চাঁদ, আবহাওয়া, জোয়ার ও আমাদের ভবিষ্যৎ
অপরাজেয় বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:২৪ পিএম, ২৪ আগস্ট ২০২১ মঙ্গলবার আপডেট: ০৪:৫৪ পিএম, ২৫ আগস্ট ২০২১ বুধবার
প্রায় ৪ হাজার ৫০০ বছর আগে পৃথিবীর জন্ম হয়েছিল দুটি গ্রহের তীব্র সংঘর্ষের কারণে। সে সময় থিয়া নামক একটি গ্রহের সঙ্গে মুখোমুখি তীব্র সংঘর্ষের ফলে থিয়া গ্রহটি পৃথিবীর সঙ্গে জুড়ে যায়। তৈরি হয় নতুন একটি গ্রহ, যেখানে আমাদের বসবাস।
আর ওই সংঘর্ষের মহাকর্ষীয় টানে তৈরি হয় চাঁদ। যা মহাকাশের বিশালতায় আমাদের নিকটতম সহচর, আমাদের অস্তিত্বের সাথে অন্তর্নিহিতভাবে যুক্ত, পৃথিবীতে জীবনের চক্রে ওতপ্রতভাবে জড়িত। পৃথিবীর ওপর যার প্রভাব এখনও পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হয়নি।
বিভিন্ন প্রভাবে সে চাঁদ এখন পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। চাঁদের ভবিষ্যৎ, আবহাওয়া, চাঁদের প্রভাব এবং আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়েই এই লেখা।
ভবঘুরে কক্ষপথ
পৃথিবীতে চাঁদের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রভাব সাগরের জোয়ারে দেখা যায়। পৃথিবী যখন প্রতিদিন আবর্তন করে, তখন চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর নিকটতম দিকের পানিকে তার দিকে টেনে নিয়ে যায়, যার ফলে একটি স্ফীতি তৈরি হয়।
পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে কেন্দ্রীভূত শক্তির প্রভাবে সমুদ্র বিপরীত দিকেও ফুলে যায়। পৃথিবী এই জলাভূমির নীচে ঘোরে, যার ফলে আমরা প্রতিদিন দুটি উচ্চ জোয়ার এবং দুটি নিম্ন জোয়ার দেখি।
প্রতি ১৮.৬ বছরে চাঁদের কক্ষপথ পৃথিবীর বিষুবরেখার তুলনায় সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন প্লাস বা মাইনাস ৫ ডিগ্রির মধ্যে চলে যায়। এই চক্রকে চাঁদের নোডাল চক্র বলা হয়। যখন চাঁদ নিরক্ষীয় সমতল থেকে দূরে হেলে যায়, তখন পৃথিবীতে জোয়ার ছোট হয়। যখন চাঁদের কক্ষপথ পৃথিবীর নিরক্ষরেখার সাথে বেশি মিলিত হয়, তখন উচ্চ জোয়ার দেখা যায়।
এখন, নাসা বলছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে চাঁদের নোডাল চক্রের প্রভাবের সাথে মিলিত হলে ২০৩০-এর দশকে উচ্চ-জোয়ারের বন্যার সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে।
নাসার সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তন বিজ্ঞান দলের নেতৃত্বে থাকা বেঞ্জামিন হ্যামলিংটন দেখিয়েছেন সমুদ্রের স্তরগুলি কীভাবে প্রাকৃতিক এবং মানবিক উভয় ক্রিয়ায় সাড়া দেয় এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জন্য এর অর্থ কী।
তিনি বলেন, "উচ্চ-জোয়ারের বন্যা উপকূলীয় জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এটি আপনার চাকরি, ব্যবসা থেকে শুরু করে সবকিছু কঠিন করে তোলে। আগামী দিনে এটি উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠবে, সাথে বসবাস করা কঠিন হবে।"
হ্যামলিংটন বলছেন, চাঁদের দ্বারা সৃষ্ট এই বন্যা অবকাঠামোর ক্ষতি এবং উপকূলরেখা পরিবর্তন করবে। তিনি বলেন "আমরা এক দশক থেকে পরবর্তী দশকে বন্যার পরিমাণের চারগুণ দেখতে পাব। চাঁদের নোডাল চক্র পৃথিবীর সব স্থানে প্রভাব ফেলে এবং সমুদ্রের স্তর সর্বত্র বেড়ে যাচ্ছে। তাই আমরা বিশ্বজুড়ে উচ্চ-জোয়ারের বন্যায় এই দ্রুত বৃদ্ধি দেখতে পাব। "
চাঁদ নোডাল চক্র মানুষের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ উত্থাপন করতে পারে, কিন্তু উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের বন্যজীবনের জন্য এটি একটি অস্তিত্বের হুমকি হয়ে উঠবে।
চাঁদ নোডাল চক্র এবং লবণ মার্শ মশার জনসংখ্যার মধ্যে সম্পর্ক অধ্যয়ন করেন রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ইলিয়া রোচলিন।
রোচলিন বলছেন, "যখন নোডাল চক্র চূড়ায় থাকে, তখন উচ্চ জোয়ার বন্যার মশার আবাসস্থলকে আরও স্থলভাগে নিয়ে যায়।" জোয়ারের বন্যা এই সময়ে প্রায়ই ঘটে, এবং তার সাথে কিলিফিশ (কয়েক শত প্রজাতির মিনো-জাতীয় মাছের একটি গ্রুপ যা লবণ, লোনা এবং তাজা পানিতে পাওয়া যায়) নিয়ে আসে। এই শিকারীরা ডিম, লার্ভা বা পিউপা পর্যায়ে মশা খায় যার ফলে মশা উপকূল ছেড়ে আরও দূরে চলে যায়। তাদের জনসংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।
আবার একই সাথে কিলিফিশ শোরবার্ড এবং বড় মাছের প্রধান খাদ্য উৎস। এছাড়া লবণাক্ত জলাভূমি তৈরি হলে অমেরুদণ্ডী প্রাণীগুলি একসময় মরতে শুরু করে যা তীরে পাখি, মাছ এবং তাদের উপর নির্ভরশীল অন্যান্য প্রজাতিগুলিও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। লবণাক্ত পানি বেড়ে গেলে তাই পুরো জীবনচক্রই প্রভাবিত হয়।
যা শেষ পর্যন্ত প্রভাব ফেলে আমাদের জীবনে। কেননা সমুদ্র অর্থনীতির উপর আমাদের জীবন অনেকাংশে নির্ভর করে।
চাঁদের নড়াচড়া এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার কারণে বন্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মিঠা পানির জলাভূমিও গভীর পরিবর্তনের সম্মুখীন হতে পারে।
নর্দান কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরিবেশ বিজ্ঞানী ক্রিস্টিন হপফেন্সপার্গার যিনি মিঠা পানির জলাভূমির লবণাক্তকরণ নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলেন, "মিঠা পানির জলাভুমি অনেক বেশি জীববৈচিত্র্যপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে প্রচুর জোয়ারের কারণে লবণাক্ত পানি মিঠা পানির সঙ্গে মিশে যাওয়া যে জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে। একসময় মিঠা পানির সঙ্গে সম্পূক্ত উদ্ভিদ ও প্রাণী বদলাতে শুরু করে।
তিনি বলেন, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গ মিঠা পানির জলাভূমি লবণাক্ত হতে থাকবে। যত ঘন ঘন বন্যা হবে, তত বেশি জলাভূমি লবণাক্ততার দ্বারা প্রভাবিত হবে।
বরফ, স্থলভাগ এবং বায়ু
আসন্ন দশকগুলোতি নোডাল চক্র ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। সে সাথে সংক্ষিপ্ত সময়সীমাযতেও চাঁদ পৃথিবীতে বড় প্রভাব ফেলে।
চাঁদ মেরু তাপমাত্রাকে প্রভাবিত করে এবং আর্কটিক বরফের পরিমাণে ওঠানামায় অবদান রাখে বলে মনে করা হয়। স্যাটেলাইট পরিমাপে দেখা গেছে যে পূর্ণ চাঁদের সময় মেরুগুলি ০.৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ হয়।
উপরন্তু, উচ্চ জোয়ার মেরু অঞ্জরের বরফ ভেঙে এবং সমুদ্রের তাপ প্রবাহকে পরিবর্তন করে আর্কটিক মহাসাগরে বরফের পরিমাণ পরিবর্তন করে।
ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফি সেন্টারের সামুদ্রিক পদার্থবিজ্ঞান এবং মহাসাগরীয় পানিবায়ু বিশেষজ্ঞ ক্রিস উইলসন বলেন, চাঁদ সমুদ্রের পৃষ্ঠ এবং গভীরতায় জোয়ারের স্রোত এবং তরঙ্গ উৎপন্ন করে। "উষ্ণ পানি মিশ্রণের কারণে অথবা বরফকে ছোট ছোট টুকরোতে পরিণত করায় মেরু অঞ্চলের বরফ একসময় পুরো গলে যেতে পারে বা ভেঙে যেতে পারে।
সমুদ্রের পানি এবং বরফ গ্রহের একমাত্র অংশ নয় যা জোয়ার অনুভব করে। চাঁদের প্রভাব ভূপৃষ্ঠ এবং সামগ্রিক আবহাওয়াতেও পড়ে। যাকে আবার ‘আর্থ টাইড’ বলা হয়।
আর্থ টাইড সমুদ্রের জোয়ারের অনুরূপ। এতে ভূমি বিকৃত হয় এবং আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ, ভূমিকম্পের সূত্রপাত হয়ে বলে মনে করা হয়।
আর্থ টাইড বায়ুমণ্ডলীয় চাপের পরিবর্তন ঘটায়। চাঁদের অবস্থানের সঙ্গে যুক্ত বায়ুচাপের পরিবর্তনগুলি প্রথম সনাক্ত করা হয় ১৮৪৭ সালে।
চাঁদের প্রভাব কখনও কখনও সূক্ষ্ম এবং কখনও কখনও গভীর। যা পৃথিবীতে জীবনের উপর একটি গঠনমূলক প্রভাব ফেলেছে। কিছু বিজ্ঞানী যুক্তি দেন যে এটি চাঁদই পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে।
চাঁদ পৃথিবীর অক্ষের উপর ঘুরে স্থিতিশীল পানিবায়ু দিতে সাহায্য করে। এটি ছাড়া পৃথিবী মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তখন দিন এবং রাত সবই খুব আলাদা দেখাবে।
কিন্তু চাঁদ এখন পৃথিবী থেকে প্রতিদিন ৪ কিলোমিটার দূরে সরে যাচ্ছে। পৃথিবী চাঁদের কক্ষপথের চেয়ে বেশি দ্রুত ঘোরে, তাই মহাকর্ষ চাঁদকে দ্রুত বরাবর টেনে নেয়। চাঁদ তখন একটু বাইরের দিকে ছুটে যায় এবং এর কক্ষপথ বড় হয়।
এভাবে চললে একসময় পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে সরে যেতে পারে চাঁদ। তখন ভবিষ্যৎ জীবন হয়ে উঠবে ভয়াবহ।
সূত্র: বিবিস