নিউইয়র্কে আগ্রাবাদ নাইট, এক মুখরিত সন্ধ্যার গল্প
আশরাফুল হাবিব মিহির, নিউইয়র্ক থেকে
প্রকাশিত: ১২:০১ এএম, ১৩ আগস্ট ২০২১ শুক্রবার আপডেট: ১২:০৩ এএম, ১৩ আগস্ট ২০২১ শুক্রবার
“এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে / অজানা হাজার কত কাজের ভিড়ে / ছোট্টবেলার শত রঙ করা মুখ / সুর তোলে আজও এই মনকে ঘিরে” গানটি যখন শুরু হয় তখন পুরো অনুষ্ঠানস্থল হয়ে ওঠে জমজমাট। কৈশোরের সাথী, পাড়ার সাথী, স্কুল জীবনের সহপাঠীদের সাথে ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায় সকলের। দিন বদলের পালায় এই আত্মার আত্মীয় বন্ধুরা একেক জনের ঠাঁই হয়েছে এখন একেক জায়গায়। কিন্তু এই মিলন মেলায় শৈশব আর কৈশরের সেই আত্মার আত্মীয়রা মিলিত হয়েছিলেন। যে যেখানে, যত দূরেই কিংবা কাছে, কিংবা থাকুক শত ব্যস্ততা, কোন বাধাই যেন বাধা হয়ে দাড়াতে পারে নি তাদের সামনে। উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সকল আগ্রাবাদের মানুষগুলো তাদের প্রাণের সংগঠন ‘পরানে আগ্রাবাদ ইউএসএ’-এর উদ্যোগে মিলিত হয়েছিলেন আগ্রাবাদ নাইটে।
গত ৭ আগষ্ট নিউইর্য়কের কুইন্সের হিলসাইড এভিনিউর তাজমহল রেষ্টুরেন্ট ও পার্টি হলে প্রাণের মেলায় মনের টানে, বন্ধুত্বের বন্ধনের সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন স্টেট - নিউইর্য়ক, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া, কার্নেকটিকাট, ওহাইহো, ম্যাসাচুসেট্স থেকে আগ্রাবাদিয়ান পরিবারগুলো ছুটে আসে আগ্রাবাদ নাইটে।
সাম্প্রতিক ডেলটা ভেরিয়েন্ট করোনা ভাইরাসের সংক্রমন বেড়ে যাওয়া অনুষ্ঠানে আগত সবাইকে মাস্ক পরে থাকার অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি যারা ডাবল ভ্যাকসিনেটেডরাই কেবল আসতে পেরেছিলেন। তবে সে সংখ্যাটিও নেহায়েত কম ছিলো না। বাংলাদেশ এবং আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে কোরআন তেলোয়াত ও তরজমা করেন হাসিন আহমেদ।
আমেনা রশিদ চুন্নী ও রোশনা শামস্ ললির প্রাণবন্ত উপস্থাপনায়, পরানে আগ্রাবাদ ইউএসএ -এর আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম মাকসুদুর রহমান খান জুয়েল স্বাগত ব্ক্তব্যে বলছিলেন - "আমরা যারা আমাদের ছোটকালে আগ্রাবাদে কাটিয়েছি, তারা আজ প্রাণের টানে এখানে ছুটে এসেছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য একটাই, সেই শৈশবের হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষদের একত্রিত করে একটি আনন্দঘন সন্ধ্যা উপভোগ করা। নিউইর্য়কে এবারের আয়োজন সহ এটি চতুর্থ আয়োজন, আশা করছি ভবিষ্যতের কার্যক্রমগুলো আরো প্রাণবন্ত হবে।"
স্মৃতিচারণ শেষ করে সংগঠক ফরহাদ রেজা বাদশা বললেন - "এই কঠিন সময়ে আমরা সবাই যেন একসাথে থাকতে পারি, কোভিডে আমরা আমাদের কাছের অনেকজনকে হারিয়েছি, দোয়া করবেন আমরা যেন ভালো থাকতে পারি, সুস্থ থাকতে পারি এবং আগ্রাবাদিয়ান হিসাবে আমরা যেন গর্ববোধ করতে পারি।"
সংগঠক আফসার উদ্দিন তার বক্তব্যে বলেন, এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে আমি যেন আমার শৈশবের সেই আগ্রাবাদেই আছি, নিউইর্য়কে যে আছি, সেটা মনে হচ্ছে না। এতগুলো পরিচিত মুখ একসাথে দেখার পর, নিজেকে সামলানো অনেক কষ্টকর। আমরা সবাই যদি আমাদের সেই পুরোনো গল্পগুলো করা শুরু করি তাহলে সারারাত চলে যাবে।
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, সোলসের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও শিল্পী তাজুল ইমাম তার স্মৃতিচারণে বলেন- “যুদ্ধ থেকে যখন ১৬ ডিসেম্বর ফিরে আসলাম আমাদের আগ্রাবাদের বাসায়, তখন সন্ধ্যা। প্লাটুন গাড়িতে বসে আছে, আমাদের সবার হাতে অটোমেটিক গান, আমার ভাইবোনরা আমাকে নিয়ে কাঁদছিলেন, আমাকে নিয়ে উদযাপন করছিলেন বিজয়ের, সেই স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আগ্রাবাদ”। এরপর নিজের লেখা ও সুর করা “পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে” গানটি খালি গলায় গেয়ে শোনান। এছাড়াও স্মৃতিচারণ পর্বে অংশ নেন - নাসিম, জয় আনন্দ ও ইফতেখার।
গান পরিবেশন করেন ফিরোজ আহমেদ এবং কবিতা আবৃত্তি করেন রোশনা শামস্ ললি ও জয় আনন্দ। গানে গানে খেলায়, গান ও অভিনয় করে পুরস্কার লাভ করেন- মিলি, তাসরিন শফি । র্যাফেল ড্র তে ১ম পুরস্কার বিজয়ী হলেন- নাসরিন, ২য় পুরস্কার- নীলা, ৩য় পুরস্কার- আতফা, ৪র্থ পুরস্কার- চিশতী, ৫ম পুরস্কার- শাহীন এবং ৬ষ্ঠ পুরস্কার- জাহাঙ্গীর।
সাংস্কৃতিক পর্বে শিল্পীদের একের পর এক চমৎকার গানের পরিবেশনায় সবাইতে মনে করিয়ে দেয় পুরোনো সেই দিনের কথা, ছোট বড় সবাই নিজেদের আসন ছেড়ে মঞ্চের সামনে এসে গানের তালে তালে নাচতে থাকেন, যেন ফিরে গিয়েছেন সেই ছোটবেলায়। পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে অনেকে আবেগেআপ্লুত, অনেকে ফিরে গেছেন পুরোনো সেই স্মৃতিমাখা দিনে। কেউ কেউ ভিডিও কলে অংশগ্রহণ করতে না পারা বন্ধুদের দেখাচ্ছিলেন। আড্ডা, গান, আনন্দ উচ্ছাসে মিলনমেলায় পরিণত হয় পুরো হল। সঙ্গীত পরিবেশন করেন দেশের ও প্রবাসের জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী চন্দ্রা রয় ও ক্লোজ-আপ ওয়ান শিল্পী রাজীব ভট্টাচার্য্য এবং অসাধারণ সাউন্ড সিস্টেমে ছিলেন ফিরোজ।
দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে এমন আয়োজন করতে পেরে খুশি আয়োজকরা। তারা জানান -নিউইর্য়ক সহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের সবাইকে একত্রে করার উদ্দ্যোগ এটি। পরাণে আগ্রাবাদের এই আয়োজনে, ইউএসএর পক্ষে যারা নিরলসভবে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে ছিলেন- বাদশা, বকুল, বাবু, জুয়েল, আতিক, চুন্নী, রুশো, ললিসহ অনেকে। উল্লেখ্য, পরাণে আগ্রাবাদের এই আয়োজন বাংলাদেশ, লন্ডন ও নিউইর্য়ক সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে।