৫০০ ভোল্টের ইলেকট্রিক মাছ
শেখ আনোয়ার
প্রকাশিত: ১২:৫৭ পিএম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ শুক্রবার আপডেট: ০১:২৯ পিএম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ শুক্রবার
ইলেকট্রিক অনেক কিছুরই তো নাম আমরা জানি। কিন্তু ইলেকট্রিক মাছ? তবে কৃত্রিম ইলেকট্রিক অ্যাকোয়ারিয়ামের ইলেকট্রিক মাছের কথা বলছি না। সত্যি সত্যি পানিতে ইলেকট্রিক মাছ রয়েছে। এসব মাছের শরীরে ইলেকট্রিসিটি থাকে বলে মাছের এমন নামকরণ হয়েছে। পানির মধ্যে থাকলে কি হবে? কোন কোন ইলেকট্রিক মাছ তিন’শ থেকে পাঁচ’শ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহন করে। যা কিনা একজন মানুষের অনায়াসে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। শুধু কি তাই? আট ফুট দূর থেকেও বিদ্যুতায়িত করে মেরে ফেলতে পারে মানুষ বা সাগরের অন্য প্রাণী। গবেষকরা বলেন, ‘পুরুষ ইলেকট্রিক মাছ স্ত্রী ইলেকট্রিক মাছকে এই বিদ্যুৎ তরঙ্গের সাহায্যে সংগীত শোনায়। রেগে গেলে এসব ইলেকট্রিক মাছ অবিরাম ঘন্টার পর ঘন্টা এক নাগাড়ে অনেক সময় ধরে বিদ্যুৎ নিঃসরণ করতে পারে।’
বিজ্ঞানীরা জানান, ইলেকট্রিক মাছ তার শরীরে ব্যাটারির মত বিদ্যুৎ জমা করে রাখে। এসব মাছের শরীরের অ্যাক্সন নামের অর্গ্যান মাংসপেশী আর কোষ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সমন্বয় ও সংরক্ষণের কাজ করে। পানির নীচে ইলেকট্রিক মাছ নিজস্ব উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বিদ্যুতের শক দিয়ে পানিতে বসবাসকারী প্রাণী শিকার করে খায়। মাছের নিজের শরীরের উৎপাদিত এই ইলেকট্রিসিটি শত্রæর ঢাল হিসেবেও ব্যবহার করে। এছাড়াও যোগাযোগ রক্ষার কাজে ব্যবহার করে এই বিদ্যুৎ তরঙ্গ। পুরুষ মাছ মেয়ে মাছকে আকর্ষণ করতে বিদ্যুৎ তরঙ্গ সংকেত কাজে লাগায়। সাগরে এরকম অনেক ধরণের ইলেকট্রিক মাছ রয়েছে। যেমন- ইলেকট্রিক লেজার রে ফিশ, ক্যাট ফিশ, এলিফ্যান্ট ফিশ, আফ্রিকান নাইফ ফিশ, ন্যাকেড ব্যাক নাইফ ফিশ, ঘোষ্ট নাইফ, গ্লা নাইফ ফিশ, ব্লান্ট নোস নাইফ ফিশ, সেন্ড নাইফ ফিশ ইত্যাদি নাম। সাগরের সবচেয়ে কম ভোল্টেজের বিদ্যুৎ উৎপাদন করে হাঙ্গর। হাঙ্গরের বিদ্যুতের ভোল্ট হচ্ছে ০.০১ মাইক্রোভোল্ট।
সাগরের পানিতে বিচিত্র রং ও বর্ণের ইলেকট্রিক মাছ দেখা যায়। কোনটির রং সবুজ, কোনটি নীল, কোনটি ধুসর, কোনটি শুধু লালের মিশ্রণ কোনটি আবার কাঁচের মত স্বচ্ছ। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এসব মাছ ইচ্ছে করলেই বৈদ্যুতিক পাওয়ার, এসি-ডিসি করতে পারে। অর্থাৎ একটি ট্রান্সফরমারের কাজও করতে পারে ইলেকট্রিক মাছ। মিসরে ইলেকট্রিক ক্যাট ফিশ নামে বিড়াল মাছ নীল নদের অববাহিকায় দেখা যায়। এছাড়াও এই মাছটি পাওয়া যায় দক্ষিণ আফ্রিকার মিষ্টি পানির হ্রদে। গভীর পানির চেয়ে অগভীর পানিতেই থাকতে বেশি পছন্দ করে বিড়াল মাছ। এসব মাছ বেশি পাওয়া যায় আন্দিজ পর্বতের পূর্ব পাশে আমাজান নদীতে। এছাড়াও ব্রাজিল, গিয়ানা ইত্যাদি স্থানেও এই ইলেকট্রিক মাছ ক্যাট ফিশ সব সময়ই চোখে পড়ে। ইলেকট্রিক মাছ ক্যাটফিশ বা বিড়াল মাছ- যাই বলা হোক। মাছটি দেখতে আমাদের দেশের বড় মাগুর মাছের মতো হলেও এই মাছটি একটু বেশি গাঢ় বাদামী রঙের হয়ে থাকে। এছাড়া লাং ফিশ নামে এক প্রকার ইলেকট্রিক মাছ রয়েছে সাগরে। এরা প্রায় ৫ শ’ ভোল্টের বিদ্যুৎ তৈরি করে।
ইলেকট্রিক ইল মাছের বৈজ্ঞানিক নাম ইলেকট্রোফোরাস ইলেকট্রিকাস। একেকটি মাছ ২.৫ ভোল্ট বিদ্যুৎ নিঃসরণ করতে পারে। মাছটি খুব বেশি লম্বা হয়ে থাকে। সাধারণত তিনফুট লম্বা হলেও অনেক সময় সাড়ে সাত ফুট পর্যন্ত এই মাছ দেখা যায়। মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত ফিতার মত ডানা থাকে। মুখটা সরু, নলাকার। আমাদের দেশের বাইন মাছের মত দেখতে। খুব ধীরে চলাফেরা করে এই মাছ। এদের শরীরের পাঁচ ভাগের চার ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চয় কাজে ব্যবহার করে। সামনের দিকে মাছটির হৃদপিন্ড, পাকস্থলি এসব থাকে। বাকি অংশে তিন হাজার ভোল্ট ব্যাটারীর ক্ষমতাসম্পন্ন ইলেকট্রিসিটি উৎপাদন ফ্যাক্টরি থাকে। এই ইলেকট্রিসিটি যে কোন মানুষকে তাৎক্ষণিকভাবে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট।
দক্ষিণ আমেরিকায় ইলেকট্রিক ইল মাছ এতোটাই ভয়ানক যে এই মাছ ৮.২ ফুট দূর থেকে বিদ্যুৎ তরঙ্গের সাহায্যে মেরে ফেলতে পারে যে কোন অতিকায় শিকার বা শত্রæকে। একটি পরিণত ইলেকট্রিক ইল মাছের ওজন হয় প্রায় ২০ কেজি। দক্ষিণ আমেরিকায় আমাজনের জঙ্গলের অরনিকো উপত্যাকায় এই মাছ বেশি দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা ইল মাছ দেহ ব্যবচ্ছেদ করে পরীক্ষা-নীরিক্ষা গবেষণা করে জানিয়েছেন- ইলেকট্রিক ইল মাছের পেটে রয়েছে তিন জোরা ইলেক্ট্রিক অঙ্গ। এগুলোর নাম- হান্টার অঙ্গ, প্রধান অঙ্গ এবং স্যাচেস। শরীরের মধ্য ভাগের অর্ধেক এবং লেজের ঠিক আগ পর্যন্ত এগুলো বিস্তৃত থাকে। এগুলো ৬২ টি কলামে দু’ হাজার থেকে ছয় হাজার পরিমাণ ইলেকট্রিক প্লেট দ্বারা তৈরি। বড় মাছগুলোর ইলেক্ট্রিক শক পাঁচশত ভোল্টের হয়ে থাকে। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ একটি ঘোড়াকে তাৎক্ষনিক মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। আর এর অর্ধেক পরিমাণ বিদ্যুৎ হলেই মানুষ মারা যায়।
গ্লাস নাইফ ফিশ দেখতে কাঁচের মত স্বচ্ছ ও সুন্দর হলে কি হবে। এই মাছও বিপদজনক ইলেকট্রিসিটি উৎপাদন করে। এই নামের ইলেকট্রিক মাছ ৪১ প্রজাতির হয়ে থাকে। এদের খাবার হলো পানিতে থাকা কীট-পতঙ্গ, লার্ভা, মাছ ও সামুদ্রিক প্লাংকটন। ন্যাকেট ব্যাক নাইফ নামের আরেকটি ইলেকট্রিক মাছ বত্রিশ প্রজাতির হয়ে থাকে। এই মাছের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এরা সম্পাহে একদিন মাত্র ইলেকট্রিসিটি উৎপাদন করে। দক্ষিণ মেক্সিকো থেকে উত্তর আর্জেন্টিনায় সব রকম পানিতে বসবাস করে এই ইলেকট্রিক মাছ।
দক্ষিণ আমেরিকার আদী বাসিন্দারা এসব ইলেকট্রিক মাছ দিয়ে বাত রোগের চিবিৎসা করে থাকে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় এই ইলেকট্রিক মাছ ব্যবহার করে থাকেন। দু’শ বছর আগে এসব মাছের ইলেকট্রিক ডিসচার্জ দেখেই কৃত্রিম ইলেকট্রিক অর্গান ও ব্যাটারি আবিষ্কার করেছিলেন বিজ্ঞানী ভোলটা। প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যেও এই ইলেকট্রিক মাছের কথা উল্লেখ রয়েছে। আজও এসব ইলেকট্রিক মাছ নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহল ও গবেষণার শেষ নেই। বিজ্ঞানীদের ধারণা, একদিন এসব ইলেকট্রিক মাছ জটিল চিকিৎসায় কাজে লাগবে। হয়তো মানব সভ্যতাকে আরও বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে এসব ইলেকট্রিক মাছ।
শেখ আনোয়ার: লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।