আস্থার সঙ্কট সফল রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিবন্ধক
কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ১০:২৬ পিএম, ২৮ আগস্ট ২০২১ শনিবার আপডেট: ০৩:৫৭ পিএম, ২৯ আগস্ট ২০২১ রোববার
ঝুমন দাশ, পরীমণি, মুনিয়া, বরিশালকাণ্ড, সিকদার ভ্রাতৃদ্বয়- সময়ের বহুল আলোচিত ঘটনা। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া একেক রকম; বলছি ব্যক্তিগত নয়, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ার কথাটাই। সবগুলো ঘটনাই আইনি পথে গেছে, তবে ‘আইন সকলের জন্যেই সমান’ আপ্তবাক্যের যথাযথ প্রয়োগ হয়েছে বলে মনে হয়নি। বরং একদিকে আইনের ব্যবহার আর অপরদিকে আইনকে পাশ কাটানো হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এই অভিযোগ যে অনেক ক্ষেত্রে স্রেফ অভিযোগই এমন নয়, এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল কিছুটা হলেও মেলে।
আমরা দেখেছি, সুনামগঞ্জের যুবক ঝুমন দাশ ফেসবুকে এক ধর্মব্যবসায়ীর ধর্মব্যবসার প্রতিবাদ করার জন্যে আজ সাড়ে পাঁচ মাস ধরে কারাগারে। আদালতে-আদালতে ঘুরছেন তার স্বজনেরা, কিন্তু জামিন মেলেনি এখনও। আমরা দেখেছি, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পূর্ব অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও অভিনেত্রী পরীমণির বাসায় এলিট ফোর্স র্যাবের অভিযান। এরপর সেখানে সাড়ে চার ঘণ্টার অভিযানের পর তার বাসা থেকে মদ ও মাদক উদ্ধারের দাবি, এবং তারপর তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো। কেবল তা-ই নয় এরপর দফায় দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তাকে। জামিনের আবেদন বারবার নাকচ হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে জজ কোর্টে জামিনের আবেদনের পর তার সেই জামিন শুনানি আরও প্রায় তিন সপ্তাহ পর হবে বলে দিন ধার্য করা হয়েছে।
আমরা দেখেছি, কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় প্রশাসন ও মিডিয়ার ভূমিকা। আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছিল এক শিল্পপতির বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই অভিযোগের পর তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের পক্ষ থেকে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এরপর পুলিশের তদন্ত রিপোর্টে যা আদালত কর্তৃক গৃহীত হয়েছে সেখানে এই শিল্পপতিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তুমুল আলোচিত এই মামলায় পুলিশ একবারও জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে যায়নি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের কাছে, গ্রেপ্তার ত দূরের কথা।
আমরা দেখেছি, বরিশালে ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে সরকার দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ও সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এবং সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমানের শোভনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব কিংবা রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মুখোমুখি হয়ে যাওয়া। এই ঘটনায় পুলিশ-আনসারের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় মেয়র অনুসারী স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও সিটি করপোরেশনের কর্মীদের। ওই ঘটনায় পুলিশ ও আনসারের গুলিতে আহত হন শতাধিক লোক, চোখ হারান আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দুইজন। অনেকেই সে ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন বলে খবর বেরিয়েছে। তারমধ্যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন যেমন আছে তেমনি আছেন রাজনৈতিক কর্মী ও সিটি করপোরেশনের কর্মীরাও। ওই ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে যেখানে প্রধান আসামি সিটি মেয়র, আর দুইটা নালিশি মামলার আবেদন হয়েছে যেখানে আসামি ইউএনও-ওসিসহ অন্যরা। আবেদনগুলো আমলে নিয়ে আদালত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশও দিয়েছিলেন। এরইমধ্যে আমলাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন জরুরি সভা করে স্থানীয় রাজনীতিবিদকে ‘দুর্বৃত্ত’ আখ্যা দিয়ে আর গ্রেপ্তার দাবি করে। আমলা ও রাজনীতিবিদদের মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে আসা এই ঘটনার পর আইনি প্রতিবিধানের রাস্তাকে উপেক্ষা করে সেখানে আচমকা সমঝোতাও হয়েছে। এরওআগে আমরা দেখেছি, সিকদার ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলার পর তাদের দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া, এবং দেশে আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জামিনের ব্যবস্থা।
এই ঘটনাগুলোর মাঝখানে আমরা দেখেছি, আওয়ামী চাকরিজীবী লীগের ব্যানারে সারাদেশে নেতা বানানোর ঘোষণা দেওয়া আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী ও ঘটনার পর পরই আওয়ামী লীগের একটি উপকমিটি থেকে বহিস্কৃত নেত্রী হেলেনা জাহাঙ্গীরের পরিণতি। নেতা বানানোর ঘোষণা দেওয়ার পর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে প্রথমে প্রশাসনিক ও পরে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তার বাসায়ও অভিযান চালায় র্যাব, এবং অন্য অনেক ঘটনার মত সেখান থেকে মদ ও মাদক উদ্ধারের কথাও জানানো হয়। এরপর মামলা দেওয়া হয়। এখানে যেখানে সাংগঠনিক ব্যবস্থাটাই কাঙ্ক্ষিত ছিল সেখানে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হলো তৎপরবর্তী নানা আলোচনা ও সূত্রে মনে হলো নেতা বানানোর ঘোষণা দেওয়াই কাল হয়েছিল তার।
এখানে একেক ঘটনায় পুলিশ-র্যাবের একেক ভূমিকা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কোন ঘটনায় প্রশাসন যেখানে খুব গুরুত্ব দিয়েছে, আবার অনেক ঘটনায় তাদের ভূমিকা মোটেও আইনানুগ কিংবা যৌক্তিক ছিল না। সুনামগঞ্জের যে হিন্দু যুবক ঝুমন দাশ আপন আজ সাড়ে পাঁচ মাস ধরে কারাগারে বন্দি তার কী অপরাধ? উগ্রবাদী ধর্মীয় নেতা মামুনুল হকের প্রতি বিষোদগার, ফেসবুকে আক্রমণ? অথচ ঝুমন ফেসবুকে যা লিখেছেন তারচেয়েও আরও কঠোর শব্দ-বাক্যে অনেকেই মামুনুল হকের বিরোধিতা করেছিলেন, করছেনও। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে মামুনুল হকরা সারাদেশে যে বিদ্বেষ প্রচার এবং শেষে নাশকতা চালিয়েছিল তার কি প্রতিবাদ করা যাবে না? সুনামগঞ্জের মামুনুল হকদের উসকানির কারণে যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছিল, হিন্দু পল্লি আক্রান্ত হয়েছিল সেই মামলার প্রধান আসামি স্বাধীন মেম্বার পর্যন্ত যেখানে জামিনে মুক্ত সেখানে স্রেফ একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে বন্দি ঝুমন দাশ দীর্ঘদিন ধরে। এটা কি আইনের দুর্বলতা? না, এটা আইনের দুর্বলতা নয়; এটা অন্য কিছু!
অভিনেত্রী পরীমণির বিষয়টিও একইধরনের হতে যাচ্ছে। একের পর এক রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে তার বিরুদ্ধে, একের পর এক জামিনের আবেদন নাকচ হয়েছে নিম্ন আদালতে। এরপর জজ আদালতে জামিনের আবেদনের পর সেখানে শুরুতে বিচারক ১৩ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন ধার্য করেছেন। এরপর পরীমণির আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে গেলে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ দুইদিনের মধ্যে কেন জামিন শুনানি নয় এমন রুল জারি করেছেন।
একুশের গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরীসহ দেশের বিশিষ্টজনেরা অভিযোগ করে বলছেন এই অভিনেত্রীর ওপর অন্যায় করা হচ্ছে। তার ন্যায়বিচার ও মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে ইতোমধ্যে একাধিক কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরীমণির প্রতি ন্যায়বিচারের জন্যে লেখালেখিও চলছে, তবু মুক্তি মিলছে না। অনেকের অভিযোগ ঢাকা বোট ক্লাবকাণ্ডের পর ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ নাসির উদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে এখানে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক লেখায় আবদুল গাফফার চৌধুরী পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ঢাকা বোট ক্লাবের শীর্ষপদে থাকার সমালোচনা করেছেন। ওই কর্মকর্তা আর নাসির ইউ মাহমুদের সম্পর্ক যা-ই থাকুক, এই সম্পর্ক পরীমণির কারাবাসে ভূমিকা থাকুক কিংবা না-ই থাকুক এটা যে অনেকের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করছে তা বলাই বাহুল্য। তবে আমরা কষ্ট করে হলেও এমনটা বিশ্বাস করতে চাই না।
ঝুমন দাশ ও পরীমণির বিরুদ্ধে অন্যায় হচ্ছে। তাদের মুক্তিতে দৃশ্যমানভাবে আইনি বাধা প্রদান করা হচ্ছে, আর যা কিছু অদৃশ্যমান সেগুলো অনেক বেশি প্রভাবক হিসেবে মনে হচ্ছে। আবার কলেজছাত্রী মুনিয়ার মামলার ক্ষেত্রেও যা কিছু হয়েছে বা হচ্ছে সেগুলোকেও ন্যায়বিচার বলে ভাবা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সিকদার ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রতি রাষ্ট্রীয় যে ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো অভিযুক্তদের জন্যে সহায়ক হয়েছে। পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে ফিরে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের জামিনের ব্যবস্থা আর যা-ই হোক আইন সকলের জন্যে সমান ভাবা যাচ্ছে না। তারাও আইনি সুবিধা ভোগের অধিকার রাখেন কিন্তু যে প্রক্রিয়া তার জন্যে ছিল সেগুলো ঝুমন দাশ কিংবা পরীমণি কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি, এমনকি তাদের জন্যে স্বাভাবিক আইনি ব্যবস্থাও অনুসরণ হচ্ছে কি না এই সন্দেহ জাগছে।
বরিশালে শুরুতে যা হয়েছে তা ফৌজদারি অপরাধ। এর আইনি প্রতিবিধানের পথে প্রথমে যাওয়া হয়েছিল, এরপর রাতের আঁধারে দুপক্ষের সমঝোতা হয়েছে। এ সমঝোতায় মেয়র ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা লাভবান হয়েছে সত্য কিন্তু আক্রান্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের চোখ-রক্তের সিঁড়ি বেয়ে কারও কারও ক্ষমতার ভিত মজবুত হয়েছে। সমাধানের বিরুদ্ধে বলছি না ঠিক তবে এখানে আইনি প্রতিবিধানের ব্যবস্থাকে রীতিমত অস্বীকার করা হয়েছে। এই ঘটনার বিচার সম্পন্ন হলে এটা উদাহরণ হয়ে ওঠত। যদিও এখানে যে উদাহরণের সৃষ্টি হয়েছে সেটা জনগণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এটা মানুষের মাঝে যে ধারণার জন্ম দিচ্ছে সেটা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সহায়ক নয়। এটা আস্থার সঙ্কট বৃদ্ধি করবে, স্থায়ীভাবে।
একেকজনের প্রতি রাষ্ট্র ও ক্ষমতাবানের একেক আচরণ জনগণের মাঝে আস্থার সঙ্কট তৈরি করবে। এর প্রতিফলন খালি চোখে দেখা না গেলেও এটা জনগণকে রাষ্ট্র, সরকার ও আইনের প্রতি আস্থাহীন করবে, করছেও। এই আস্থার সঙ্কট সফল রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিবন্ধক।
বৈশ্বিক নানা সূচকে আমরা দিন দিন এগুচ্ছি। যে পাকিস্তানের অন্যায়, অপশাসন আর নিষ্পেষণে জর্জরিত হয়ে আমরা স্বাধিকার আর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আত্মত্যাগের মহাকাব্য রচনা করেছি সেই পাকিস্তানিরাও এখন বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে চায়। এটা আমাদের গৌরব ও অগ্রযাত্রার স্মারক। আমাদের এই অগ্রযাত্রা বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর কারণে যাতে জনতার আস্থাহীনতায় বৃথা না যায়!