিল ভাইয়ের বাসায়। আমাদের কম্যুনিটির সবার উপস্থিতি ও হাসি গল্পে ততক্ষণে মনের ভার অনেকটাই কমে গেল।

ফাহমিদ আগষ্টের প্রথমে আপষ্টেট নিউইয়র্কে গিয়ে তার নতুন কর্মস্থল বার্ড কলেজে যোগদান করে এল। তার আগে দফায় দফায় বিদায়ী দাওয়াত খেলাম। আমাদের ও সবুজ-দীপি দম্পতিকে বিদায়ী সম্বর্ধনা দেওয়া হল, খুব খুব মন খারাপ লাগছিল সবার জন্য কিন্ত কিছু করার নেই।দীপি কেঁদে ভাসাল। ওরা গেল নেভাদা। আমি জবের কারনে আপাতত রয়ে গেলাম এখানে, কিছুদিন পর চলে যাব তল্পি তল্পা গুছিয়ে।

আমার বন্ধু জানসি এক সপ্তাহ আগে চলে গেছে ইলিনয়ে। সোনম- স্বপ্নীল দম্পতি এখানে আরো বছর খানেক থাকবে। স্কুলে লাঞ্চে জানসিকে অনেক মিস করি। উচ্চ হাসি আর ক্রমাগত কথা বলার জন্য প্রায়ই আমি ওকে বকুনি দিতাম। এখন লাঞ্চ করি, কেউ আমাকে জ্বালাতন করে না। এমি ও মায়িশা খুব শান্ত। তাই লাঞ্চগুলো নিষ্প্রভ হয়ে থাকে। 

অনেক গরম পড়ার পর আজ দু’দিন তাপমাত্রা একটু সহনীয়। একা একা হাঁটি, একটা টিউলিপ পপলার গাছে এখনো কুঁড়ি, কবে ফুটবে কে জানে। তিনটে ঘুঘু রাস্তার শেষ মাথার বৈদ্যুতিক ল্যাম্প পোস্টের উপর বৈকালিক আড্ডায় মেতেছে। এখানকার রাস্তার শেষ মাথার পিন ওকের বীজগুলো বেশ পরিণত হয়েছে। আর রাস্তার ওইপাশে যে বিশাল দুটো ইস্টার্ন কটন উড, জ্যাক পাইন, জাপানিজ পাইন আর সিলভার ম্যাপল মিলেমিশে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের পাতারাও প্রগাঢ় সবুজ থেকে কালচে সবুজ  হয়েছে। পাইনের কোন হয়েছে পরিণত। হাঁটা শেষ করে বাসায় ফিরব, হঠাৎ পিছন থেকে ডাক। ঘুরে দেখি হাসিখুশি ছোট এক আফ্রো আমেরিকান বালিকা। তার দাবি আমাকে এখন তার সাথে খেলা করতে হবে। নাম জানাল ‘ডিগজায়ানি’, সেই সাথে তার হাতে ধরা পুতুলগুলোর নাম জানাতেও ভুললো না। একটি স্নো, আরেকজন স্কাই। দু’মিনিটের মাথায় পুতুলের নামও বদলে গেল। দুরে ছুড়ে ফেলে আমাকে হুকুম করল তাদের তুলে আনতে। এখন ওদের নাম ফরেষ্ট আর বার্ড। ডিগজায়ানির সাথে খানিকক্ষণ পাশাপাশি দোলনায় দোল খেয়ে আমরা যার যার ঘরে ফিরলাম।

দু’দিন জ্বরে ভুগে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলাম, জাফরিন, উর্মি আর তানিয়া ভাবী পালা করে খোঁজ খবর নিয়েছে, ফল-মূল, স্যূপ খাইয়ে গেছে, দিয়ে গেছে। সুস্থ হয়ে দেখি আমার ঘরে এবং বাইরে পরার সমস্ত সোয়েটার, জ্যাকেট ফাহমিদ ভুল করে নিয়ে গেছে। ঘরে সকাল সন্ধ্যায় আমার বেশ শীত লাগে। আবার সোয়েটার কিনতে হল। কাল সকালে ঘুম ভেঙে দেখি বাসার পেছনের নরওয়ে ম্যাপল ট্রির পাতার ফাঁকে ফাঁকে সকাল বেলার রোদ্দুরের আভা, কি শান্ত একটা সকাল যা কেবলি আমার। কোন তাড়া নেই, হানি বি গুলো আমার চার পাঁচটা টবের ফুলে ফলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বহুদূরের এপার থেকে আমি বাংলাদেশের কার্তিক অগ্রহায়নের গন্ধ পাই। ঘাসের উপর শিশিরের কণা, সীম গাছের তরুণ কোমল ডগা লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে, মটরশুঁটির ক্ষেতে মনে হয় আরো কিছুদিন পর নরম নীল রংয়ের ফুল আসবে। এতদিনে সবুজ কাঁচা মিষ্টি কুমড়ো বাজারে উঠে গেছে, কে জানে। আমি আকুল হয়ে ইন্ডিয়ানার বাতাসে অগ্রহায়নের সুবাস টেনে নিতে থাকি।

তাহিয়া, মন্ময় খুব গোছানো হয়েছে আজকাল। ফাহমিদ তো তাই-ই বলে। ওরা যাবার আগের দিন স্কুলে আমার সাথে দেখা করে গিয়েছে। সেদিন ঘরে ফিরে দেখি শূন্য ঘর। আমার শিশুদের কলরব নেই, দেওয়ালে তাহিয়ার ত্রিকোণমিতির সূত্র, ভোকাবুলারির তালিকা, পেরিওডিক টেবিল অব এলিমেন্টস লটকানো। মেঝেতে পড়ে আছে একটা উল্টানো গহনার বক্স, জিআর ই বুক, আই ক্যান্ডি কুইল্টসের ডিজাইন বুক আর পুরনো ফাইলপত্রে ঠাসা এলসা ও আনার ছবি সম্বলিত বড়সড় গিফট ব্যাগ। মন্ময়ের কাবার্ডে ওর দু/একটা শার্ট, জ্যাকেট আর স্কুলের আইডি কার্ড। ওর ছোট পড়ার টেবিলটায় সফোমোর ইয়ারের এ্যালজেব্রা ও ইংলিশ রেগুলারের খাতা। আমি অবসরে নেড়েচেড়ে দেখি। 

আমার সন্তানদের এখন ডানা মেলে উড়বার সময়। আমি কেবল তাদের পরামর্শ দিতে পারি, কোন কিছু নিয়ে জোর করতে পারি না। ওরা পৃথিবীতে নিজের ইচ্ছায় আসে নি। আমাদের মাধ্যমে এসেছে কেবল। ওদের জীবন, সিদ্ধান্ত একান্তই নিজস্ব। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি সারাজীবন আমার সন্তানদের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাব, সম্মান করব। সেবার আলাবামা থেকে বেড়িয়ে ফেরার পথে তাহিয়া বলছিল-
- "আম্মু তোমরা কেন এই ভুলটা করলে?’’
- ‘‘কি ভুল মা?’’ ‘
- "এই যে আমাদেরকে পৃথিবীতে এনেছ! জান, এর ফলে পৃথিবীতে কার্বন ফুট প্রিন্ট বেড়ে গেছে?’’

মন্ময়ও বোনের সাথে মাথা নাড়ল। আমি খানিকক্ষণ হা করে রইলাম। তারপর বললাম, ‘‘তোমরা বুঝবে না, দুটো টুলটুলে খোকাখুকু না থাকলে আমার কিছুই ভালো লাগত না।’’ দুষ্টুরা আমাকে হতাশ করে বলল, ‘‘আমরা পৃথিবীর কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়াব না। তোমরা নাতি নাতনি দেখবে না।’’

আমার অতি আদরের কাজিন আদিতের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। দূরে থাকার এই কষ্ট। পারিবারিক আনন্দ উৎসব থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়।আমার বিয়ের পরদিন যখন আমি রাজশাহী চলে যাব, আদিত খুব ছোট, বছর পাঁচেক হবে বয়স, দমাদম বাসে লাথি ঘুষি মারছিল, তার রিপা আপুকে কিছুতেই সে রাজশাহী নিয়ে যেতে দেবে না। সেই আদিত এখন সংসারী হবে, কি আনন্দ! আমি আদিতের সাথে কথা খুব কম বলি এখন, কারন ওর সাথে কথা বলার পরপরই আমার এক দৌড়ে দেশে চলে যেতে ইচ্ছে করে।

আমাদের তিনদিনে লং হলিডের দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায় প্রতিবেশী ব্যান্ডির বাসায় দুপিস পিজ্জা নিয়ে গেলাম। রামি আমাকে চেনে তাও চেঁচামেচি শুরু করে দিল। ব্যান্ডি দুঃখিত গলায় বলল, ‘‘সরি! ও খুব মিন!’’ তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, ‘‘আমার কোন বান্ধবী এলে ও সহ্য করতে পারে না। এখন যদি কোন মেল আসত ও শান্ত থাকত।’’ ব্যান্ডির দাদা আমেরিকান, দাদী জার্মান। দাদীর দেওয়া বহু পুরনো বাইবেল দেখিয়ে আমাকে বলল, ‘‘আমি এটা পড়ি মাঝে মাঝে। কিন্ত আমি কোন ধর্ম মানি না। আমার কাছে এই বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয় যে, কোন পুরুষ মানুষের সাহচর্য ছাড়া মেরী কিভাবে মা হলেন? জান, আমার মা আস্তিক। তাই আমার দাদী শৈশবেই আমাকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন।’’


বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। দশমিনিট হাঁটার পর দেখি আমি আর হাঁটতে পারি না। এত ক্লান্তি জমে ছিল আমার শরীরে? ট্রেভার্স সার্কেলের লাগোয়া লেকে পনেরো কুড়িটা হাঁস কেবলি ভেসে আছে, ঝলমলে সূর্যালোকে লেকের পানির কি চোখ ঝলসানো নীল সৌন্দর্য! অনেককাল সেন্ট ম্যারিজ লেকের ধারে যাওয়া হয়না। লেকের লাগোয়া এ্যাশ ঝোপের ফলগুলো নিশ্চয় এতদিনে পেকে টুকটুকে লাল হয়ে গেছে। আর ব্ল্যাক ওয়ালনাটগুলো নিশ্চয় আরো পরিপক্ক হয়েছে, বুনোফুলেরা ঝরে গিয়েছে। আগের মতই গ্রোটোর সামনে হয়ত শিক্ষার্থীরা সান্ধ্য পার্থণা করে। আমি বিকেলের সবটুকু রোদ আদন্ত্য জড়িয়ে সটান হেঁটে ঘরে ফিরি। ঘরের এক পাশের দেওয়ালে অনেকগুলো পেরেকের গর্ত। মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে বিস্মৃতি- বিভ্রমে গত জীবনের সবকিছু কোন কোন সময় ধূসর দেখে। তার অস্তিত্ব হয়ে পড়ে ওই সাদা দেওয়ালের অতি ক্ষুদ্র পেরেকের দাগের মত। যখন সে পৃথিবীর সব দেনা চুকিয়ে চলে যায়, ধীরে ধীরে সবার কাছে সে পেরেকের দাগও বুঝি মিলিয়ে যায়।  চলবে

রিফাত ফাতিমা
৬ সেপ্টেম্বর, ২0২১। সাউথবেন্ড, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র

অপরাহ্নের সামগীতি: পর্ব-চার: ফিফির টাইগার ইনস্টিঙ্কট, জাভার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আর বাবার টুপি