অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক উপন্যাস

বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৯

পলাশ মাহবুব

প্রকাশিত: ০৫:৩৩ পিএম, ২৫ আগস্ট ২০২১ বুধবার   আপডেট: ০৫:৪১ পিএম, ২৫ আগস্ট ২০২১ বুধবার

১৪.
আজ একটু আগেই বাসায় ফেরেন সোলায়মান সাহেব। তার মন বেশ ফুরফুরে।
আসার পথে আদি ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে এক কেজি গুড়ের সন্দেশ কিনেছেন। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে নিয়েছেন এক হালি লেবু।
লেবুওয়ালা বলেছে, নিয়ে যান স্যার। লেবু প্রতি রস হবে এক কাপ। অন্য সময় হলে লেবুওয়ালার সাথে নানান বাহাসে জড়াতেন সোলায়মান সাহেব।
তোমাদের রস তো দেখি শুধু মুখে। লেবুতে তো পাই না। এর আগেও একই কথা বলছো। বাসায় গিয়া লেবু চিপড়াইয়া হাত বিষ হইছে। দু ফোটা রসও হয় নাই।
আজ তিনি সে ধরনের আলাপে যান না। বাইছা দিও বলে চারটা লেবুর দাম বের করেন।

বাসায় ঢুকে মিষ্টি আর লেবুর প্যাকেটটা রেখে নিজের রুমে চলে যান সোলায়মান সাহেব।
রাত্রির মা রান্না ঘরে কাজ করছেন। গরম তেলের মধ্যে তরকারি ঢালার ছ্যাৎ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
রান্নাঘর ছাড়া এই মানুষটার চিন্তায় আর কিছু নেই। দুনিয়াটাই তার কাছে রান্নাঘর। সোলায়মান সাহেব মনে মনে হাসেন।
অন্যান্য দিন তিনি যেমন বাসায় ঢুকে হাঁকডাক করেন। এটা দাও। ওটা কই। কোনও কিছু ঠিকঠাক জায়গা মতো পাই না। আজ তা করেন না।
নিজের রুমে গিয়ে কাপড় বদলান। বাথরুমে নেয়ার গামছাটাও নিজে খুঁজে নেন বারান্দা থেকে। তারপর বাথরুমে গিয়ে কলটা ছেড়ে দেন। গায়ে ঠান্ডা পানি ঢালেন। কলের ঠান্ডা পানি তারমধ্যে এক ধরনের শীতলতা আনে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে তিনি খবরের কাগজ নিয়ে বসেন। খবরের কাগজ ভর্তি সব খারাপ নিউজ।
বোমা বানাতে গিয়ে দুজনের হাত উড়ে গেছে। 
প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে হাতুড়িপেটা করল যুবক।
তিনি দ্বিতীয় খবরটা পড়েন।

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হাতুড়িপেটা করেছে এক যুবক। গতকাল মঙ্গলবার সকালে এই ঘটনা ঘটে। আহত মেয়েটির অবস্থা আশংকাজনক। তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। হামলাকারী যুবকের নাম রাকিবুল ইসলাম শিমুল। জনতা তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। তবে তার দুই সঙ্গী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
ছাত্রীকে পেটানোর ঘটনায় তার ভাই বাদী হয়ে বাঘা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন।

খবর পড়ে অন্যদিনের মতো উত্তেজিত হন না সোলায়মান সাহেব। কাউকে গালিগালাজও করেন না। তবে তার মন খারাপ হয়। তারচে বেশি হন শংকিত। 
মনে মনে বলেন, কোথায় যাচ্ছে সমাজ। চারদিকে শুধু অবক্ষয়! মানুষ আর মানুষ থাকছে না।

এসময় এঁটো হাত শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে রাত্রির মা আসেন।
কি ব্যাপার, তোমার যে আজকে কোনও সাড়া-শব্দ নাই? কি হইছে?
সোলায়মান সাহেব কিছু বলেন না। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন। তারপর আবার খবরের কাগজে মনযোগ দেন।
অফিস থেকে আসছো আগে আগে। আবার মিষ্টি আনছো। ঘটনা কি?
মিষ্টি মানুষ আনে কেন? খাওয়ার জন্য আনছি। অনেক দিন মিষ্টি খাওয়া হইতেছে না। মুখ তিতা তিতা হয়ে গেছে। তিতা ভাবটা কাটানো দরকার।
তোমার না ডায়বেটিস? তাও আনছো গুড়ের সন্দেশ। বুঝলাম না।
সোলায়মান সাহেব মুচকি হাসি ধরে রেখে বললেন, আইসাই ডিবি পুলিশের মতো জেরা শুরু করছো কেনো। বসো।
আরে আমার চুলায় তরকারি। আমার তো আর গা ঠান্ডা কইরা পেপার নিয়া বসার সময় নাই।
ও। তা ঠিক। আচ্ছা যাও। তরকারি নামাইয়া তারপরে আসো। পাকের ঘরে একটানা বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না। তাতে চুলার গরম শরীরের মধ্যে চলে আসে।
রাত্রির মা এবার আঁচল দিয়ে কপাল মোছেন। তিনি স্বামীর ভাবসাব বুঝতে পারেন না।
এই শোন। আসার সময় এক ক্লাস লেবুর শরবত আইনো। কাগজি লেবু আনছি এক হালি।
লেবুর শরবত আনবেন কি আনবেন না তা নিশ্চিত না করেই রাত্রির মা রান্নাঘরের দিকে চলে যান।

পেপারটা ইজি চেয়ারের ওপর রেখে সোলায়মান সাহেব যান আলনার কাছে।
জামার পকেট থেকে খামটা বের করেন।
নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও খামটা ভুলে টেবিলের ওপর ফেলে গেছেন মোতালেব সাহেব। খামের ভিতর পাত্রের ছবি। 
মোতালেব সাহেব যাকে এখন টিপে টিপে দেখছেন।
সোলায়মান মনযোগ দিয়ে ছবিটা আবাও দেখেন। ছবির উল্টো পাশে ছেলের নাম ঠিকানা দেয়া। 
অফিসে বসে দেখার সময় সেটা খেয়াল করেননি। ভালোই হয়েছে। মোতালেব সাহেবের কাছে পাত্রের নাম জানা হয়নি।
ছেলের নাম সুজন। মহিতুল আলম সুজন।ডেট অব বার্থও দেয়া আছে সাথে।
সোলায়মান সাহেব আঙুলের কড়ে বয়স হিসাব করেন। 
সার্টিফিকেট অনুযায়ী বয়স একত্রিশ বছর। তিনি গ্রেস দিয়ে আরও দুই বছর যোগ করেন। বিয়ে-শাদী তো আর বিসিএস পরীক্ষা না যে বয়স কমাতে হবে। এখানে আসল বয়স জানা জরুরি। 
তার মানে ছেলে অরিজিনাল বয়স তেত্রিশের কম না। বয়স ঠিকই আছে। এ যুগে স্টাবলিস্ট না হয়ে কেউ বিয়ে করতে চায় না। আর স্টাবলিস্ট হওয়ার জন্য একটু সময় তো লাগে।
দেখা যাক পাত্রীর মা কি বলে। তার মতামতও জানা প্রয়োজন। আগে সার্টিফিকেটে শুধু পিতার নাম ছিলো এখন মাতার নামও যুক্ত হয়েছে। দাওয়াত দিয়া যন্ত্রনা বাড়াইছে সরকার।
সোলায়মান সাহেব ছবিটা টেবিলের ওপর রেখে স্ত্রীর আসার অপেক্ষা করেন।

রাত্রির মা আসেন লেবুর শরবত আর পেঁয়াজু নিয়ে।
কি ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? স্বামীর সামনাসামনি চেয়ারে বসতে বসতে জানতে চান তিনি।
আরে না। ঘুম কি এত সহজ নাকি? বললাম আর চোখের পাতায় বসে গেলো।
অফিস থেকে আসার পথে প্রতিদিন ওটাকেই তো সাথে করে নিয়ে আসো। আচ্ছা এবার বলো কি বলবে।
সোলায়মান সাহেব আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসেন।
দাও দেখি শরবতটা।
শরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক টানে শেষ করেন তিনি। তারপর স্ত্রী দিকে নোনতা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ডায়বেটিস বলে কি আমাকে বাকি জীবন চিনি ছাড়া শরবত খেতে হবে! চিনি ছাড়া শরবত আর বাজনা ছাড়া গান সমতুল্য। আচ্ছা যাই হোক।
গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে ছবিটা হাতে নেন সোলায়মান সাহেব।
দেখো তো ছেলেটা কেমন? ছবিটা স্ত্রীর হাতে দেন তিনি।
ছবি হাতে নিয়ে যা বোঝার বুঝে যান রাত্রির মা। তিনি সরু দৃষ্টিতে ছবিটা দেখেন।
ছেলে তো কালো।
এই ছেলে তো সিনেমার হিরো হবে না। পুরুষ মানুষের আবার কালো-ধলো কি। তাছাড়া তুমি যেভাবে ভুরু কুঁচকে কালো বললা ছেলেটা কিন্তু তত কালো না। শ্যামলা কিন্তু চেহারার মধ্যে মিষ্টতা আছে। মন লাগাইয়া দেখলে বুঝবা।
রাত্রির মা আবার ছবিতে মনযোগ দেন।
বয়সটা মনে হয় একটু বেশি।
আরে না। যে বয়স বলছে তার চেয়ে দুই বছর বাড়াইয়া ধরছি। তারপরও তেত্রিশের ওপর ওঠে না। তেত্রিশ মোটে বেশি বয়স না।
কি বলো তেত্রিশ। মাথায় চুল তো নাই বললেই চলে।
স্ত্রীর কথা শুনে সোলায়মান সাহেবের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ে। আরে, চুল কাইটা ছবি তুলছে। সেজন্য কম মনে হচ্ছে। এমনিতে চুল ঠিকঠাক আছে।
কী বলতেছো তুমি! চুল কাটার পরে কম আর এই কমে বেশ-কম আছে। এই ছেলের মাথায় টাক পড়ার লক্ষন ধরছে।
আমি যারে দেখাই তারই একটা না একটা সমস্যা। কারো নাক বোঁচা। কারো দাঁত উঁচা। এখন বলতেছো এই ছেলের মাথায় চুল কম। তুমি তো আর্মির সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে চাও। তাগেতো মাথায় চুলই থাকে না। সব বাঁটিছাট। এইট্টুক এইট্টুক।
আঙুলের কর উঁচিয়ে চুলের সাইজ দেখান সোলায়মান সাহেব।
রাত্রির মা কিছু বলেন না। তিনি পাত্রের ছবি দেখায় আরও মনযোগি হন।
আবারও মুখ খোলেন সোলায়মান সাহেব। শোনো, বিয়ের বাজারে এত খুঁতখুঁতে হইলে চলে না। নো বডি ইজ পারফেক্ট। হানড্রেড পার্সেন্ট নিখুঁত কোনও মানুষ নাই। আমার মুখেও তো বসন্তের দাগ ছিলো। তুমি আমাকে বিয়ে করছো না? এই ছেলে একটু কালো সেটা মানতেছি। কিন্তু তার অন্য সাইড স্ট্রং। শিক্ষিত ছেলে। বিদেশে ছিলে। হাতে টাকা-পয়সাও ভালো আছে। মোতালেব সাহেব লেগে আছেন। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখছেন। ইনফরমেশন সব ঠিকঠাক থাকলে পাত্র হিসেবে ছেলেটা খারাপ হবে না।
ফ্যামিলির খোঁজখবর নিছো? রাত্রির মা জানতে চান।
ফ্যামিলি ওকে আছে। বড় বংশ। তবে ছেলে ঠিকঠাক কিনা সেটা হচ্ছে আসল কথা। তোমার মেয়ে থাকবে ছেলের সাথে। ছেলে হচ্ছে ইর্ম্পটেন্ট।
মোতালেব সাহেবের যুক্তি মনে ধরায় পাত্রের বাবার দ্বিতীয় বিবাহের কথা এড়িয়ে যান সোলায়মান সাহেব।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি দেখেছো। আমিও দেখলাম। এখন রাত্রি দেখুক। সংসার তো সে করবে। তারও তো একটা পছন্দ-অপছন্দ আছে। তার মতামত নেই।
তা দেখুক। কিন্তু সবকিছু যদি ব্যাটে বলে মিলে যায় তাহলে কিন্তু এই ছেলে আমি হাতছাড়া করবো না। কোনো টের-বেটের চলবে না। শোন, পোলাপানের অনেক কিছু পছন্দ হইতে পারে। তাই বইলা তাদের সব বায়না মিটইাতে হবে সেটা কাজের কথা না। তাছাড়া এই বয়সের মেয়েরা একটা ভ্রান্তিন মধ্যে থাকে। বেশির ভাগ সময় ভুলটারে তাদের ঠিক মনে হয়। ভুল যাতে না করে সেটা দেখার দায়িত্ব পিতা-মাতার।
রাত্রির মা কথা বাড়ান না। তিনি খালি গ্লাস নিয়ে উঠে যান।
রান্নাঘরে যাওয়ার পথে রাত্রির সাথে দেখা হয় তার।
কিরে রাত্রি। কি হয়েছে তোর? তোকে এরকম লাগছে কেন!

চলবে...

আগের পর্ব পড়ুন

বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৮

বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৭

বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৬

বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৫

বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৪

বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৩

বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-২

বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-১