অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

১৫ আগস্ট: বঙ্গবন্ধু, আমার বাবা এবং শোকাবহ শূন্যতা

অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান

প্রকাশিত: ০২:৪৯ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০২১ শনিবার   আপডেট: ০৫:৪৫ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০২১ শনিবার

অশ্রুভেজা শোকাবহ ১৫ আগস্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস। দিনটির সূর্যোদয় হবে সেই মহান নেতা জাতির পিতাকে স্মরণ করে। 

'মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি'

যে মানুষটির হাত ছুঁয়ে এসেছিলো স্বাধীনতা । সবুজ মানচিত্র .. লাল সবুজের পতাকা .. একটি দেশ । তার কথা বলছি। 

“বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই মুজিব”
“কে বলেছে মুজিব নাই, মুজিব সারা বাংলায়”
“এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে “ 

এই শ্লোগান গুলো আমার রক্তের সাথে সতত প্রবহমান । মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত যে মানুষটি থাকবে আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। আমি কোনদিন বঙবন্ধুকে কাছ থেকে দেখিনি। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি, কিন্তু এই দুঃখবোধ যেমন আমাকে কাঁদায় ঠিক তেমনি মুক্তিযুদ্ধ - বঙ্গবন্ধু আমার প্রতিদিনের অহংকার। 

আমার বাবার সৌভাগ্য হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পাবার। আমার  বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন । কিন্তু সেই গল্পগুলো কতবার যে শুনেছি বাবার মুখে। বঙ্গবন্ধু যে স্কুলে পড়াশোনা করতেন আমার বাবাও পড়তেন একই স্কুলে। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর কয়েক বছরের ছোট । আমার বাবা প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হেঁটে স্কুলে যেতেন। স্কুলে প্রথম বেঞ্চে বসতেন । কিন্ত কয়েকজন ছেলে প্রায়ই বাবার বই খাতা ফেলে পেছনে রেখে দিতো। বাবা একদিন সেই সময়ের মুজিবকে এই বিষয়টি জানান। তারপর থেকে বাবা প্রতিদিনই প্রথম বেঞ্চে বসতেন, কেউ আর বই ফেলতো না। এভাবে বঙ্গবন্ধুকে না দেখলেও এ রকম অনেক গল্পে বেড়ে উঠেছি বঙ্গবন্ধুর সাহস আর শক্তি নিয়ে। আমার বাবা আমাদের একটি লোহার রড দেখাতেন আর বলতেন, এটি নিয়েই তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চের জনসভায় রেস কোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন । সেই জনসভার গল্পও আমরা বাবার মুখে শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। 

আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন বঙ্গবন্ধুর একটি পোস্টার আমাদের বাসায় টাঙানো দেখতাম। পচাত্তরের সেই দুঃসময়েও বাবা পোস্টারটি নামাতে দেননি। অনেক আত্মীয় স্বজন এসে ভয় মাখানো কথা বলতো । বাবা বলতেন একবারতো ৭১ এ মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছি । এখন আর ভয় পাই না। সেই সময়ে দু'আনা দামে আমার বাবার কেনা বঙ্গবন্ধুর সেই পোস্টারটি হৃদয়ের একেবারে গহীনে নিয়েই বড় হয়েছি। 

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টেও আমি ছোট ছিলাম । কিন্তু বুঝতে পারতাম। সেই সময়ের বিভীষিকাময় দিনগুলোয় আমার আব্বা ভীষণ আহত ছিলেন। “শেখ সাহেবকে মেরে ফেলেছে ঘাতকরা... সে কি হাহাকার তার কণ্ঠে। তিনি ভাবতে পারছিলেন না। পাকিস্তানিরা যা করতে সাহস করেনি, এ দেশেরই কিছু লোক তা ঘটিয়েছে...। বাবার ভেতরের শূন্যতা এখনো অনুভব করি।  মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম...
মুসলমানদের নামাজে যাওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে ।
সে আহ্বান উপেক্ষা করে ঘাতকেরা এগিয়ে গেলো ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডটি ঘটানোর জন্য।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের  শাহাদাত বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ ৭৫-এর ১৫ই আগস্টে ঘাতকের নির্মম বুলেটে নিহত সকল শহীদদের।

ঘাতকেরা ভেবেছিল জাতির পিতাকে হত্যা করলেই তাঁর নাম মুছে ফেলা যাবে এই বাংলায়। কিন্তু তারা বোঝেনি বঙ্গবন্ধুর আরেক  নাম বাংলাদেশ।
বঙবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ প্রত্যাশিত যাত্রা থেকে বিচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছিল।

১৫ আগস্ট শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসের বড় দুর্যোগ নয়, এটি সারা বিশ্বের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। যে নৃশংসতায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করা হয়েছিল তার কোনো তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে নেই। যখন এদেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামক কালো একটি আইন ছিলো- সেটি বাতিলের জন্য  খুব বেশি মানুষের মিছিল দেখিনি । টক শো তে না হোক, আজকের দিনের অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বদের কজনইবা  ছিলেন এই কালো আইনের বিরোধিতা করবার জন্য। 

কিন্তু সেই সাদা কালো পোষ্টারে যখন লেখা থাকতো..
কাঁদো বাঙালী কাঁদো....
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল কর" তা আমাদের আলোড়িত করতো।

সত্যিই বিচারের বাণী নিভৃতেই কেঁদেছে বছরের পর বছর। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়... সেই সময় ১৫ আগস্টে হরতাল হতো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ডাকে। আমরা হেঁটে হেঁটে যেতাম ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অথবা স্বেচ্ছায় রক্তদান অনুষ্ঠান আয়োজন করতে । আমার 
বাবা যেমন বঙ্গবন্ধুর বীরত্বের কথা বলতেন আনন্দ নিয়ে আর আমরা সন্তানরা শুনতাম সেইসব দিনের কথা। আমার বাবা কোন নেতা ছিলেন না, সরকারের একেবারেই একজন সাধারন কর্মচারী হিসেবে জীবন পার করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন । কিন্তু জীবনাচরনে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সত্যিকারের অনুসারীর মতো সাহসী এবং স্বাধীনচেতা। 

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করলো ১৯৯৬ সালে । তখন বিটিভি তে বেশ কিছু অনুষ্ঠান করেছিলো ১৯৭১ এর নির্যাতিত মানুষদের কাহিনী নিয়ে অথবা মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। সেই সময় আমার বন্ধু আব্দুন নূর তুষার একটি অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব পেয়েছিল । তুষার আমার বাবার একটি সাক্ষাত্কার নিয়েছিলো সেই সময়কে ধারন করে। কিন্তু কয়েকদিন আগে জানতে পারি সেই সময়ের অনুষ্ঠানের কোন কিছুই নেই আর্কাইভে। 

আমার কষ্ট হয়েছিলো শুনে...সেটিই ছিলো আমার বাবার মিডিয়াতে প্রথম এবং শেষ সাক্ষাৎকার অথবা কথকতা । সেটিও তুষার বার বার অনুরোধ করায় বিটিভির স্টুডিওতে গিয়েছিলেন। 
 
একথা মনে করবার কারন হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিলো না তখন অনেক বঙ্গবন্ধু সৈনিককে দেখতাম যারা কোন কিছু চাওয়া পাওয়ার হিসেব না করেই ৩২ নম্বরে ভীড় করতেন জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাতে অথবা শেখের বেটিকে এক নজর দেখতে । পরনে ময়লা কাপড় হয়তো “নব্য আওয়ামী লীগার শাহেদদের মতো কথাবার্তায় চোস্ত নয়, কিন্তু রিকসায় বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়ে ৭ই মার্চের ভাষণ শুনাতেন আগ্রহভরে। আমি চাই সেই সব মুখ খুঁজে ফিরি । আমাকে এখনো উজ্জীবিত করে সেই সব দৃপ্ত শৃঙ্খলমুক্ত মুখ। পায়ে পায়ে যেন হারিয়ে না যায় সেই সব মুখ। 

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর জীবনীকে অনুধাবন করতে হবে। এই দিনে আমরা এই মহামানবকে  স্মরণ করি, শোকে কাতর হই... আবার শোককে শক্তিতে পরিণত করতে চাই। বঙবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব, মানবপ্রেম, অধিকারবোধ ও তার নেতৃত্বগুণ, সাহস, সততা, নিষ্ঠা ও আপসহীনতার মতো গুণাবলি নিজেদের ভেতর ধারন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে, দেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে, সৎ কাজের মাধ্যমেই সম্ভব তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা প্রদর্শন। 

এই মধ্যরাতে চারপাশে এখন নিঁভাজ নিঃসঙতা। এই পনেরো আগস্ট এলে বাবাও নিঃসঙতা বা একাকীত্ব বোধ করতেন। মাঝে মাঝে ঘৃণা ঝড়ে পড়ে কতিপয় বিড়ালের উপর। কেন পথভ্রষ্ট স্বার্থান্বেষী ইঁদুরেরা ব্যর্থ হয়ে গর্তের ভিতর ঢুকেছিলো? ওরা কি পারতো না বঙবন্ধুকে বাঁচাতে? । খন্দকার মোশতাকের গোপন ইশারায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল তারা, এগিয়ে এল না সাহায্য করতে। 

মনে হয় এক অভিশপ্ত স্তব্দতায় নিজের অস্তিত্ব খুঁজে ফিরি। শূন্যতায় খুঁজি শাদা পিরহান..বাবার কন্ঠে পবিত্র কোরআনের বাণী। 
তোমার জন্য অতল শ্রদ্ধা 
হে পিতা।


অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান
অধ্যাপক, হৃদরোগ বিভাগ এবং হল প্রোভোষ্ট
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
সদস্য, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।