বাংলার আপেলখ্যাত
টসটসে পেয়ারায় ভরে গেছে পটিয়া-চন্দনাইশের পাহাড়
রিপোর্ট ও ছবি: কমল দাশ
প্রকাশিত: ০৫:৪৮ পিএম, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ রোববার আপডেট: ০৬:২৪ পিএম, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ রোববার
এখন পেয়ারার মওসুম। ভোর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া থেকে চন্দনাইশের অন্তত সাত জায়গায় বসে পেয়ারার হাট। এসব হাটে গোল আকৃতির ডাসা ডাসা সবুজ-হলুদ রঙের পেয়ারা আকর্ষণ করবেই। আর কোথাকার পেয়ারা? জিজ্ঞেস করলে যে কেউ উত্তর আসবে, চন্দনাইশ, কাঞ্চননগর।
সারাদেশে নামকরা পটিয়া-চন্দনাইশের পেয়ারা। মিষ্টি বেশি, বিচি তুলনামূলক কম। পাকলে ভেতরে কোনোটি সাদাটে, কোনোটি হলদেটে, কোনোটি লালচে। পটিয়া-চন্দনাইশের পেয়ারার সমাদর শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও রয়েছে সুস্বাদু এই ফলটির কদর।
পটিয়া-চন্দনাইশের পেয়ারা স্থান করে নিয়েছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের শিল্পীদের মুখেও।
পাশাপাশি দুই উপজেলা পটিয়া ও চন্দনাইশের পাহাড়জুড়ে শুধু পেয়ারা আর পেয়ারা। ডাসা ডাসা পেয়ারগুলো দেখেই মন খুশিতে ভরে উঠবে। কিন্তু পেয়ারা চাষীরা কি খুশি হতে পারেন?
না পারেন না। কারণ, প্রতিদিন শত শত টন পেয়ারা উৎপাদন করার পরও আরও অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ পেয়ারা বাগানেই নষ্ট হচ্ছে শুধুমাত্র হিমাগারের অভাবে। এ নিয়ে স্থানীয় পেয়ারা চাষীদের মাঝে রয়েছে হতাশা। বিশেষ করে পটিয়ায় এবার পেয়ারার বাম্পার ফলন হলেও সংরক্ষণের জন্য কোনো হিমাগার না থাকায় বাগানেই বেশিরভাগ পেয়ারা নষ্ট হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ের পেয়ারাগুলো সংরক্ষণ বা পেয়ারানির্ভর ‘জুস ইন্ডাস্ট্রি’ গড়ে তোলা যায়, তাহলে এ অঞ্চলের পেয়ারাচাষীদের ভাগ্য বদলাতে সময় লাগবে না।
পটিয়া ও চন্দনাইশে উৎপাদিত পেয়ারা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ, স্বাদেও অনন্য। কেলিশহরের কাজী পেয়ারা ও কাঞ্চননগরের পেয়ারায় এখন বাজার ছেয়ে গেছে। এই পেয়ারা একটানা পাওয়া যাবে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত।
পেয়ারা চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবার পটিয়ায় পেয়ারার বাম্পার ফলন হয়েছে। টানা বৃষ্টি আর আবহাওয়া বৈরী না হলে তারা অনেক লাভবান হবেন।
বৃষ্টিকেই ভয় বেশি চাষীদের। বিশেষ করে যারা আগাম লাখ লাখ টাকা দাদন নিয়ে বাগান কিনেছেন, তাদের মধ্যেই ভয়টা বেশি। কখন কী হবে? গহীন জঙ্গল থেকে পেয়ারা বাজার পর্যন্ত আনতে প্রতি ‘ভারে’ শ্রমিকদের খরচ দিতে হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এসব খরচ মিটিয়েও প্রকৃতি অনুকূলে থাকলে চাষীরা লাভবান হবেন বলেই আশা তাদের।
চাষীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সরকারিভাবে এ এলাকার উৎপাদিত পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য হিমাগার থাকলে তারা আরও অনেক বেশি লাভবান হতেন। পুরো বছরজুড়ে সেই পেয়ারা সংরক্ষণ করে বাজারে বিক্রি করা যেতো।
পেয়ারা চাষীরা জানান, দেশে দুই জাতের পেয়ারা রয়েছে। একটি কাজী পেয়ারা আর অন্যটি কাঞ্চননগরী পেয়ারা। কাজী পেয়ারা আকারে বড় হলেও স্বাদ একটু কম। অন্যদিকে কাঞ্চননগরী পেয়ারার আকার ছোট হলেও স্বাদ ও পুষ্টিতে ভরপুর। চট্টগ্রামের পটিয়া ও চন্দনাইশের কাঞ্চননগর এলাকা এই পেয়ারার মূল উৎপাদনস্থল।
পটিয়া কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, পটিয়ার গহীন অরণ্যে দুই থেকে তিনশত পেয়ারার বাগান গড়ে উঠেছে। এছাড়া পাশ্ববর্তী চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও বাঁশখালীতে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। এখানকার চাষীদের অনেকেই পেয়ারা চাষ করে ঘুচিয়েছেন বেকারত্বের অভিশাপ।
পেয়ারার পাইকারি ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন জানান, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রয়েছে পটিয়ার পেয়ারার কদর। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ আরো কয়েকটি দেশে পেয়ারা রপ্তানি হচ্ছে।
পেয়ারা চাষীদের রয়েছে বেশ কিছু সমস্যাও। পেয়ারা বিক্রির জন্য কোন নির্দিষ্ট স্থান নেই। নেই পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য সুব্যবস্থাও। এছাড়াও পেয়ারা চাষীরা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নামমাত্র মূল্যে আগাম সুবিধাভোগীদের কাছে পেয়ারা বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এতে অনেক চাষীই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পেয়ারার হাট বসে চন্দনাইশের রৌশন হাটে। সম্প্রতি এই হাটে গেলে চোখে পড়ে, মহাসড়কের দুপাশজুড়ে লাল কাপড় বাঁধা পেয়ারার সারি সারি ভার নিয়ে বসে আছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, প্রতিদিন পাঁচ শ ভাঁড় পেয়ারা বিক্রি হয় বাজারে। এখানকার পেয়ারা চট্টগ্রাম নগর, কক্সবাজার, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফ, হাটহাজারী, বাঁশখালী, লোহাগাড়া, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যবসায়ীরা নিয়ে যান।
পটিয়ার পাহাড়ি এলাকার হাইদগাঁও, কচুয়াই, খরনা এবং চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চননগর থেকে দোহাজারী এলাকার কাঞ্চননগর, হাসিমপুর ও জামিজুরী ইউনিয়নের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষের পেয়ারাবাগান রয়েছে। পেয়ারাই তাঁদের আয়ের প্রধান উৎস।
জনশ্রুতি আছে, ১৮৫০ সালের দিকে পটিয়ার কচুয়াই চা–বাগানের মালিক হেগিন্স লন্ডন থেকে প্রথমে আনারস, পরে পেয়ারা ও লিচু বীজ এনে তাঁর বাংলোর আশপাশে রোপণ করেন। পরে ওই বীজ থেকে চারদিকে বাগান ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়ভাবে পেয়ারাকে কেউ ‘গয়াম’, কেউ ‘গোয়াছি’ বলে।